যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
একজন বাংলাদেশী লেখক-সাংবাদিক আলবেনিয়া সফর করছিলেন। তিরানায় কয়েকজন তরুণের সঙ্গে তার কথা হচ্ছিল, যারা অবজ্ঞা-অবহেলায় এনভার হোক্সার নয়া আলবেনিয়াকে নিয়ে তামাশা করছিল। কেন তিরানা রোম, এথেন্স বা ভিয়েনার মতো জৌলুস-জাঁকে পরিপূর্ণ নয় তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। স্পষ্টতই রোম, এথেন্স, প্যারিসের সঙ্গে ছুটতে চাইছিল ওরা। ওই লেখক বলেছিলেন, "অর্জন তো করেনি, জন্মসূত্রে যা পেয়েছো হেলায় ধ্বংস করো না।
জন্ম-জন্মান্তরের ফিরে পাবে না," (হুবহু উদ্ধৃত নয়)।
তিনি যখন তিরানার তরুণদের সতর্ক করছিলেন তারও পনেরো বছর আগে আমাদের তরুণ প্রজন্ম তাদের যুদ্ধে পাওয়া স্বাধীনতাকে, ছিনিয়ে আনা স্বদেশকে, রক্তাক্তত মুক্তিযুদ্ধকে খুঁইয়ে বসেছে। আমার লেখালেখির সময়কালে অনেক বিষয়ে লিখেছি। কখনো মুক্তিযুদ্ধ-বিজয়-স্বাধীনতা নিয়ে লিখিনি। লিখতে পারিনি।
চোখের সামনে প্রিয় মানুষটি পুড়ে অঙ্গার হলে যে অনুভূতি হয় তা-ই হয়েছিল এখনো হয়। অসহ্য যন্ত্রণা আর ভয়ঙ্করতম ব্যর্থতায় কখনোই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিনি। একসঙ্গে হাজার হাজার লেখা কলমের ডগা দিয়ে বেরুতে গিয়ে জট পাকিয়ে গেছে। অসহ্য ক্ষোভে বধির হয়ে গেছি যেন। ৩৭টি বছর ধরে কানের ভেতর একধরনের ভোঁতা ভোঁ ভোঁ শব্দ বেজেছে।
গুমরে ওঠা হতাশা, ব্যর্থতা, লজ্জা, অপারগতা দলা পাকিয়ে গলার কাছটিতে উঠে এসেছে। এ যেন চেয়ে চেয়ে মহাদেশ ডুবতে থাকার জান্তব দৃশ্যাবলির বায়োস্কোপ। আজ বিজয়ের মাসে লিখতে বসে ক্ষতের ওপরকার পাতলা পলেস্তারা খোঁচা দিয়ে তুলে দিলাম যেন। কাঁচা হয়ে যাওয়া ওই ক্ষত এখন দগদগে। কী লিখবো? বাঙালির পরাজয়ের ইতিহাস? সাধের ছোট্ট ৫৬ হাজার বর্গমাইলের অ্যাকুরিয়ামের ভেঙে যাওয়ার ইতিহাস? বিজিতের রক্তচুর সামনে বসে স্বাধীনতার নামতা পড়ার ইতিহাস? নাকি সেই হতভাগাদের কাসুন্দি, যারা বৈষম্য দেখেছে, সংগ্রাম দেখেছে, যুদ্ধ দেখেছে, সর্বগ্রাসী অত্যাচার দেখেছে, স্বাধীনতা দেখেছে।
আবার চোখের পলকে বিজয়-স্বাধীনতা লুট হতে দেখেছে? স্পষ্টতই অনুভব করি, আমরা সেই ক্রান্তিকালের মানুষ, যারা ইতিহাসের চৌর্যবৃত্তিতে নিঃস্ব, অথচ আঁকড়ে ধরে রেখেছে পোড়া ভিটের পোড়া খুঁটির শেষাংশ।
এই জনপদের বাঙালিরা সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র জাতি যারা ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মাত্র তিন/চার বছরেই শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। যুদ্ধের সহায়ককে নিয়ে তামাশা করেছে। যুদ্ধের নেতার নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ করেছে। অবিশ্বাস করেছে।
একসময় সন্দেহগুলো পাকাপোক্ত হয়ে সিদ্ধান্তে দাঁড়িয়ে গেছে। এই জাতি তার বীরাঙ্গনাদের নিয়ে অশ্লীল মস্করা করেছে। নয় মাসের যুদ্ধকে চাপিয়ে দেওয়া বলেছে। পবিত্র ভূমি (!) পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতকে শত্র“ বলে কাঠগড়ায় তুলেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলেছে।
শেখ মুজিবকে ‘২৫ মার্চের স্কেপিস্ট’ বলেছে। ‘পলায়নপর সুবিধাবাদী’ বলেছে। পরে ভৎর্সনা করেছে। জাতির পিতা বিষয়ে বেশুমার মস্করা করেছে। বঙ্গবন্ধুর চারপাশের বর্ণচোরাদের অনুগুণ্ঠন খুলে গেছে।
একসময় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বদেশ কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুঁকছে। অতঃপর নতুন প্রজন্ম বলতে শুরু করেছে, ‘গন্ডোগোলের বছর’। নতুন প্রজন্ম একাত্তরের সেই আত্মবলিদানকে বলেছে, গেঁয়ো কিছু মানুষের আহম্মকি!
আমার খুব হাসি পায়, যখন দেখি আমাদের বিদ্বোৎজনরা বলেন, এদেশের নব্বই-পঁচানব্বই ভাগ মানুষই সে সময়ে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল, পক্ষে ছিল। সবাই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের ভেতরেই ছিল। হাসি পায়।
দুঃখবোধ করি। আমার সরল যুক্তি দিয়ে বুঝি, তা-ই যদি হতো তাহলে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের স্থপতিকে হত্যা করতাম না। চার বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের বিভীষণরা ক্ষমতা দখলের রক্তয়ী হত্যালীলায় মত্ত হতো না। পাঁচ বছরের মাথায় পরাজিত রাজাকার-আলবদররা দাঁপিয়ে বেড়াতো না। এক দশকের মাথায় মোটা দাগে জাতিটা দ্বিখণ্ডিত হতো না।
দেড় দশকের মাথায় ‘মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম’ বলতে লজ্জা পেতো না। দুই দশকের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের কাঠের পুতুলকে প্রাণ সঞ্চার করে ‘ডামি মহানায়ক’ বানাতো না। আড়াই দশকের মাথায় মুক্তিযুদ্ধকে ‘পুরোনো প্যাঁচাল’ বলে আঁস্তাবলে ছুড়ে ফেলা হতো না। তিন দশকের মাথায় সরাসরি রাজাকার-আলবদররা তখতে তাউসে বসে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা, সেক্যুলারিজম, আর লাখ লাখ নরনারীর আত্মত্যাগের পশ্চাৎদ্দেশে লাথি মেরে ইতিহাস ভুলিয়ে দিতো না। আমি বিশ্বাস করি যারা সে সময়ে কোলাবরেটর হতে পেরেছে তারা দেশে থাকতে পেরেছে।
আপোস করে থেকেছে, (শিক্ষিতজনদের কথা বলছি) যারা মরতে মরতে অবশিষ্টটুকু ভারতে পালিয়েছে, তারা যুদ্ধ করেছে। যারা প্রাণকে তুচ্ছ করতে শিখেছে, তারা যোদ্ধা হতে ভারতে গেছে। পালিয়ে পালিয়ে দেশের ভেতর যুদ্ধ করেছে। যারা বুদ্ধিমান তারা মরতে চায়নি। আবেগকে বশ করে বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছে।
তারা দেশে থেকে কোলাবরেটর হয়েছে। দালাল হয়েছে। দালালরা ক্ষমতা দখল করার পর দালাল থেকে ‘মানুষ’ হয়েছে। সেই মানুষেরা এখন ক্ষমতার আগাপাশতলা আলোকিত করে ইতিহাস নির্মাণ করছেন। বিকৃত, খণ্ডিত, ভগ্ন, পরিত্যাক্ত বেজন্মা ইতিহাস।
এ জাতির সিংহভাগকেই আমি দালাল বলছি, কোলাবরেটর বলছি, বেজন্মা বলছি। কারণ তারা জন্ম ইতিহাসকে সন্দেহ করেছে, অবিশ্বাস করেছে, পরিত্যাগ করেছে। প্রতিবাদ করেনি। প্রতিরোধ করেনি। আর সে কারণেই তিরিশ লাখ শহীদের সঙ্গে এই জাতি বেঈমানি করেছে।
আর তাই কমবেশি প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালিই এক একটি আঁস্ত স্কাউন্ড্রেল। ইতিহাসের বর্জ্য।
মেহেরপুর-বেতাই সীমান্তে আমি দেখেছি, সেই ১১ বছর বয়সে দেখেছি, বাঙ্কারে বাঙ্কারে দেখেছি একএকটি টিমে ২০ জন সাধারণ মানুষের সঙ্গে একজন বিডিআর (তৎকালীন ইপিআর)। ২৫/৩০ জন সাধারণের সঙ্গে একজন সেনা সদস্য। ৯০/১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে একজন ক্যাপটেন বা লেফটেন্যান্ট।
আমি দেখেছি ফ্রন্ট লাইনের একেবারে সামনে কাছা দেওয়া কৃষকের ছেলে। পরের ব্যাকআপে কলেজ পড়ুয়ারা। তারও পেছনে সেনা-বিডিআর বা আর্মড ফোর্স। এবং এদের সবাইকে ব্যাকআপ দিচ্ছে আর্টিলারি নিয়ে ভারতীয় সেনা। আনুপাতিক হিসাবে হাজার বিশেক বাঙালি সেনা/বিডিআর/পুলিশদের সঙ্গে সম্মুখ আর গেরিলা মিলিয়ে লাখ দুয়েক মুক্তিযোদ্ধা।
গড় করলে ২.০০ = ০.০০২০! এখন দেশ-সমাজ-ক্ষমতা-ইতিহাস বেদখল হওয়ার পর শুনছি, দেশ স্বাধীন করেছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। ব্রাভো!
চতুর্দশ শতক থেকে উনবিংশ শতক জুড়ে ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ইনকা সভ্যতার ধারক ইন্ডিয়ানরা যুদ্ধ করেছে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে, ফরাসি আর পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে। পুরোটা উনবিংশ এবং বিংশ শতক জুড়ে কালো আফ্রিকানরা সাদা ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়ে পূর্ব ইউরোপীয়রা পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি এশিয়া-পূর্ব এশিয়ার দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ সগৌরবে জয়ী হয়েছে। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, পর্তুগালের নিগড় থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। এইসব একএকটি সংগ্রাম, একএকটি যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনচেতা মানুষ তৈরি করেছে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি তৈরি করেছে।
এরা কেউ, হ্যাঁ এরা কেউই তাদের জন্মইতিহাস কলঙ্কিত করেনি। সন্দেহ করেনি। অস্বীকার করেনি। বেজন্মার মতো জন্ম নিয়ে তামাশা করেনি।
কিন্তু এই বাংলা করেছে।
এই বাঙালি করেছে। আর সে কারণেই এই বাঙালিকে তার সূর্যসন্তানদের আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধা করার জন্য নতুন প্রজন্মকে করজোড়ে অনুরোধ করতে হয়। কখনো বা আইনি তকমা দিতে হয়। মনে করিয়ে দিতে হয়, তাদের পূর্বপুরুষরা একদা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। কষ্ট চেপে মনে করাতে হয় তাদের পূর্বপুরুষদের অকাতরে প্রাণদানের বেদিতেই আজ অবশিষ্টদের কতল করা হচ্ছে।
তা না হলে নতুনরা বিস্মৃত হয়। দূরবীন দিয়ে চেনাতে হয়, ‘দেখো এ নয় ও যুদ্ধ করেছিল’! এ নয় ওর নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়েছিল!
এখন আমরা স্টুপিড-স্কাউন্ড্রেল মেনে নেয়ার দলরা যে রেজিমে বাস করছি তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। যৌবনের তরঙ্গে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছিল মাত্র। কারণ কোনো মুক্তিযোদ্ধা তার জন্ম জঠোরকে অস্বীকার করতে পারে না। আমাদের ‘ভেদবুদ্ধিহীন বোকা আত্মবলিদানকারী মুক্তিযোদ্ধারা’ আমাদেরকে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড দিয়েছিল।
সেই ভূখণ্ডে এখন যারা শাসন করছেন, হোক না তার নাম জিয়া-এরশাদ-খালেদা-নিজামী এরা কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। হয়তো যুদ্ধ করেছে মাত্র সেনার চাকরির নিয়মে (সেনাকে বেতন-ভাতা দেওয়াই হয় যুদ্ধ করার জন্য)। এরা বাংলাদেশটাকে জন্মইতিহাসহীন ‘জারজ’ বানিয়েছে। সেই জারজত্বকে স্থায়ী করার জন্য একের পর এক প্রজন্ম বানিয়েছে। তারা আধুনিক।
স্পার্ম আর ডিম্বাণুর জায়গট ফরমেশন বোঝে না। শুধু বোঝে কম্মটি টেস্ট টিউবেও হয়। এই আধুনিক প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিকের সন্তানদের আত্মত্যাগ অ্যামেচার ডিজাস্টার। আমি জন্মজন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী নই, হলে বলতাম, হে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সূর্যসন্তানরা পরজন্মের সময় এসেছে।
উঠে এসে আমাদের অপবিত্র পাপবিদ্ধ সর্বশরীরে থু থু দিয়ে যাও, আমরা স্বাধীনতা ‘ভোগ’ করছি বেজন্মা ইতরের মতো, দাম না চুকিয়েই !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।