দশের অগণণ সাধারণ মানুষ যখন তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নতুন করে বুক বেঁধেছেন, মিডিয়া ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যখন ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হিসেবে দেখছেন, তখন বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলছেন, এ নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন, গ্রহণযোগ্য নয়। দলকানা-জোটকানা ছাড়া কোনো মানুষই বোধহয় এ কথায় সায় দেবেন না।
দেশাš-রিত দুই ছেলের জন্য সব বেদনা বুকে চেপে রেখে খুব অল্প সময়ে বিপর্য¯- একটি দলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। রেডিও-টিভিতে তার নির্বাচনি ভাষণটিও ছিল সুচিšি-ত। অতীতের ভুল-ত্র“টির জন্য জনগণের কাছে একাধিকবার ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি ঐ ভাষণে।
তিন আসনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে এর সুফল খালেদা জিয়া নগদে পেয়েছেন।
তার মানে এই নয়, জনগণ নির্বোধ। ঢাকার একটি আসনে জননিন্দিত এক সাবেক সাংসদকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি, যার এবং যার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড-হামলায় জড়িত থাকার পুলিশি অভিযোগ আছে। এই সেদিনও বন্দি অবস্থায় এক জেল-কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেছেন ঐ প্রার্থী। ঐরকম অনেক প্রার্থীকেই এবার প্রত্যাখ্যান করেছেন ভোটাররা।
চারদলীয় জোটে তাদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে ভোটারদের সিদ্ধাš- গ্রহণে। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে দেশে নিত্যপণ্য ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তা দ্বিগুণ হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা নিু আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
যদিও দ্রব্যমূল্যের শিকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই, ঘরে-ঘরে নারীরাই তার প্রতিদিনের হিসাবরক্ষক। এবং এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা শুধু বেশিই নয়, উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। গণরায়ে এরও প্রতিফলন ঘটেছে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ আওয়ামী শাসনকালেও হয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে মতো নগ্ন ও ব্যাপকভাবে নয়।
নির্বাচনের আগের রাতে লাখ-লাখ টাকাসহ ধরা পড়েছেন যারা, তাদেরও সবাই বিএনপি-জামায়াতের কোনো না কোনো প্রার্থীর লোক। লেখা বাহুল্য, নির্বাচনি রায় প্রদানে জনগণ এবার দুর্নীতিকেও ফ্যাক্টর হিসেবে নিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, পূর্বাপর সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে, সঙ্গত কারণেই, গণরায় চার দলীয় জোটের বিপক্ষে গেছে। অন্যদিকে দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি যখন গণদাবিতে রূপ নিয়েছে, বিএনপি তখন জোটগতভাবে ১৭ জন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে নির্বাচন করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ দূরে থাক, নির্বাচনি প্রচারণায় যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি খালেদা জিয়া।
উল্টো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ক্ষমতায় আনার অনুরোধ করেছেন জনগণকে। একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, এখনো যারা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার-অবজ্ঞা করে, তাদেরই দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কী রক্ষা করবেন খালেদা জিয়া, তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি। ফলে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীসহ জামায়াত ও জামায়াতের শীর্ষনেতাদেরই শুধু নয়, দলগতভাবে বিএনপিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে মানুষ। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম। ঢাকা ও সিলেট বিভাগে এ প্রত্যাখ্যান নিরঙ্কুশ।
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া তিনটি আসনে বিজয়ী হলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রায় সব সদস্যই এবার পরাজিত হয়েছেন। বিশ্লেষণে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু সব মহলই বলছেÑ ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই নির্বাচনি প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়া যা বলেছেন, তাকে মিথ্যাচার বললে অত্যুক্তি হবে না ।
নির্বাচনোত্তর প্রতিক্রিয়ায় অতীতচারণাও করেছেন খালেদা জিয়া। তুলে এনেছেন বাকশাল প্রসঙ্গ।
দুর্বল যুক্তি। দেশের মানুষ বাকশালকালে ফিরে যেতে মহাজোটের পক্ষে রায় দেননি। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ -মুক্ত একটি অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইছেন তারা বাংলাদেশকে। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বিজয় হিসেবেও দেখছেন। বাকশাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাঙালির মহত্তম নেতা শেখ মুজিবের দেশপ্রেম সকল বিতর্কের ঊর্ধে।
বাঙালিকে তিনি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের স্বপ্নই শুধু দেখাননি, তা বা¯-বায়নের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিপীড়িত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। এমনকি বাকশাল গঠনকালেও তার স্বপ্নের সবটাই ছিল সাধারণ মানুষকে ঘিরে। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত গভর্নরদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেনÑ
আপনারা লোকালি ঘুরতে থাকুন। আপনারা নৌকায় ঘুরুন, গাড়ি নিয়ে ঘুরুনÑ মানুষ যাতে শাšি-তে ঘুমাতে পারে।
যে থানায় চুরি ডাকাতি কমবে না, সেখানকার সরকারি অফিসারদের ডেকে কনফারেন্স করে বলুন, চুরি-ডাকাতি তোমাদের এরিয়ায় বন্ধ করতে না-পারলে তোমরা বিদায় হবে। সাফ সাফ কথা। রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে। তোমরা যারা ঐখানে আছো, তাদেরই এসব বন্ধ করতে হবে। সাবধান আপনাদের সবাইকে আমি এসব বলে রাখছি এখানে।
যারা এখানে আছেন, তাদের সবাইকে সাবধান করে রাখছি। আমি এ ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছি।
হোক বাকশাল প্রাসঙ্গিক, ওপরের কথাগুলো সাধারণ মানুষের চিরকালীন স্বপ্নের প্রতিফলন। প্রতিটি শব্দের মধ্যে আছে জনমন। জনস্বার্থে দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন মুজিব।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেনÑ
আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান, ওষুধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয় গ্রামের লোক এসব পারে না, নিশ্চয়ই আমার কৃষক ভাইয়েরা পারে না, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক ভাইয়েরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশি আছে, তারই ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার। আর বিদেশি এজেন্ট কারা হয়? নিশ্চয়ই আমার কৃষক নয়, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক নয়। আমরা যারা লেখাপড়া শিখি, গাড়িতে চড়ি, বিদেশে যাবার পারি, ভালো স্যুট পরতে পারি, তারই বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বিদেশের এজেন্ট হই।
না, যুদ্ধবিধ্ব¯- স্বাধীন দেশে শেখ মুজিব তার সেন্টিমেন্টকে পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেননি। কিংবা তাকে কার্যকর করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, তিনি ছিলেন অগণন সাধারণের নেতা। আর সেই জন্যই তাকে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছিল কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে। তাদের মদদ জুগিয়েছিল কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিমান।
ওদেরই উত্তরসূরিরা শোকের ১৫ আগস্ট নারকীয় বীভৎসতায় ঘটা করে নকল জন্মদিন করার বুদ্ধি দিয়েছিলো খালেদা জিয়াকেও। ২৯ ডিসেম্বর এমন অনেক রাজনৈতিক নষ্টতাকে ‘ধিক’ জানিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সুশাসন ও সুদিনের প্রত্যাশায়। নির্বাচনোত্তর প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়া মানুষের সেই প্রত্যাশাকে অসম্মান করেছেন। অথচ দুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণের রায় মেনে নেবে বিএনপি।
গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, এ লেখাটি যখন লিখছি তখন পর্যš-, নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেনি বিএনপি। না-করলেই বোধহয় ভালো করবে দলটিÑ জনগণের সেটাই প্রত্যাশা।
এবারের নির্বাচনি ফলাফল কোনো বিশেষ দল বা জোটের বিজয় নয়। এ বিজয় অগণন সাধারণের। এ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।
এ বিজয় অসা¤প্রদায়িক স্বপ্নের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে প্রশ্নশীল তরুণ-তরুণীদের মনে গেঁথে দিতে পারার জন্য সেক্টর কমান্ডার ফোরামকে ধন্যবাদ। ১৭ যুদ্ধাপরাধী প্রার্থী হয়েছিলেন চার দলীয় জোটের ব্যানারে। তাদের ১৫ জনই পরাজিত হয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-স্টাফপ্রধান এ. কে. খন্দকার।
বিজয়ের মাসে এ বড় আনন্দের খবর। আবার জনগণ এ কথাও জানে, ঋণখেলাপের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন প্রথমে তার প্রার্থিতা বাতিল করেছিল। পরে কমিশনের শুনানিতে কিংবা আদালতের রায়ে তিনি তা ফিরে পেয়েছিলেন। আশা করি, সাংসদ হিসেবে কাজ শুরু করার আগে এ ব্যাপারে সবধরনের সন্দেহের অবসান ঘটাবেন তিনি। দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়ে যারা নির্বাচনে প্রার্থী ও বিজয়ী হয়েছেন, তাদের কাছেও একই ধরনের জবাবদিহিতা আশা করে মানুষ।
জঙ্গিবাদের উত্থানে মূলধারার অগণন সংস্কৃতিকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষকে গ্রেনেড-বোমার মধ্যে ফেলে বিদেশ পালিয়েছিলেন হাসান ইমাম। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণামাত্রই, তাকে সুধাসদনের চাতালে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। ফুলের তোড়া হাতে নবনির্বাচিত সাংসদদেরও। আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারগঠনের আগেই পদ-পদবির আকাক্সক্ষায় দলকানাদের তৎপরতাও শুরু হয়ে গেছে। তবে যে প্রশংসাটি না করলেই নয়, আগাম সতর্ক-বার্তার মাধ্যমে বিজয়োল্লাস থেকে দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরত রাখতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।
এবং এখন পর্যš- ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর সহিংসতার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি দেশের কোথাও।
ক্ষমতার প্রেক্ষাগৃহে ফুলের তোড়াহাতে দেখতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেননি ভোটাররা। নির্বাচনের পর সাংসদদের তারা, সুধাসদনের আগে, নিজেদের পাশে পেতে চেয়েছিলেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় জনমন বোঝার দায়িত্ব এখন আওয়ামী লীগেরই বেশি। দলের কাণ্ডারি হিসেবে শেখ হাসিনার আরো বেশি।
এখনই কীসের ফুলেল শুভেচ্ছা? তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ঐ সব শুভেচ্ছা। মনে রাখার আছে, বিএনপি-জামাত অধ্যুষিত চার দলীয় জোট ক্ষমতাকালে এত বেশি দাপট দেখিয়েছিল যে, জনগণ ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন সেই ঘুরে দাঁড়ানোরই ব্রতকথা। আবার এও মনে রাখার আছে, জনগণ এত বেশি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে, ক্ষমতার ঘোড়া ফের লাগামছুট হয়ে যেতে পারে। শেখ হাসিনার সামনে আগামী পাঁচ বছর এক অগ্নিপরীক্ষা।
চাই, সে পরীক্ষায় পাশ করুন তিনি। তার দেওয়া অনেক প্রতিশ্র“তি বাতাসে ভাসছে। তার অর্ধেকও যদি পূরণ করতে হয়, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিকল্প নেই। সব কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই শুধু সেটা সম্ভব। ফুলের তোড়া সরিয়ে এখন তার সেই ভাবনাই ভাবা উচিত।
শেখ হাসিনার বিজয়োত্তর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সে-ভাবনার প্রতিফলন দেখে মানুষ আশ্ব¯-। শাšি- ও সুশাসনের স্বার্থে খালেদা জিয়ার দিকে সৌহার্দ্যরে হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় খুশিও। সে-হাত আš-রিক হলে এবং খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান না করলে মানুষের অনেক উদ্বেগ দূর হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।