আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষি ও গণমাধ্যম

পাখি এক্সপ্রেস
সারাদিন চরের মাঠে মাঠে, ফসলের ক্ষেতে দাপিয়ে চলে এক সাংবাদিক খবর কুড়িয়ে নিয়ে এলেন জেলা প্রেসক্লাবে। টপিকস খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিদস্যুর অত্যাচারে আমন ধান ঘরে তুলতে পারছে না কৃষক। ফসলের জমিতে লাল নিশানা উড়িয়ে দিয়েছে ভূমিদস্যু বাশার মাঝির লোকজন। একর প্রতি নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দাবি করছে, নইলে ধান ঘরে নিতে পারবে না।

চাঁদা না দিয়ে ধান ঘরে তোলার চেষ্টা করলে হারাতে হবে ঘরভিটে অথবা ঘরের বৌ, মা কিংবা মেয়ের সম্ভ্রম। কৃষকের অপরাধ (?) বেশি হলে জান হারানোও অস্বাভাবিক নয়। ওইদিকে প্রশাসনও নিরব। ---------------- খবরটি অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছরই চরাঞ্চলে মাঠের ফসল ঘরে তোলার সময় দস্যুদের এ অত্যাচার চলে।

কোন কোন বছর প্রশাসনের কঠোরতায় পরিস্থিতি কৃষকের পক্ষে যায়, কোন কোন বছর বা প্রশাসনের নিরবতায় মাঠের ফসল কৃষকের গোলায় যাওয়ার সুযোগ পায় না। সংবাদকর্মীরা বিষয়টি সম্পর্কে বরাবরই অবগত থাকেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ওই সাংবাদিকের কুড়িয়ে আনা সংবাদ পেয়ে বুড়ো সাংবাদিকরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তা দেখে আমার মনে ফসল ওঠার এ মৌসুমে খুব কমসংখ্যক সাংবাদিকই ক্ষেতের আইলে অথবা চরের মেঠোপথে পা রেখেছেন। তারপর শুরু হলো সংবাদকর্মী এবং সংবাদের বিভিন্ন অংশ এদিক সেদিক নেড়েছেড়ে নিজের নামে স্ব-স্ব মিডিয়ায় প্রেরণ করা। কেউ কেউতো শুধু নাম পরিবর্তন করেই নিজ মাধ্যমে খবর পাঠানো শুরু করলো।

বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে বিদেশি দাতা সংস্থা এবং দেশীয় সুদব্যবসায়ী নোবেলজয়ীরা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে। এ প্রচেষ্টার বলি হচ্ছে আমাদের কৃষকের মনোবল, মাটির উর্বরতা আর শস্যের পুষ্টিগুন। আগ্রাসন চলছে বীজ, সার আর কীটনাশকের ওপর। হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে ১৫ কোটির অধিক জনগণের ক্ষুধা নিয়ে। দেশে চলতি আমন মৌসুমে মোট কৃষকের শতকরা ৮০ভাগ কোন দেশী জাতের বীজ চাষ করেনি।

আবার মোট ৬০ভাগ কৃষকের ঘরে কোন দেশীজাতের বীজই নেই। কিন্তু আমাদের দেশের বীজ জাপান, চীন, ভারত এবং আমেরিকার সংরক্ষনাগারে আছে। এবছর পুরো সারের বাজারে ভারতীয় নিম্নমানের সারে সয়লাব হয়ে গেছে। অপরদিকে চীন এবং ভারত থেকে আসছে অকার্যকর ক্ষতিকর কীটনাশক। ধ্বংস করে দিচ্ছে মাটির উর্বরতা, দূষিত করছে পানি ও পরিবেশ।

ক্ষতি করছে কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য, সৃষ্টি হচ্ছে অপরিচিত দূরারোগ্য রোগের। হাইব্রিড বীজ নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ যে আশংকা করেছিলেন তা বোধ হয় আন্দাজকৃত সময়ের আগেই মহামারিরূপে দেখা দিচ্ছে। ব্র্যাকের মতো এনজিও বা আবদুল আওয়াল মিন্টুর মতো ব্যবসায়ী যখন মূল বীজ সিন্ডিকেট হয়ে গেছে তখন আমদানীকৃত সংরক্ষন অযোগ্য এ বীজ ব্যবহার কৃষকের সামনে পলাশীরূপেই ধরা দিবে। তার সাথে আছে সার এবং কীটনাশক সমস্যা। কৃষকের মৌলিক সমস্যা বলতে যা যা আছে : (১) নিজস্ব আবাদি জমি (২) পুঁজি (৩) উন্নত বীজ (৪) পদ্ধতি জ্ঞানের অভাব এবং উন্নত প্রযুক্তি (৫) সেচ (৬) রোগবালাই (৭) উত্তোলন পরবর্তী সংরক্ষন (৮) বাজারজাতকরণ (৯) সঠিক মূল্য না পাওয়া।

১ থেকে ৯ নং পর্যন্ত সমস্যাসমূহের সক্রিয়তার পেছনে যা কাজ করে : (১) গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থানায় অনুন্নত ভূমি আইন এবং বন্টন ব্যবস্থাপনা। (২) দারিদ্রতা, ভারসাম্যহীন কৃষিঋন পদ্ধতি, সার্টিফিকিট মামলা এবং সর্বোপরি বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাসমূহের বিষাক্ত চাবুকাঘাত। (৩) দেশীয় উন্নত জাতের বীজ উৎপাদনে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া এবং বীজ বাজারজাতকরণে স্থিতিশীলতা রক্ষা না করা। (৪)সরকারের কৃষিনীতিতে সংস্কার না আনা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে কর্মসূচী গ্রহণ না করা। (৫) জলাশয় এবং নদী ও খালসমূহের মরে যাওয়া, বিদ্যুত সরবরাহে অনিশ্চয়তা, সমবায় ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা না থাকা।

(৬) সঠিক বালাইদমন ব্যবস্থা সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞানের অভাব থাকা এবং এতদসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের অভাব (৭) হিমাগারসহ অন্যান্য সংরক্ষনাগারের অপ্রতুলতা এবং সংরক্ষনের নিয়ম না জানা। (৮) সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকা, আড়তদার ও পাইকারদের অর্তলোলুপ দৃষ্টি, নির্দিষ্ট কোন দাম না থাকা এবং ফড়িয়াদের উৎপাত। আমি কোন কৃষি গবেষক নই। তাই অনেক বিষয়ই হয়তো আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারবো বেশিরভাগ জেলাভিত্তিক সাংবাদিকই অন্তত উপরের বিষয়গুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল নয় অথবা হতে রাজি নন।

কারণ কৃষিভিত্তিক সংবাদ কভারেজের জন্য কৃষকরা সাংবাদিকদের কোন সম্মানী দেন না। রাজনৈতিক প্রেস রিলিজ, ব্যাবসায়িক কর্মকান্ড অথবা বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি সভা সেমিনারে তাদের জন্য দুপুরের খাবার এবং একটি অর্ধমোটাংকের সম্মানীর বন্দোবস্ত রাখেন বলেই সাংবাদিকদের পদচারনায় মুখরিত থাকে জেলা শহরের কনফারেন্স হল অথবা কমিউনিটি সেন্টারগুলো। ক্ষুদ্রঋণ সংক্রান্ত জটিলতায় প্রতিদিন যে হারে ঋণগ্রহীতারা নি:স্ব হচ্ছে, ফসলী জমি, বাড়িঘর হারাচ্ছে এমনকি শারিরীকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছে তার ক'টাই বা মিডিয়ায় স্থান করে নিচ্ছে? সেসব ঘটনা ধামাচাপা পড়ে নিদারুন বাস্তবতায়। অথচ এ ক্ষুদ্রঋণ অন্তত কৃষকদের কোন কাজেই আসে না। ঋণ গ্রহনের পরবর্তী সপ্তাহ থেকে কৃষককে যে ঋণ শোধ করতে হয়, তার উপযোগিতা আসলেই কতটুকু? প্রতিটি উপজেলায় কৃষি সংক্রান্ত গড়ে ৭/৮জন করে সরকারি কর্মকর্তা করে।

উত্তরাঞ্চল এবং চরাঞ্চলে যা আরো বেশি। কোথাও কোথাও কবে যে সংশ্লিষ্ট অফিসের তালা খোলা হয়েছে তার কোন খবর নেই। অথচ সাধারণ মানুষের প্রদেয় করের পুরোটাই তাদের পেটে যাচ্ছে। আসলে তাদের কাজ কি? যখন এ বিষয়ক সেমিনার অথবা কনভেনশনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের ডাকা হয়, তখন প্রত্যক্ষদর্শী অথবা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ শুনে উপস্থিত কর্মকর্তাগণ চোখ কপালে উঠিয়ে বলে " আমরাতো বিষয়গুলো জানি না"। হ্যাঁ আমরা যারা সাধারণ নাগরিক অনেকেই বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিই।

কিন্তু কেন নেব? সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না কেন? নিশ্চিতকরণে কার কতটুকু দায়িত্ব রয়েছে? এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কি কি ভূমিকা থাকা উচিত? নাকি কোন ভূমিকা থাকায়ই উচিত নয়? চলতি মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত (আমার নিজের সংগৃহীত খবর মতে) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কৃষি ভিত্তিক খবর এসেছে ১৩টি, সমকালে ১৫টি, যায়যায়দিনে ১০টি এবং ডেসটিনিতে এসেছে ২৪টি (ওয়েব ভার্সন থেকে)। অন্যান্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে পর্যায়ক্রমে আমার দেশ, সংবাদ এবং প্রথম আলো (প্রিন্ট ভার্সন) ভালো সংবাদ কভারেজ দেয়। কিন্তু হতাশাজনকভাবে যুগান্তর, জনকন্ঠ, ইনকিলাবসহ বেশকিছু পত্রিকা কৃষিভিত্তিক খবরকে প্রাধান্য দেয় না বললেই চলে। গত মাসে দৈনিক জনকন্ঠ দু'সংখ্যায় মাত্র ৩টি নিউজ ছাপায়। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার কভারেজ সম্পর্কে আমার ভালো কোন ধারনা নেই।

উল্লেখিত পত্রিকাগুলোর খবরেরও আবার ধরনে বৈচিত্রতা আছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ নিউজই সার ও বীজ ডিলারদের নিয়ে। যেখানে ব্যক্তিগত বিরোধ কাজ করে। এক ডিলার অন্য ডিলারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন অথবা কোন ডিলারের ঘরে ভেজাল সার অথবা বীজ পাওয়া গেছে.... এরকম। যেখানে সাংবাদিকদের একধরনের আয় হয়।

তার পরের অবস্থানে আছে সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাকীয়। যা আবার কোন তৃণমূল সংবাদের উপর ভিত্তি করে নয়, সরকারের গৃহীত কোন পদক্ষেপ অথবা ভুল সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে এসব সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা হয়। অনুসন্ধানীমূলক খবরের পরিমান এতোই অল্প যে, সেগুলো উল্লেখ করা আর অর্বাচীন পক্ষপাতিত্ব করা একই হবে। তাই ওই সাহস আমি করলাম না। আসলে সাংবাদিকরা যখন মাছ বিক্রেতা বা রিকশাওয়ালাকে পাওনা টাকা কম দিতে গিয়ে নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিতে অভ্যস্ত, ধ্বজাভাঙ্গা মটর সাইকেলের নম্বরপ্লেটে "সাংবাদিক-আবেদিত" লিখে রাখে তখন আমরা এসকল মহৎ পেশাজীবীদের কাছে তেমন কিছুই আশা করতে পারি না।

এ লেখাটি মোটেও সৎ এবং সৃষ্টিশীল সাংবাদিকদের হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং সংখ্যাগুরু অসৎ এবং অযোগ্য সাংবাদিকদের কথা বলার জন্যই সৃষ্ট। কৃষি বিষয়ক সংবাদের কভারেজ পুরোপুরিই আঞ্চলিক প্রতিনিধি এবং বিশেষ প্রতিবেদকদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু সাংবাদিকরা যখন অন্যের সংগৃহীত খবরের আশায় বসে থাকে তখন আসলে পত্রিকাগুলোয় কতটুকু কৃষি কভারেজ আসতে পারে? একজন নাগরিক হিসেবে এসকল "মহৎ পেশাজীবী"গণের উপর নূন্যতম আস্থা বা ভালো কিছু আশা করি না। আবার এদেরকে যে যে মাধ্যম লালন-পালন করে তাদের প্রতিও আশা করতে চাই না। তবুও বলি- কৃষি এবং কৃষকদের সমস্যা, সরকারি অব্যবস্থাপনা, অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড, অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত এনজিও সমূহের সক্রিয়তা এবং সর্বোপরি স্থায়িত্বশীল কৃষি সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়নের পক্ষে পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলোর উচিত তাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিগণের মাঝে কর্মচাঞ্চল্যতা বাড়ানো এবং সমস্যার গভীরে গিয়ে বেশি বেশি অনুসন্দানীমূলক খবর সংগ্রহের তাগিদ দেয়া।

দেশের একজন নাগরিকও কৃষি নির্ভরশীলতার বাইরে নয়। আমাদের কৃষি আজ হুমকীর মূখে। রাহু তাকে ঘিরে রেখেছে আপাদমস্তক। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যম সমাজের আয়না।

সে আয়নাটা আরো স্বচ্ছ হতে হবে, বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে কৃষি পুনর্জাগরণে। আমরা আসলেই অনেক কিছু আশা করতে চাই আমাদের সাংবাদিক ভাইদের কাছে। ৩০.১১.০৮ রাত ১.২০ মি.
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.