আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে -
জীবনানন্দের “কুড়ি বছর পর” কবিতাটি শাহেদ আজ বার বার মনে মনে আবৃত্তি করছে। জীবনানন্দ এই কবিতাটি তার জন্য লিখেছে। ঠিক ঠিক কুড়ি বছর পর তার সাথে দেখা হবে মুনিয়ার। এভাবে মিলে যায় কখনো!! কোন কবিতার লাইন!!
হয়তো মিলে যায়। কিন্তু শাহেদের এই ৪৫ বছর বয়সে কোন গল্প কিংবা কবিতা তার জীবনের সাথে মিলে যায় নি।
কিন্তু এখন কিভাবে যেনো মিলে গেছে!! একদম শেষ যেদিন মুনিয়ার সাথে দেখা হয়। সেদিন মুনিয়া কান্না ভরা কন্ঠে বলে, একটা কবিতা শোনাও না.......
তখন শাহেদ চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করে চলেছিল।
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে -
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন স্বন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে।
..............................................................
...................................................
এভাবেই পুরো কবিতা শুনিয়েছিল শাহেদ। আসাধারণ মগ্নতা ছিল সেদিন।
আবেগে অনুভুতিতে সে হারিয়ে গিয়েছিল। আর মুনিয়া তার হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল।
শাহেদ তাকায় মুনিয়ার দিকে।
- তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?
মুনিয়ার কান্নাটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
মুখ তুলে তাকায় শাহেদের দিকে।
শাহেদ আবার প্রশ্ন করে, আমাকে তুমি ভুলতে পারবে?
মুনিয়ার চোখে তখন পানি টলটল করছে। শাহেদের হাতটি ছেড়ে দেয়। তারপর বলে, যতদিন নিজের দিকে তাকাবো ততদিন আমি তোমাকেই দেখতে পাবো।
হো হো করে হেসে উঠে শাহেদ।
- এবসার্ট।
ফুল্লি এবসার্ট। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। অন্য পুরুষকে বিয়ে করবে আর বলছ আমাকে ভুলতে পারবে না!!!
প্রেম! বড় আজব সম্পর্ক। দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাদের। দীর্ঘ বলতে পাঁচ বছর।
হয়তো দীর্ঘ নয়। কিন্তু সে যুগের জন্য পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ একটি সময়। যাকে বলে কৈশর প্রেম। সেই কৈশর প্রেম থেকে পরিণত বয়স। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ থেকে প্রেম।
যার স্থায়িত্ব ছিল ভার্সিটির শেষ বর্ষ পর্যন্ত। হঠাৎ একটি দমকা হাওয়া বইলো তাদের উপর দিয়ে। যা তাদের পুরো সম্পর্কটাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলল। সেই শেষ দেখায় পুরো সমঝোতার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কটির শেষ হয়। শেষ দেখার আগেই তাদের সম্পর্কটার ইতি হয়ে যায়।
কিন্তু হঠাৎ একদিন মুনিয়া তার বান্ধবী কে দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলে, একবার দেখা করো। একবার।
সেই চিঠি শাহেদকে উত্তাল করে তোলে। মুনিয়ার প্রতি সমস্ত ক্ষোভ বরফের মতো গলে পড়ে। আর শুরু হয় অপেক্ষা।
কবে দেখা হবে। কবে!!
দেখা হলো। কথা হলো। মুনিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এক জাপান প্রবাসী ছেলের সাথে। ছেলে উচ্চ শিক্ষিত।
প্রতিষ্ঠিত। শাহেদের মতো বিশৃঙ্খল জীবন নয়। অজানা কোনো জীবন নয়। শাহেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা শেষ বর্ষের ছাত্র। বাংলা.. এটা কোনো সাবজেক্ট হলো!! মুনিয়ার মা বলত।
আসলে ওনার কারণেই সম্পর্কটা শেষ করতে হয়েছে। বাংলা পড়ে ও কি করবে? কোনো ভবিষ্যত আছে? ফুলিশ লাইফ।
শাহেদ খুব লেখালেখি করতো। কখনও কোনো গল্প কোথাও ছাপে নি। তারপরও গল্প লিখতো।
মুনিয়া তার মাকে বলত, দেখো মা, শাহেদ একদিন অনেক বড় লেখক হবে।
মা বলতো, হলে হবে। যার কোনো গতি নেই সেই তো লেখক হয়। যত্তসব মিথ্যাচারিতা। ঐ মিথ্যুকটার দারা গল্প ছাড়া আর কিছু হবে নাকি!
মুনিয়ার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে যেতো।
শাহেদ খুব ভালো লেখে। এটা ওর ক্রিয়েটিভিটি। মানুষের ক্রিয়েভিটি নিয়ে কখনও কোনো কথা বলতে নেই। এটা ঈশ্বর প্রদত্ত।
মুনিয়া আর কথা বাড়াতো না।
তো, এই বাংলায় অনার্স পড়া একটা ছেলের থেকে জাপানে স্কলার্রশিপে পড়া একটা ছেলের অনেক মূল্য। তার ভবিষ্যত আছে। ছেলে প্রকৌশলী। মুনিয়াকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেছে। ছেলে এখন মুনিয়াকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
শাহেদের সমস্ত অধিকার এখন সেই যোগ্য ছেলের হয়ে যাবে।
এই ব্যাপারটা শাহেদকে প্রচন্ড কষ্ট দিতে শুরু করেছিল। মুনিয়ার পাশে অন্য ছেলেকে সে কি করে সহ্য করবে?
তখনই অনেক প্রশ্ন শাহেদ করে মুনিয়াকে।
মুনিয়া কাঁদছিল। ডিসেম্বর মাসের শেষ বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ার ওরা দুজন বসে ছিল।
মুনিয়া কাঁদছিল। শাহেদ এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে ছিল। কোনো কথা সে খুজে পাচ্ছিল না। কি বলবে?
শাহেদ বলল, কখনও যদি দেখা হয় আবার? আমাকে না পাবার কষ্ট তোমার চোখে আমি দেখতে পাবো?
তারপর নিরবতা। শাহেদ আবার হেসে ওঠে।
পাবো না। হা হা হা......লাভ শুড চেইজ। হা হা। ভালোবাসার পরিবর্তন অবশ্যই হবে। তুমি জানো তা।
তুমি জানো তুমি সেই কথিত যোগ্য পাত্রকে ভালোবাসবে। ভালো তোমাকে বাসতেই হবে। না হলে তো সংসার হলো না।
মুনিয়া মাটির দিকে তাকায়। বলে, আমি জানি না।
আমি কিচ্ছু জানি না। মুনিয়ার চোখ ভারি হয়ে আসে। ঠিক তখনই বলে একটা কবিতা শোনাও না.......
আজ ঠিক ২০ বছর পর মুনিয়ার ফোন করে শাহেদকে। ঠিক ২০ বছর। এই দিনটিতেই তাদের শেষ দেখা হয়েছিল।
একটি গম্ভীর মহিলা কন্ঠ ফোনে তাকে বলে, আমি মুনিয়া।
অফিসে ব্যস্ত শাহেদ বুঝে উঠতে পারে নি। মুনিয়া! কোন মুনিয়া?
হাসতে হাসতে মুনিয়া বলে, কোন মুনিয়া? তার মানে ভুলে গেছো। এমন তো কথা ছিল না। তাহলে তুমিই সুখের সাগরে ঢুবে আমাকে কষ্ট মনে করে ভুলে গেলে।
শাহেদের সারা শরীর কাঁপা শুরু করলো। আমার মুনিয়া! আমার ভালোবাসা! এতোদিন পর আমাকে ফোন করেছে আর আমি চিনতে পারলাম না!
ফোনে কথা হয় তাদের। দেখা করতে চায় শাহেদ। মুনিয়া বলে, আমি দেশে এসেছি কয়েকদিনের জন্য। এবং সেটা তোমার জন্যই।
বেশকিছুদিন ধরে স্বপ্নে প্রচন্ড জালাচ্ছ।
- এখনও তাহলে আমাকে স্বপ্নে পাওয়া যায়?
মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, লেখালিখি আর করোনি কেনো?
- তুমি কি করে জানলে যে লেখালিখি করি না?
- লেখালিখি চালিয়ে গেলে এতোদিনে তুমি অনেক বড় লেখক হয়ে যেতে। আর সুদূর প্রবাসে থাকলেও তোমার বই আমি পড়তে পারতাম। যেহেতু শাহেদ চৌধুরী নামে কোনো লেখক আমার পরিচিত নয় সেহেতু তুমি নিশ্চিত লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছো।
শাহেদ বলে, আমার বইয়ের অপেক্ষায় ছিলে সেটা আমাকে বলতে তাহলে লিখে যেতাম।
- না না। আমার জন্য লিখবে কেনো?
কথার মগ্নতায় শাহেদ ভুলেই যায় একটি প্রশ্ন করতে আর তা হলো তার অফিসের ফোন নাম্বার মুনিয়া কোথায় পেলো। শাহেদের মাথায় প্রশ্নটি চলে আসে।
- বাই দ্যা ওয়ে।
তুমি আমার ফোন নাম্বারটা কোথায় পেলে। তাও আবার অফিসের।
মুনিয়া হেসে দেয়। ছেলেরাই শুধু মেয়েদের ফোন নম্বর বের করতে পারবে? মেয়েরা কি পারে না?
- সেটা তো বলি নি। কথা পেচানোর অভ্যাস তো দেখি আজও যায় নি।
- হা হা হা...হয়তো কোনো অভ্যাসই আমার বদলায় নি। যাই হোক। আমার এক বান্ধবীর জামাই তোমার অফিসে চাকরী করে। ওদের বিয়ের প্রোগামের ভিডিওতে অফিশিয়াল গেষ্টদের মধ্যে তোমাকে দেখি। তার মাধ্যমেই তোমার নম্বর নেয়া।
- বাহ। কি কোয়েন্সিডেন্স।
তারপর দুজনের আরো কিছুক্ষণ আলাপ চলল। দেখা হবে বিকেলে। সেই একই জায়গায়।
ধানমন্ডি লেক। সে সময়কার লেক এখন অন্যরকম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সব কিছুর। সেখানে এখন তরুণ প্রজন্মের সমাবেশ ঘটে। আড্ডা দেয়।
বড়লোকের ছেলেমেয়েরা গাড়ীতে জোরে গান বাজিয়ে ড্রাইভ করে আর ঘুরে বেড়ায়। এটা এখন ওদের মুক্ত স্থান হয়ে গড়ে উঠেছে। সেই জায়গায় এখন তাদের দেখা হবে। সেই বয়স যেনো তারা ফিরে পাবে কিছুক্ষনের জন্য।
শাহেদ বসে আছে ধানমন্ডি লেকের মুক্তমঞ্চে।
বসে বসে সিগারেট ফুকছে। ধোয়া উড়াচ্ছে। সেই ধোয়া বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে দৃশ্য সে দেখছে আর অপেক্ষা করছে মুনিয়ার জন্য। মুনিয়ার সাথে আজ ২০ বছর পর দেখা হবে।
সেই পুরোন ভালোবাসার মানুষ। সেই অনুভূতি হয়তো কিছুক্ষণের জন্য জাগ্রত হবে। যার সাথে কতগুলো বছর ভালোবাসার বন্ধনে অবদ্ধ ছিলাম। কত সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করা হয়েছিল। সে সব তো এখন ফিকে হয়ে যায় নি।
এখনও তো নির্জনে সে মুনিয়ার গায়ের গন্ধ পায়। মুনিয়ার হাসির শব্দতো প্রায়ই তার কানে বেজে ওঠে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মুনিয়া নামটা তো অনেকদিন ডাকা হয় না। তখনতো সে আয়নার সামনে গিয়ে বার বার বলে, মুনিয়া..মুনিয়া..মুনিয়া... কখনও কখনও খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর কেঁদে উঠে। মুনিয়া কি তা বুঝবে? এতোদিন পর মুনিয়ার সাথে দেখা হবে, মুনিয়ার গায়ের সেই গন্ধ কি এখনও একই আছে? তার সেই মিষ্টি হাসিটি কি একই রকম আছে? মুনিয়া কি এসেই আমার পাশে বসবে নাকি একটু দূরত্ব রাখবে? ওকি আমাকে ওর হাতটা একটু ম্পর্শ করতে দেবে? ওকি প্রশ্ন করবে, শাহেদ তুমি কি বিয়ে করেছো? এই প্রশ্নের পর শাহেদ কে বলার সুযোগ করে দিবে কি? শাহেদ কি বলতে পারবে? মুনিয়া আমি তো এখনও বিয়ে করি নি।
আমি যে কাউকে ভালোইবাসতে পারি নি। কত মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। একবার তো একমেয়ের সাথে দীর্ঘদিন প্রেমের অভিনয়ও করেছি কিন্তু শেষমেষ আর নিজের সাথে মিথ্যে বলতে পারছিলাম না তাই সে মিথ্যাপ্রেম কে আর এগুতে দেইনি। আমার সমস্ত চেতনা সমস্ত আবেগ এখনও তোমার জন্য রয়েছে। শাহেদ কি বলতে পারবে, এই ২০ বছরে সে ২০টির বেশী উপন্যাস লিখে ফেলেছে।
শখানেক গল্প লিখেছে কিন্তু ছাপানোর প্রয়োজন বোধ সে করে নি। করে নি। প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়ার স্বপ্ন যে দেখিয়েছে সেই তো নেই। তবে তা হয়ে কি হবে?
শাহেদ ভাবে আর চেয়ে রয় সামনে। অপেক্ষা করে মুনিয়ার।
মুনিয়া আসবে আজ কুড়ি বছর পর। শেষ দেখার দিনের মতো সেই স্নিগ্ধ বিকেল। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। সে কবিতাটি সে আবার আবৃত্তি করতে থাকে,
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে -
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন স্বন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।