আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যদি মানুষ না হই তবে যেন আবার জন্ম নিই মানুষ হয়ে. . . সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন । সেই দিনটিতে, যেই দিনটিতে ঠিক ৫৮ বছর আগে চলে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কত বড় কবি ছিলেন কিংবা কত বড় কথাশিল্পী ছিলেন তার মূল্যায়ন তো এইরকম চট জলদি লেখায় করা যাবে না, করা সংগতও নয় । একজন শিল্পী-সাহিত্যিক নানা ভাবে আবিস্কৃত হন তাঁর মৃত্যুর পরে ,সুনীলের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটবেনা । কিন্তু একথা যদি বলি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাহলে বোধ করি বিতর্কের কোন যায়গা থাকেনা ।

অথচ একথাও তো ভুল নয় যে রবীন্দ্র কাব্যধারার বিরোধীতা করে ‘মধ্যরাতের কলকাতা শাসন’ অভিপ্রায়ী চার যুবকের একজন হয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়এর আবির্ভাব । ৬১-৬৫’র হাঙ্গরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা পেরিয়ে, গল্প উপন্যাসে অনাবশ্যক ও গা ঘিনঘিনে যৌনতা প্রকাশের পথ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক বা বাঙালি মননের বিবেক হয়ে উঠলেন কি করে সেটাই বিস্ময়কর, অন্তত আমার কাছে । আসলে সময় ও সমাজের দ্বান্দিক পরিবর্তনের পর্যায়গুলিতে তিনি নিজেকেও পরিবর্তীত করেছেন তাঁর ষাট বছরের সাহিত্য পরিক্রমায় । নিজেকে পরিবর্তীত করার প্রক্রিয়াই তাঁকে আজকের যায়গায় নিয়ে এসেছে । আর সেই পরিক্রমার পরতে পরতে সময় ও মানুষকে চেনা ও নিজেকে ঢেলে নেওয়া ।

সেই পরিক্রমায় উনিষ শতকে বাংলার নবজাগরণ , বাংলার সমাজ ও বাঙালি জাতীসত্তার আবেগ – অভিমান,দেশ বিভাগের যন্ত্রণা এবং রবীন্দ্রনাথ এমনকি সত্তর দশকের বাংলাও ছায়াপাত ঘটিয়েছে তাঁর সৃজনে । রবীন্দ্র কাব্যধারার বিরোধীতা করেই তাঁরা মানে সুনীল, শক্তি, শরৎ কুমাররা এসেছিলেন বাংলা কাব্য ক্ষেত্রে ঝড় তোলার লক্ষ্য নিয়ে । কবিতার জন্য ‘অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’ বলে শুরু করলেন ‘কৃত্তিবাস’ মধ্য পঞ্চাশে । অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত প্রেমেন্দ্র মিত্রদের ‘কল্লোল যুগ’ও শুরু হয়েছিল ত্রিশ এর দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে । সেই ‘পথ’ তাঁদের আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিলোনা – থাকেনও নি বেশিদিন ।

সুনীলরাও পালটালেন । সুনীল গদ্যে এলেন এবং বলা যাক সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধেই হাঁটা শুরু করলেন । ১৯৬৫তে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ । এই ষাটের দশকেই বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রের কয়েকটি ঘটনা নিশ্চিত ভাবেই তখন ৩১ বছরের যুবক সুনীলকে প্রভাবিত করেছিল । ১৯৬১তে ‘বিটি রোডের ধারে’ ‘গঙ্গা’র মত উপন্যাসের লেখক, ‘মানুষ রতন’এর মত গল্পকার, পীড়িত মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখা কথাকার সমরেশ বসু লিখলেন ‘বিবর’।

প্রাতিষ্ঠানিক আলোচকরা যাকে চিহ্নিত করলেন ‘বাংলা সাহিত্যের মাইল ফলক’ বলে’ । মাইল ফলক ! আর এই পথ বেয়েই ‘প্রজাপতি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাতভ’র বৃষ্টি’, সাহিত্যে শ্লিলতা- আশ্লিলতার প্রশ্নে আলোড়ন ইত্যাদি । ১৯৬০এ জার্মান বীট কবি এলেন গিনসবার্গ পাটনা বেনারস কলকাতা ঘুরে গেলেন । ১৯৬১তে শুরু হল হাংরি জেনারেশন আন্দোলন । মাত্র চার বছর স্থায়ী হয়েছিল এই আন্দোলন ।

সুনীল , শক্তি, বিনয় মজুমদার, উৎপল বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা হাংরি দর্শনেই প্রভাবিত হয়ে তাদের কাব্যজীবন শুরু করেছিলেন । সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’ অবশ্য ঘোষণা করেছিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেও তাঁর অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়েছিলেন “আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে),আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৪ তেই হাংরি সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন । বিনয় মজুমদার, উৎপল বসুরাও মূল স্রোতে ফিরে বাংলা কাব্য জগতকে দারুণ সমৃদ্ধ করলেন ।

স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ – ষাট - সত্তর দশকের সময় কালটা বাংলার সমাজ জীবনের এক ক্রান্তিকাল বলেই চিহ্নিত । একদিকে তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধী গণ আন্দোলন যাকে আরো তীব্রতর হওয়ার রসদ যোগাচ্ছিল সেই সময়ের সাহিত্য, নাটক । এবং ৬৯’এ তরাই’এর নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ । যে সময়কালে কবিতা- গল্প- উপন্যাসে মানুষ কান পেতে আরো বেশি ‘সময়ের প্রতিধ্বনি’ শুনতে চাইছে , তখনই ১৯৬৫তে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’এ সুনীল সেই সময়ের যৌবনের বর্ণনা দিলেন এইভাবে ...“ফ্রীস্কুল স্ট্রীট, সোনাগাছি টালিগঞ্জের ধাপে ধাপে নেমে আসা বেশ্যার দল, ভাঙ্গা টিউবওয়েলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা মদের বোতল – এসবের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে শক্ত ও খাঁটি করে তুলবো” ; এই জীবন দর্শন সেই সময়ের সত্যনিষ্ঠ বাস্তব ছিলনা । সেই জন্যই বলেছি প্রথম উপন্যাসে সুনীল সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা শুরু করলেন ।

তারপর অনেকটা পথ পরিক্রমা । সময়ের সঙ্গে নিজেকে ঢেলেছেন সুনীল । আমরা যারা সেদিনের কুড়ি বাইশের তরুণরা মোটেই সুনীলকে পছন্দ করতামনা । সুনীল কিন্তু বদলালেন এবং সেই বদলে যাওয়া সুনীলকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হ’লনা । হয়ে উঠলেন নতুন বাংলা গদ্য ধারার অবিসংবাদি পুরোধা , নবীন প্রজন্মের কবিদের নিশ্চিত ভরসা স্থল, হয়ে উঠলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ও এপার-ওপার মধ্যবিত্ত বাঙালি মননের অভিভাবক ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।