আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার সুনীল আলোয় আমিঃ ৪র্থ সর্গ



ক. মানুষ হেঁটে যায় ভেসে যায় ,চলে হেলে দুলে। কখনও মুখ বন্ধ রেখে ভেবে যায়। আবার কখনও মুখ খুলে খুলে নিরবধি কথা বলে যায়, মন ছোটে কল্প লোকে নিজ বাসভূমে,ভাষায়। সবুজ নীলে তুষার বিবর্ণে মিলে মিশে হয়ে যায় একান্ত একাকী। শুধুই বিবাগী।

শুধু শিল্পীর মাঝেই বিবাগী মন লুকিয়ে থাকে। হোক সে কলম শিল্পী,সুর শিল্পী,কন্ঠশিল্পী, তুলি শিল্পী,অভিনয় শিল্পী বা আবৃত্তি শিল্পী। এই বিবাগী মনই তাকে সৃষ্টিশীল করে। পাথর কেটে কেটে নিয়ে যায় ঝর্ণার উৎস ভূমিতে। ঝর্ণার অবিরল ধারায় স্নাত হতে হতে এক সময় সে অবিকল শিল্প স্রষ্টা হয়ে যায়।

তখন সে আর নিজের একার থাকেনা। শত চেষ্টা করেও সে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। সবার চোখে সে হয়ে ওঠে আকাশের উজ্জ্বলময় তারা এবং সবার মনে সে ঠাঁই পায়। সমাজের প্রতি অনেক দায়িত্বও তাঁর কাঁধে বর্তে যায়। খ. মা ও দেশ এই শব্দ দু’টি আমার মনের কুঠুরীর সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গাটিতে ছুঁয়ে আছে।

একাত্তর,স্বাধীনতা যুদ্ধ,বিজয় এবং আমি কতকগুলোন ধারাবাহিক যোগসূত্র। ডিসেম্বরের ১৬ই তারিখ ২০০৮ আমাদের ৩৭তম বিজয় দিবস গেল। গড়িয়ে গড়িয়ে ৩৭টি বিজয় দিবস। তার মধ্যে ২১টি বিজয় দিবস দেশ ও মায়ের সাথে,প্রিয় মুখগুলোকে সঙ্গে করে জয়ের স্ফুলিঙ্গ পতাকা হাতে নিয়ে পালন করেছি। অবলোকন অবলোকনে প্রায় একুশটি বছর স্বাধীনতা উত্তর দেশের মাটিতে ছিল আমার শরীর ও মননগত উপস্হিতি।

অন্যগুলো ছিল শুধু মননে। মননগত উপলব্ধিতে ধরে রেখেছি দেশ ও মা কে। কল্পলোকে তার ছোঁয়া অন্তর গহীনে। মা দেশ, দেশ মা একের ভিতরে অন্য। এ দু’টি সত্ত্বা আসলে এক ও অভিন্ন।

এই দুটো সত্ত্বার মধ্যেই আমাদের বেড়ে ওঠা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। দুটো সত্ত্বার আলোয় বেড়ে না উঠলে একটি মানুষ অসর্ম্পূণতায় অতৃপ্ত থেকে যায়। আমি ক্রমশঃ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছি আমার বাংলা সবুজ দেশ ও মায়ের আশির্বাদের জলধারা বিহীন,আদর বিহীন,নদীর মতন কলকলিয়ে কথা বলা বিহীন। এ এক গভীর নিঃশব্দ যন্ত্রনা। এই পরবাসে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ হয় দৃঢ়তাহীন, ঢিলেঢালা আকর্ষণ বিহীন।

নিজ মাটিতে হেঁটে যাওয়া,বয়ে যাওয়ার সাবলীলতা হোঁচট খায় পরবাসে। রক্ত স্নাত হয়ে পাওয়া বলবার ভাষা মা বুলি বাংলা হয় দূর অর্ন্তলীন। মেট্রো-বাসে,পিচঢালা রাজপথে, অফিস-আদালতে, দোকান পাটে বোঁজু বোসোঁয়া অথবা হ্যালো, হাই বাই ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দে শব্দে বাক্যে বাক্যে ঠাসা। বলি,আমি ও বলি। বলতে বাধ্য।

ভাঙ্গা ভাঙ্গা আধো আধো ইংরেজী ফরাসী বলি। দুটো ভাষারই আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি স্বীকার করে বলছি-আমার ভাষার মত মিষ্ট মিষ্ট সুর সুর শিল্প সৃষ্ট লাগেনা আর অন্য কোন ভাষায়। মনে পড়ে মন্ট্রিয়লের ক্রিয়েঁজো ষ্টুডিওতে আমি ও আমার বন্ধু আবৃত্তির ক্যাসেট বের করার জন্য রেকডিং করছিলাম, ফরাসী ভাষী ষ্টুডিওর মালিক বেনোয়া বলেছিল- মনে হয় তোমরা গান করছো! এরকম বহুবার শুনেছি বিদেশ ভাষা ভাষীর ঠোঁট থেকে। ভাল লাগার সুখ সুখ অনুভুতিতে মনটা ভরে গেছে,ছেঁয়ে গেছে অর্ন্তলোকে পূর্ণিমার আলো। বহু চর্চায় চর্চায় বাংলা শব্দ গুলোকে বাক্য গুলোকে নিজ ঠোঁটে শুদ্ধ অবয়ব দিতে চেষ্টা করেছি,আন্তর্জাতিক ইংরেজীকে পাত্তা দিইনি।

সম্পুর্ণ মনোগত শ্রম ঢেলে দিয়েছিলেম বাংলা ভাষায়-এই আশায় আমি আমার ভাষা শুদ্ধ,স্পষ্ট সাবলীল ধারায় কলকলিয়ে বলবো পড়বো লিখবো। নিজ মুখ গহ্ববরের সমস্ত জড়তাকে কাটাতে চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ধরণের পরিশীলন করে। নিজ ভাষা বলবার জন্য আমাকে কম কটাক্ষ শুনতে হয়নি নিজ বাসভূমে! কিন্ত তারপরেও আমি দমে যাইনি। আমি নাকি খুব বেশী বেশী শুদ্ধ ভাবে কথা বলি। এটা যেন আমার অপরাধ! নাটুকে,ন্যাকা এ গুলো ও কম বেশী জুটেছে।

সেই শিশু বেলা হতেই তিল তিল করে তৈরী করেছি আমাকে আমার ভাষা বলবার জন্য। ঠিক যেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মত। এই বাংলা ভাষার জন্যই বায়ান্ন থেকে একাত্তর বাংলার সবুজ ঘাস রক্ত স্নাত হয়েছে। প্রতিপক্ষ দ্বারা আক্রান্ত নিজ ভাষাকে মুক্ত করার জন্যেই বাংলার ভাষা প্রেমিকেরা রুখে দাঁড়িয়েছিল। ভাষাগত অধিকার আদায়ের চেতনাই ধীরলয়ে ভূমিগত অধিকার বোধের জন্ম দেয়।

যুদ্ধ হয় ভাষার জন্য,দেশের জন্য,স্বাধিকারের জন্য। সেই দেশের জন্য যে দেশের জন্যে আমাদের প্রতিটি নাগরিক হবে বাঙ্গালী, ভাষা হবে বাংলা। গ. যুদ্ধ, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ। পরিশেষে, ষোলই ডিসেম্বর। বিজয় অলংকারে শোভিত জ্বলজ্বলে একটি দিন।

মনে পড়ে বিজয় উৎসব মুখর দিনটির কথা। সেই দিনটিতে উৎফুল্ল আনন্দে ভরে গেছে মন। সেই ছোট্ট মনে ছোট্ট বয়সটিতে বুঝতে পেরেছিলাম স্বাধীনতার উদ্বেল ভাষা। নিজেকে মুক্ত শ্বেত পায়রা মনে হয়ে ছিল। মনে হয়ে ছিল দীর্ঘ নয় মাসের উদ্বিগ্নতার মুক্তি ঘটলো।

মুক্তি ঘটলো বাঙ্গালীর আর বাংলা ভাষার। সৃষ্টি হলো বাংলাদেশের। আমাদের বাঙ্গালীদের নিজস্ব রাষ্ট্র হলো। অধিকার পেলাম দৃপ্ত পদক্ষেপের। বিশেষ করে আমি আমিত্ব পেলাম।

সেই থেকে শুরু হলো আমিত্বের গভীরতায় যাত্রা। হেঁটে গিয়েছি আমার মাটিতে সুদীর্ঘ বাইশটি বছর। এসেছে ঝড়, এসেছে টর্ণেডো। তবু বেঁচে গিয়েছি সঘন আত্মবিশ্বাসে। আমার দেশ, আমার ভাষা, আমার লোক।

ভয় কি সেখানে? পরস্পর পরস্পরে বুঝবার মননশীলতা সেখানে। নিজ মাটি স্পর্শের সুখ অন্য মাটিতে মেলেনা। আমার মা নিজ পেলব মাটি আঁকড়ে আছেন আর বাবা শুয়ে আছেন পরবাসে খড় খড়ে শীতল মাটিতে যাকে দেখতে সচরাচর যাওয়া হয় না আমাদের। শরীরগত এখানে ভালোই আছি কিন্ত আত্মগত বিনষ্ট হচ্ছি বারংবার। যদিও বাঙ্গালী পরিমন্ডলে হেঁটে যাই তবু তা অন্য ভূমিতে।

অন্য ভূমিতে যত কিছুই থাকুক না কেন,নিজ ভূমির মতো মিষ্টি সুশীতল হাওয়ার মতো লাগে না কিছুই। আছি পরবাসে নিজের কাছে একান্ত অচেনা হয়ে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।