বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে নজরুল অধ্যয়ন বিষয়ে পূর্ব নির্ধারিত বরাদ্দকৃত নাম্বারগুলো হচ্ছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০; রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে ৫০ এবং ১০০। অন্যগুলো ঠিক থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতে পরিবর্তন এনেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিষয়ক অধ্যয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৪ নাম্বার। বাংলা বিভাগ মাত্র দু’দিনের নোটিশে জরুরী সভার মাধ্যমে এটা অনুমোদন করেছে। [ প্রথম আলো ২৫ মে, ২০১২]
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্তকে নিছক ‘নজরুল অবজ্ঞা’ ভেবে ক্ষ্যান্ত দিতে পারছিনা।
অবশ্যই এর মাঝে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গভীর ষড়যন্ত্র প্রোথিত রয়েছে। এমন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ আমার অগাধ বিশ্বাসের কারণও যথেষ্ট ভাববার মতো। প্রথমত, সাহিত্যের মান বিচারে নজরুলসাহিত্য অনন্য, অতুলনীয়। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্য- সবক্ষেত্রেই তাঁর আধিপত্য উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয়ত, বিশ্বসাহিত্যের যে স্তরে নজরুলপ্রতিভা বিরল; তা হচ্ছে, প্রতিবাদী এবং জাগরণীমূলক কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস রচনায়।
এক্ষেত্রে তো ওয়াল্ট হুইটম্যান, দস্তয়ভস্কি এবং নাগিব মাহফুজের চেয়েও নজরুল অধিক সৃষ্টিশীল। তৃতীয়ত, নজরুল ছিলেন বিশ্বসম্প্রদায়ের কবি। গণমানুষের কবি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে- সব জাতির কবি। অসাম্প্রদায়িক কবি।
এখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও নজরুল ছাড়িয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানরা অতোটা আপন ভাবতে না পারলেও সব বিধর্মীরা ঠিকই নজরুলকে কাছে টেনে নিতে পারে। নিজেদের ভাবতে পারে। অবশ্য ধর্মভেদে এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রেক্ষিতে নজরুল নিজেকে মসজিদের পাশে নিয়ে গেছেন। বর্তমান ‘রোহিঙ্গা ইস্যু’ আবারো অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বিশ্ববাসিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
চতুর্থত, যে বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। নজরুলের কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাসÑ সবকিছুর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শোষণ-বঞ্চনা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসনসহ সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়। এই নজরুলই রাজসিংহাসনের সাহিত্যকে সাধারণ কাতারে নিয়ে এসেছেন। নজরুল তার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা দিয়েছেন। মিথ্যে নয়; এটাই পরম সত্য যে, কোনো রাজনীতিবিদ ননÑ একজন বিদ্রোহী কবি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ডাক দিয়ে কারাবরণ করেছেন।
বর্তমান বাংলা বিভাগের ছাত্র তথা ভাবি সাহিত্যিকদের এমন কালজয়ী এবং প্রয়োজনীয় সাহিত্য থেকে দূরে রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।
নজরুল এক বিশাল সাহিত্যসম্ভার। বাঙালি জাতির জীবনে এমন কোনো অনুষঙ্গ নেই- নজরুলসাহিত্য যে বিষয়ে আলোকপাত করেনি। এমনকি তাঁর বিপ্লবী সাহিত্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও প্রেরণার উৎস ছিল। সর্বদা সব প্রেক্ষাপটে তাঁর সাহিত্য থেকে আমরা দীক্ষা লাভ করতে পারি।
তাই নজরুলসাহিত্য থেকে ছাত্রদেরকে দূরে রাখা কখনোই উত্তম উদ্দেশ্যে হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সম্মানিত শিক্ষক যোবায়ের আল মাহমুদ এভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন, ‘নজরুল বিষয়ক পাঠদান সঙ্কুচিত করাকে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে চেতনাহীন করার এক গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কেননা নতুন প্রজন্মকে নজরুলের সাহিত্য অধ্যয়ন থেকে বঞ্চিত করার মানে হচ্ছে তাদের সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং বৈশ্বিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণালাভ থেকে বঞ্চিত করা; নজরুলের সাহিত্যপাঠ থেকে বঞ্চিত করা মানে হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে সামাজিক শোষণ-নিপীড়ন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী চেতনা ধারণ করা থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা করা। এদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নজরুল চর্চা আরো বেশি জরুরী ও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সীমান্তে আজ চলছে ভারতীয় বাহিনীর নিয়মিত আগ্রাসন-হত্যা-নির্যাতন; সাগরের তেল গ্যাস এবং বন্দর দখল করতে মরিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি; অসম চুক্তির মাধ্যমে দেশের খনিজ সম্পদের অধিকাংশ মালিকানা কুক্ষিগত করে তা লুট করার চেষ্টায় রত বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন, কনোকোফিলিপস, অক্সিডেন্টাল, স্যান্টোস, কেয়ারনস, তাল্লো।
উন্নয়ন সহযোগিতার নামে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কঠিন শর্ত এবং তথাকথিত আত্মঘাতী সংস্কারের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক পুঁজি এবং বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের রাজনীতিকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সম্পূর্ণ করায়ত্তে নিয়ে এসে এ দেশকে তাদের নয়া উপনিবেশ বানানোর চক্রান্ত আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বৈশ্বিক পুঁজির অবাধ বিকাশের জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে আমাদের বাজারব্যবস্থা, উৎপাদন, বিপণন, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ- সবকিছুই বহুজাতিক কোম্পানির অবাধ লুটপাটের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় দরকার নজরুলের সাহিত্যপ্রসূত বিদ্রোহী এবং বিপ্লবী চেতনার বিকাশ, যাতে করে তরুণ প্রজন্ম সাম্রাজ্যবাদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং তার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করতে পারে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্ব। কেননা তাঁর অগ্নিঝরা ক্ষুরধার লেখনী শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনতার অধিকার আদায়ে উচ্চকিত হওয়ার শিক্ষা দেয়।
’
বাংলা বিভাগের এই পাঠ্যক্রমে গীতিকাব্য অধ্যায়ে নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’, কবিতা অধ্যায়ে ‘বিদ্রোহী’, প্রবন্ধ অধ্যায়ে ‘রাজবন্দির জবানবন্দী’ এবং ছোটগল্প অধ্যায়ে ‘পদ্মগোখরো’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নজরুল ইসলামের সুবিশাল রচনাভাণ্ডারকে তুলনায় আনলে এটা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এই পাঠ্যক্রমে জাতীয় কবিকে একরকম উপেক্ষা করা হয়েছে। এধরনের হঠকারী ও অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত আমাদের জাতীয় কবির প্রতি অবমাননা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্যার যোবায়ের আল মাহমুদ অধিকতর গ্রহনযোগ্য যে কথাগুলো লিখেছেন-‘যথাযথভাবে নজরুল সাহিত্যপাঠের প্রতি তাদের বিরাগ থাকতে পারে, যারা মনে-প্রাণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি দায়বদ্ধ এবং তাদের সেবাদাস হিসেবে যারা কাজ করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেন না এবং নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ-¬নিপীড়নকে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতা দেয়ার কাজে লিপ্ত। সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, বিশেষকরে বিশ্বব্যাংকের উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলপত্র বাস্তবায়ন প্রকল্পের (Strategic Plan for Higher Education in Bangladesh 2006-2026) মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা কাঠামোকে উত্তর ঔপনিবেশিক নিওলিবারেল পলিসি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে, তারই একটি অংশ হিসেবে নজরুল অধ্যয়নকে সঙ্কুচিত করার এই পদক্ষেপকে দেখা যেতে পারে।
নিওলিবারেল পলিসি হচ্ছে, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পোস্টকলোনিয়াল হেজেমনিক (hegemonic) তত্ত্ব যা মূলত শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতি এবং সমাজনীতিতে এমনসব চিন্তাধারার প্রবর্তন ঘটাতে চায়, যেন আমাদের নিজস্ব বিপ্লবী চিন্তাপদ্ধতির বদলে আমরা আপসকামী নীতি অনুসরণে নিমগ্ন থাকি। নিওলিবারেল পলিসির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাকাঠামোতে পাঠ্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে হচ্ছে, যাতে করে শিক্ষাক্ষেত্রগুলো হয়ে ওঠে বৈশ্বিক পুঁজিবাদী চেতনা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রভূমি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের (Cultural imperialism) বিকাশের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের মন ও চেতনাকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তারা বৈশ্বিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। নজরুলের সাহিত্য অধ্যয়ন যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী এবং পুঁজিবাদী শক্তির চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেহেতু এই অধ্যয়নকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী নিওলিবারেল পলিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। ’ উল্লেখ্য, বিষয়টি নিয়ে বাংলা বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষক মৌখিক ও লিখিত আপত্তি জানিয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে এত অল্প সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি করে মাত্র দু’দিনের নোটিশে এই পাঠ্যক্রম অনুমোদন করাটাও রহস্যজনক বটে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রাখা উচিত ছিল। অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় নতুন পাঠ্যক্রম অনুমোদন করা হলো, তার মধ্যে স্বচ্ছতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমরা ঠিক বুঝলাম না, নজরুল সাহিত্যের পর্যাপ্ত অধ্যয়নের প্রতি এসব অধ্যাপকের এত বিরাগ কেন? এটা কি এজন্য যে, নজরুল আজীবন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন, সোচ্চার ছিলেন সর্বপ্রকার অসাম্য, সাম্প্রদায়িকতা এবং শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে? কার স্বার্থে এবং কিসের যুক্তিতে তারা এই হীন কাজটি সম্পাদন করলেন- বিষয়টি আমাদের বোধের অগম্যই রয়ে গেল।
আমরা অবশ্যই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি, আমাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে জাতীয় চেতনাকে দুর্বল করা এবং আমাদের স্বাধীনচেতা মনোভাবকে নস্যাৎ করে দেওয়ার এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এটি।
এর তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ঢাকা ভার্সিটির বাংলা বিভাগের কাছে অতিদ্রুত তা পুনর্বহালের দাবি করছি। মাননীয় ভিসির কাছে বিষয়টি খতিয়ে দেখে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দানকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করার আহ্বান জানাচ্ছি। সর্বোপরি দেশের সব মহল থেকে এ ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চরম প্রতিরোধ আশা করছি। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, বিশেষ করে বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং ছাত্রসহ দেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নজরুল গবেষক, বুদ্ধিজীবী মহল এবং নজরুল ইনস্টিটিউটকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। সোচ্চার হতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।