আজ রবিবার। হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। একটা গল্প লিখতে বসলাম। যাঁরা আমার ব্লগে নজর দিচ্ছেন তাঁদের কাছে একটা অনুরোধ, মতামত দিতে কার্পণ্য করবেন না। ভালো মন্দ যাই হোক না কেন! এবারে গল্পে...।
বেশ কিছুদিন ধরেই টেলিফোনে মেয়েটি একটা কথাই বলে চলেছে, সে একবারটি বেদান্ত'র সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু কেন দেখা করতে চায় তা জানতে চাইলে তার একটাই উত্তর, দেখা হলেই বলা যাবে। নানাভাবে মেয়েটিকে এড়াবার চেষ্টা করেছে বেদান্ত। কোনো লাভ হয়নি। রাত আড়াইটে-তিনটের সময়েও ফোন করেছে অসঙ্কোচে।
.... এই অদ্ভুত সমস্যাটা নিয়ে বেদান্ত দু'একজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেও পরামর্শ করেছে। ওরা থানায় মেয়েটির ফোন নাম্বার দিয়ে একটা রিপোর্ট লেখাতে বললেও বেদান্ত রাজি হয়নি। থানায় গেলেই নানা প্রশ্ন উঠবে। গভীর রাতে 'মেয়েছেলে' ফোন করে 'ফানি আব্দার করে শুনেই ওসি বাবাজীবনের প্রেসার চড়ে যেতে পারে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে রীতিমতো রসসিক্ত মেজাজে খুঁটিনাটি জানার ছুতোয় বেদান্তর বংশপরিচয় ভুলিয়ে দেবে।
নানান গালগল্প তৈরি হয়ে বাতাসে ভাসবে। এমনিতেই মেয়েমহলে বেদান্তকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। নতুন করে ঝামেলা পাকাবার কোনো মানেই হয় না।
কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েটির বয়স খুব বেশি মনে হয় না। হার্ডলি সাতাশ-আটাশ হতে পারে।
অনেকটা রাণী মুখার্জ্জীর মতো হেজি কিন্তু অসম্ভব মাদকতাময় কণ্ঠ। এমন যার কণ্ঠস্বর তার সঙ্গে প্রতিদিনই কিছুক্ষণ সানন্দে কথা বলা যায়। সে সময়ে হাতে হুইস্কির গ্লাস থাকলে তো কথাই নেই! কিন্তু মেয়েটি অন্য কথায় রাজিই নয়। দেখা করতে চায় শুধু। সমস্যাটা এখানেই।
কোন মেয়ে চাইলেই তার সঙ্গে হুট করে দেখা করা যায় না। বেদান্ত একটা বিখ্যাত দৈনিকের সিনিয়র নিউজ এডিটর। দুর্দান্ত কলম লেখে। প্রতিটি লেখা পড়েই বন্ধুরা বলে, ফাটিয়ে দিয়েছিস! কিন্তু কি ফাটলো, কার ফাটলো, কোথায় ফাটলো সে সব খবর রাখার চেষ্টা বেদান্ত করে না। প্রতিদিন কলম দিয়ে ফাটানোই তার কাজ।
ফাটাতে না পারলে ওর কোনো দামই থাকবে না কাগজে। সমাজের উচ্চকোটির ক্ষমতাবান হাইফাই শুয়োরগুলো পর্যন্ত প্রায়ই ফোন করে একই কথা বলে---ফাটিয়ে দিয়েছেন মশায়! বেদান্ত পরের অনুচ্চারিত কথাটাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পায়--'দেখবেন ভাই, আমাকে যেন ফাটাবেন না!'
বেদান্ত চাইলে সল্টলেকে পছন্দের একটা প্লট বা ফ্ল্যাট পেতে পারতো। প্রকাশ্যে পুরোহিত সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ খারাপ পাড়ায় মদের ঠেক চালাচ্ছে এমন কিছু দু'নম্বরী বোয়ালকে বেদান্ত চেনে, যাদের সঙ্গে হাইফাই রাঘববোয়ালের গোপানে নিত্য ওঠা বসা। এরা তাকে সেবা করার জন্যে এক পায়ে রাজি। কিন্তু এদের সেবা নিলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট কথা বলার ক্ষমতা কমে আসবে।
কষ্ট হবে। প্রেসার নেমে যাবে হু হু করে। বেদান্ত এখন আর কিছুতেই নিজেকে বিক্রি করে দিতে পারবে না। বন্ধুরা তাই প্রায়ই বলে--'হেলায় যে কী হারাচ্ছিস খোকা এখন টের পাচ্ছিস না। কোমর বেঁকে গেলে বউ যখন তোকে বেদম ফাটাবে তখন বুঝবি!'
বেদান্তর বউ শ্রাবণী বুঝে গেছে একটা নির্ভেজাল রামছাগলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে।
প্রথম প্রথম আকাশের চাঁদ-তারা দেখতে দেখতেই একমাত্র সন্তানের (মেয়ে) জন্ম হয়ে গেল। দু'চার বছর বাচ্চার হ্যাপা সামলাতে সামলাতে সংসারে অনেকটাই জড়িয়ে না গেলে শ্রাবণী নতুন করে জীবনটাকে আবার অন্যখাতে ভাসিয়ে দিয়ে শুরু করতে পারতো। এখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সারাদিন হিজিবিজি লেখা আর কমোডে বসেও যার বই পড়াটাই জীবনের প্রধান কাজ এ যুগে তাকে রামছাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না।
বেদান্ত নির্ভেজাল পরিচ্ছন্ন, যা রোজগার করে তাতে তিনজনের সংসার দিব্যি চলে যাওয়ার কথা।
কিন্তু শ্রাবণী তা মনে করে না। একবিংশ শতাব্দীর জীবন একেবারে অন্যরকম, অন্যধারার জীবন। একটা শতাব্দীর পাঁচিল উঠে গেছে মাঝখানে। হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। শ্রাবণী টাইট জিনস্ আর টাইট স্লিভলেস গেঞ্জি পরে ডিস্কোতে যায়।
একটু মোটা হয়েছে বলে ইদানীং জিমেও যাচ্ছে! শ্রাবণীর বয়স এখন আটত্রিশ। শরীরেও সময় কমে আসছে। উগ্র রঙ দিয়ে সময়কে প্রাণপণে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টায় সে বড় ব্যস্ত। বেদান্ত'র বস্তাপচা আদর্শে সেঁটে থাকলে জীবনটাকে এনজয় করবে কবে?
মেয়ে টুয়ার বয়স ষোল। সে-ও কেমন যেন বালাজি টেলিফিল্মের সিরিয়াল মার্কা টিনএজারের কার্বনকপি হয়ে উঠছে।
মাঝে মাঝে বেদান্ত নিজের আত্মজাকেই চিনতে ভুল করে।
শুধু সাংবাদিকতাই নয়, গল্প-উপন্যাসের বাজারেও বেদান্ত'র বেশ নামডাক। শ্রাবণী তাই বেদান্ত'র পিঠে নিজের উপচে পড়া আটত্রিশের ধাক্কা মেরে প্রায়ই বলে থাকে--'এইসব খেল-খিলাড়ি মার্কা গপ্পো-উপন্যাসই প্রমাণ করে তুমি তলায় তলায় কি পরিমাণ অন্য ঘটির জল টানো!'
শ্রাবণীর ভাষা শুনে বেদান্ত থ' হয়ে যায়। এসব একবিংশ শতাব্দীর হাইটেক ল্যাঙ্গুয়েজ এরা অনর্গল কি করে বলে যায় কে জানে! কখনো কোনো অভিধানের পাতা ওল্টানোর প্রয়োজন হয় না এদের। অথচ বেদান্ত'র টেবিলে খান দশেক নানান সাইজের অভিধান ছাড়া চলেই না।
জুতসই একটা শব্দের সন্ধানে সে এখনো প্রায়ই অভিধানের পাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শ্রাবণী তখন অনায়াসে অভিধানের সাহায্য ছাড়াই কত সহজে বলে যাচ্ছে--খেল-খিলাড়ি, অন্য ঘটির জল টানো--এই ধরণের সব টপোরিবাংলা কথা!
অবশ্য এসব ঝড়-তুফান ইদানীং খুব একটা বেশি সহ্য করতে হয় না। শ্রাবণী মেয়ে টুয়াকে নিয়ে প্রমোটার বাবার কাছেই মাসে বিশ-পঁচিশ দিন বসবাস করে। বেদান্ত ভাবে একটা ঝাঁ-চকচকে ফাঁপা আবাসন ধসে গেলেই কেল্লা ফতে! সেদিনও বেদান্ত কলম বাগিয়ে দারুণ ফাটাবে। সেদিন মনে হয় তার একটা অভিধানও দরকার হবে না।
বিকেল ঠিক পাঁচটায় বেদান্ত নিজেই এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে সবে বিবিসি খুলে টিভির সামনে বসেছে। কাচের টেবিলে রাখা মাল্টি-মিডিয়া মোবাইলের নীলাভ আলো জ্বলে উঠলো। 'হ্যালো' বলতেই সেই মাদকতাময়ীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো!
--কি ঠিক করলেন, আমার সঙ্গে দেখা করবেন না?
--আপনি দেখছি অসম্ভব জেদি মেয়ে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি সত্যিই এখন টেনশন ফিল করছি। এনিওয়ে, বলুন কোথায় দেখা করতে চান?
--বলছি।
তার আগে আমার নামটা আপনাকে জানাই। যদিও আমাকে অবাক করে এতদিনেও আপনি আমার নামটাই জানতে চান নি।
--আসলে আপনার ব্যাপারটাই এত অদ্ভুত যে, আমার ঠিক--
--আমার নাম বিদিশা। বিদিশা সেন। পাঁচ ফুট সাত।
চৌত্রিশ-আঠাশ-ছত্রিশ। গায়ের রঙ গোল্ডেন ইয়েলো। কোমর পর্যন্ত ঘন কালো চুল। আমার চোখ-মুখ-নাক-ঠোঁট-চিবুক নিয়ে আকাশছোঁয়া অহঙ্কার আছে। শাড়ি ছাড়া অন্য কিছুতে আমাকে বিদিশা বলে মনে হয় না।
--কিন্তু এতসব ডিটেইলস্ আমাকে কেন?
--বলার প্রয়োজন আছে। আমি ফিলসফিতে এমএ করেছি। দু'বার আমেরিকা, বেশ কয়েকবার বৃটেন এবং একবার করে ফ্রান্স-কানাডা-জার্মানী-ইটালি ঘুরে এসেছি বাবার সঙ্গে।
কফির কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেল বেদান্ত। বিদিশা যা বলছে তা হয়তো সবই ঠিক।
কিন্তু যেভাবে বলছে তাতে বেদান্ত'র বিস্ময়ের পারদ চড়ে যাচ্ছে হু হু করে। মেয়েটার কোনো মেন্টাল প্রবলেম নেই তো? বেদান্ত শুনে যাচ্ছে চুপচাপ।
(আবার অগামী কাল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।