আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবার স্বাধীনতা - মরহুম গাজী ফরিদ আহমেদ

FROM MIRPUR DHAKA

অপূর্ব সকাল। চারিদিকে কি যে এক মিষ্টি আমেজ। পূর্ব দিগন্ত লালাভ আলোর ছ'টায় ক্রমে আলোকিত হচ্ছে। পাখিরা সব নীড় ছেড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। চার দিকে কেমন যেন একটা ধোঁয়াটে আবরণ।

নিরব, নিস্তব্ধ, দুয়েকটি পাখি আর মোরগের হাক ছাড়া। যদি সারা দিনান্তব্যপী এ মুহুর্তের আবেশ স্থির যেত। থাকতো না জনাকীর্ণতা, থাকতো না মানুষের নিষ্ঠুর পদচারণা আজকের সকালের এই বিস্তৃর্ণ প্রান্তরে। কখনও তা হবে না। হয়তো কিছুক্ষন পরেই মানুষের সুতীব্র কোলাহলে, চারপাশ একাকার হয়ে যাবে।

মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর আলোয় চকচকে হয়ে গাবে। এই সকালের সজীবতা শুকিয়ে মরে যাবে। সবই ছুটবে যে যার কাজে। এ সব এলোপাতাড়ি চিন্তা করতে করতে ধীর পদক্ষেপে মাঠের পর মাঠ উচ্ছল পা ফেলে হাঁটছিল রফিক। নানা প্রশ্নের, নানা কথার উদয় হচ্ছে তার মনে।

কত কথাই না ফেবে ফেলল এতক্ষন। আসলে এমন একটা নিরব, নিস্তব্দ সুন্দর মুহুর্তে কত ভাবনাই না পাশে এসে দাড়াঁয়। এমন একা থাকলেই নাকি শত শত চিন্তারা ঠেসে ধরে। হাটঁতে হাটঁতে নদীটার কাছে এসে গেল রফিক। খুব সুন্দর মাঝারি আকারের নদী।

গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে অধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে। চারদিকটা এমন - যেন আধাঁর আধাঁর। নদীটার পাড়ে গিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় বসল নিশ্চিন্তে। পূর্ণ বয়সের উচ্ছল তরুণ এখন রফিক। এখানে মানে - এই গাঁয়ে গতকাল এসেছে।

তার দাদার বাড়ী বেড়াতে। শীতটা ভাল করে পড়তে না পড়তেই আর টিকতে পারলো না। মাকে নিয়ে সোজা গাঁয়ে। এই বিশেষ সময়টা তার গাঁয়ে কাটানো চাই। সকালে উঠা একটা অভ্যাস তার।

আর গাঁয়ে এলে তো কথাই নেই। এই গাঁয়ের সবাই সুন্দর, কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর এই নদীর ধারটা। প্রতি সকালে উঠেই এখানে চলে আসে। ভাল লাগে আসতে। বড় আপন এই নদী।

বহু কষ্টের বেদনার একটি রাতের কথা জানে সে। এখানে এলেই খুব করুণ লাগে নিজেকে, পৃথিবীকে। নানান প্রশ্ন, নানান কথা বলতে ইচ্ছে করে এই নদীকে। কেমন করে সেই শোকার্ত রাতটি রচিত হল। কেমন করে এই পবিত্র তীরের বাতাস ভারী হয়েছিল বেদনা-আপ্লুত কিছু স্বপ্নের কথায়।

নদী সবই জানে অথচ বলে না। যদি শোর্কাত হয়ে পড়ি আমি। বাবাকে আমার তেমন মনে নেই। থাকবে কেমন করে - তখনতো সে ছোট্টটি। সবই মার কাছে শুনে, ধার করা।

চারদিকে তখন যুদ্ধের ঘনঘটা। ৭১-এর গোমট আবহাওয়া আর ঝোড়ো সংলাপ। যে কোন মুহুর্তে লেগে যাবে এমন। এমনি এক সময়ে তারা গাঁয়ে দাদা বাড়িতে এসে উঠলো। বাবা চাকরি করতো পশ্চিম পাকিস্তানে।

তখন দেশে যে তুমুল উত্তেজনা, আন্দোলন আর নব-জাগরণের জোয়ার বইছে তার ধাক্কা সেখানে কম খায়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশিও। একদিকে অবাঙ্গালীদের অত্যাচার অন্য দিকে মানসিক বিপর্যস্ত। দুয়ে আমরা মৃত প্রায়। দেশ-প্রেমিক আমার বাবা দেশের জন্য যে কত রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো ।

সাথে সাথে আমরাও। কান পেতে থাকতো কখন দেশের খবর পাবে বিবিসির খবরে। শেষে যখন আন্দোলন তুমুল, তখন দেশের জন্য কিছু করার তাগিদেই চাকরিতে ইস্তফা দিল। বহু কষ্টে রাতে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে এলো। যেখান থেকে সোজা দেশে একেবারে গাঁয়ে।

ছোট মামাকে নিয়ে আরও করুণ অবস্থা। গাঁয়ে এসে শান্তি নেই বাবার। মানুয়দের বোঝাতে লাগলো দেশের অবস্থা। শোনাতে লাগলো স্বাধীকারের কথা, মুক্তির কথা। সংঘটিত করল, গাঁয়ের যুবক আর তরুণদের।

এদিকে ক্রমে ক্রমেযুদ্ধের গহিন রাত গুলো হাটি হাটি পায়ে এগিয়ে আসছিল। বাবাও এগিয়ে চললো আন্দোলন নিয়ে আপন গতিতে। কিছু দিন পর শুরু হল যুদ্ধের সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। গাঁয়ের পর গাঁ ধ্বংসের দুর্ধর্ষতা। বাবা তার লোকজন নিয়ে চলে গেল যুদ্ধ প্রশিক্ষনে অগ্নিমন্ত্রে দিক্ষিত হতে।

সর্গাদর্পি জন্মভুমির অত্যাচার রুখতে। আমরা তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি এ গাঁ থেকে সে ঘাঁ। বাবার কোন খবর নেই। সবাই হয়ত ভাবছিল বাবা মারাই গেছেন। আমি অত বুঝতাম না।

মার চোখের জলের ধারা কখনও বাধ মানেনি। নিরব পাথরের মত হয়ে গেল। উৎভ্রান্তের মত। তবে মা'র কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাবা বেচে আছে। চারিদিকে কিযে এক মহাপ্রলয় কান্ড।

আমরা ঠিকানাবিহীন ছিন্নমুল জীবন, ভয়ার্ত হরিণের মত এলোপাতাড়ি যাযাবর। এরই মাঝে অনেক দিন কেটে গেল, তবু বাবার খোঁজ নেই। ক্রমে যুদ্ধ যেন স্তিমিত হয়ে এলো। তেল ফুরিয়ে যাওয়া প্রদ্বীপের মত। আমাদের যোদ্ধারা বিপুল পরাক্রমে হটিয়ে বেড়াচ্ছে হায়েনাদের।

সবার মাঝে কেমন একটা খুশীর আমেজ, এত দুঃখ, এত কষ্টের পরও। সবাই হয়ত শান্তির নিশ্বাস ফেলছিল বহুদিন পর। আমাদের এলাকা মোটামুটি মুক্ত। তবুও ভয় কাটেনি। আবার নিজেদের গাঁয়ে ফিরে এলাম।

ততক্ষণে গাঁয়ে কিছু আর বাকী নেই। আগুনে পোড়া মানুষের মৃত দেহ যেমন বীভৎস হয়ে থাকে তেমনি একটা বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে সারা গাঁয়ে। হাজার বছরের স্বপ্নের কি করুণ পরিহাস মুহুর্তের মাঝে। তখন শীতের কিছুটা আভাস, হয়তো নভেম্বর মাস। চারিদিকে বিলাপ আর শোকের আঁধার।

এমন একটি সময় হঠাৎ একদিন রাতে বাবা এসে হাজির। কাঁধে স্টেনগান, মুখ ভর্তি একরাশ দাড়ি, সারা গায়ে কেমন যে এক উশৃংঙ্খলতা বিরাজ করছে। কোন এক উঠতি মাস্তানের মত। তড়িৎ গতিতে সারা বাড়ীতে কি যে এক প্রাণ চাঞ্চল্যতা ছড়িয়ে পড়ল, তার সাথে কান্নার রোল। দুয়ে মিলে এক অদ্ভুত পরিবেশ; আমার তো আনন্দ আর অভিমানে এক করুণ অবস্থা।

বাবা আমাদের নানা ভাবে সান্তনা দিচ্ছেন। আমাকে কোলে তুলে আদর করছেন। বাবা নানাভাবে বুঝাতে চাচ্ছেন আমাদের এই দুঃখের দিন শেষ হতে আর বাকী নেই। আমরা শীঘ্রই স্বাধীনতা লাভ করবো। কে কার কথা শোনে।

বেঁড়া'তে ঠেস দিয়ে রাখা বাবার স্টেনগানটি নাড়াচাড়ায় ব্যস্ত আমি। অদ্ভুত বস্তুটির প্রতি আমার কৌতুহল যেন উছলে পড়ে। বাবাকে ঘিরে সবাই বসে, বাবা নেতার মত যুদ্ধের নানা বীরত্বেপূর্ণ কথা বলছেন, সকল দুঃখ বেদনা তখন উধাও। বাবার কথা শুনে স্বাধীনতা নামের অপূর্ব বস্তুটির অপেক্ষায় সবার চোখে যেন আনন্দে ছল ছল করে উঠলো। কিন্তু তারপরই অপেক্ষা করছিল সেই নিষ্ঠুর রাত।

সেই রাতে আমি হারিয়ে আমার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি, সারা জীবনের একটি বিসর্জণ। অতি ক্ষনস্থায়ী একটি আনন্দের পরই এত বড় বিসর্জনের জন্য কেহই প্রস্তুত ছিল না। কারণ তখন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত বাবার কথা শুনছি এরই মধ্যে বাবা যেন হঠাৎ চকিতে খেয়ালী উঠলে আস্তে করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন যেন স্নেহ বন্ধনের সকল শৃংঙ্খলা ভেঙ্গে। বললেন, 'আমাকে এখনি যেতে হবে। আমাদের যুদ্ধ এখনও সম্পূর্ন শেষ হয়নি' আরার কিছু হারানোর আশংকায় সবাই যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠলো।

কান্নার সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য। এমনি সময় বাহির থেকে কারা যেন বাবাকে ডাকল। হয়ত এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, ডাক শুনে বাবা কেমন যেন অজানা আশংকায় জ্বলে উঠলেন। বাবাকে কেহ যেতে দিতে চাইল না। প্রায় জোর করেই চলে গেল।

মিনিট দুএক পরেই বাবা ঘরে ফিরে বললো 'ভয়ের কিছু নেই, ওরা গাঁয়ের লোক আমাকে দেখতে এসেছে, আমার সাথে কি কথা যেন বলবে' আবার একবার সবার দিকে সাধারণ দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে, আমাকে একটু আদর করে দ্রুত পায়ে চলে গেল। কেউ কি জানত এটাই হবে বাবাকে শেষ দেখা। আমরা জানতাম বাবা যুদ্ধে চলে গেছে। পরদিন খুব ভোরে সবাই আমাদের জানাল বাবার মৃত লাশ এখানে এই নদীর পাড়েই পরে আছে। অথচ এমনটি তো হবার কথা ছিল না।

যাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ছিল তারাতো আমার বাবাকে মারতে পারেনি। বাবা প্রবল পরাক্রমে হটিয়ে বেড়িয়েছে তাদের কিন্তু মারলো এদেশীয় রাজাকার নামের তাদেরই দোসররা। অথচ কত কাছে থেকেও বাবা বোঝেনি। গাঁয়ের বহু লোককেই নাকি এভাবে ডেকে নিয়ে ওরা মেরেছিল। সবাই দেখল লাসের অর্ধেকটা নদীর পানিতে আর অর্ধেক পাড়ে।

সুন্দর ভঙ্গিতে হাত-পা মেলে নিস্তব্ধ। চোখ গুলো খালা স্বাধীনতার আগমন ধ্বনিতে উচ্ছসিত। যেখানে লাশটি পড়ে ছিল তার কিছু দুর থেকেই রক্তের থোঁকা থোঁকা দাগ লাশের পাশে গিয়ে মিশেছে। হয়তো গুলি করার পর অনেক ক্ষন বেচে ছিল। বহু কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে নদীর কাছে এসেছিলেন হয়ত।

এর মিষ্টি পানিতে মুখ ভিজিয়ে ছিলেন হয় তো্ , চিৎকার করে হয়ত অনেকগুলো কথা বলেছিলেন, যার বিন্দুমাত্রও কেউ শুনেনি। হে নদী তুমি তো শুনেছ, তবে চিৎকার কর না কেন, থেকোনা নির্বাক তুমি? কি ছিল সেই কথা গুলি? হয়তো তা ছিল মুক্ত স্বদেশ গড়ার . . .. হয়তো বা সেই আসন্ন অধ্যায় . . . বাবার স্বপ্নের স্বাধীনতা। গাজী ফরিদ আহমেদ ঢাকা গভঃ কমাশিয়াল ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিল। সে গত ১১ই ডিসেম্বর ' ১৯৮৬ তে এক সড়ক র্দুঘটনায় মারা যায়। মারা যাওয়ার পূর্ব রাত্রে সে এই গল্পটি লিকেছিল।

তার পড়ার টেবিল থেকে এই লেখাটি অসমাপ্ত অবস্থায় সংগ্রহ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয় - প্রথম প্রকাশ - বাংলার বানী ' ১৯৮৭

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.