যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়ার পর স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা চালু হলে সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছিল দেশে একটা যুগান্তকারী কিছু হতে চলেছে! বলা বাহুল্য এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমাদের সামনে এমন কোন তথ্য প্রমান নাই যা দিয়ে বলা যায়,হ্যাঁ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর অমুক অমুক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে। নাই। একটিও উদাহরণ নাই। বিচার ব্যবস্থা যেহেতু এখনো বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই দুই শ’ বছর আগেকার আইন নিয়ে বিরাজমান,তাই সেই বিচার ব্যবস্থার আঁচল ধরে কেউ ‘পুলসেরাত’ও পার হতে পারেন,আবার কেউ পার হওয়ার সময় অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্তও হতে পারেন। এরকম একটি সম্ভবনাকে মাথায় রেখেই কোন এক 'প্যাটার্ণ থিংকাররা' গোলাম আযম গংদের যুদ্ধাপরাধী ঘোষণার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
ব্যাপারটা একাধারে কৌতুহলোদ্দীপক এবং শঙ্কাজনক।
কৌতুহলোদ্দীপক একারণে যে,যে প্রধান দুটি সংগঠন এই জামাত তথা গোলাম আযম,নিজামী,মুজাহিদ গংদের যুদ্ধাপরাধী ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে,যারা এই ইস্যু নিয়ে সাধারণের সম্পৃক্তা সৃষ্টি করেছে,আইনী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে সেই দুটি সংগঠন,অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই মামলা বিষয়ে কিছুই জানে না। এব্যাপারে তাদের বক্তব্য..
“একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বা তাদের কোনো সদস্য বাদী হয়ে গোলাম আযম, নিজামী, সাকাসহ ওই ৩৬ জনকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা চেয়ে মামলা দায়ের করেননি। আইনের ফাঁকফোকর রেখে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই এ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে মনে করছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। একটি স্বাধীনতা বিরোধী সক্রিয় চক্র বাদী হয়েই এ মামলা দায়ের করেছে বলে মনে করেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এম হারুন অর রশিদ বীরপ্রতীক।
তিনি আরো বলেন, ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির কোনো সংগঠন ওই মামলা দায়ের করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিষয়টি থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়া ও বিভ্রান্ত করার জন্য এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া দুর্বল যুক্তিতে মামলা দায়ের করে আদালত থেকে বিচারের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদেরকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্যও এ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন আগের ঘটনা, যুদ্ধের প্রায় ৩৭ বছর পর তাদের বিচার করতে হবে বিশেষ আদালতে।
সাধারণ আইনে ও সাধারণ আদালতে তাদের বিচার করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি বিশেষ আদালত গঠন করেই তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে,(ভোরের কাগজ,২২ নভেম্বর,২০০৮)।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে কারা, কেন এখন নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে এই কাজটি করতে গেলেন? জানা গেল ১৩ নভেম্বর ঢাকা জজ আদালতের নবীন আইনজীবী মোহাম্মদ লিটন মিয়া, মোঃ সাফায়াৎ হোসেন রাজিব ও শিক্ষানবিস আইনজীবী রাজিব আহমেদ বাদী হয়ে জামাতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ৩৬ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করার এবং জাতীয় নির্বাচন থেকে তাদেরকে বিরত রাখার জন্য ঢাকার জেলা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যারা এই কাজ করলেন তারা কোন ভাবেও সর্বজন পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধাপরাধী বিরোধী ফোরামের কেউ নন! এর আগে তাদের কখনোই এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি! তাদের সাথে কোনও ভাবে যুদ্ধাপরাধী বিরোধী কোন শক্তির মতাদর্শগত বা সাংগঠনিক যোগাযোগও নেই। যদিও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এর আগে একাধিক বার গোলাম আযম গং কে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচনে অযোগ্য করা এবং স্বাধীনতার প্রত্য বিরোধীতার জন্য বিচারের সম্মূখিন করার ব্যাপারে আন্দোলন করে আসছিল।
সর্বশেষ সের্ক্ট কমান্ডারস ফোরাম গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত প্রতিনিধি সম্মেলনে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ৫০ জন রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করে এসব অপরাধীকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
কিন্তু যে সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে আসছে সেই সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আদালতে এখনো মামলা দায়ের করেনি। এমনকি বিচারের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বা তাদের কোনো সদস্য বাদী হয়ে গোলাম আযম, নিজামী, সাকাসহ ওই ৩৬ জনকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা চেয়ে মামলা দায়ের করেননি। তাহলে কারা করলেন? যারা করলেন তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তারা আইনের ফাঁক ফোঁকোর দিয়ে এই স্বাধীনতা বিরোধীদের ‘বে-কসুর’ খালাস সহ সম্পূর্ণ আদালতের ‘ক্লিনচিট’ আদায় করে ‘অযু-গোসল’ শেষে পূঁত-পবিত্র করিয়ে আনতে চাইছেন।
এটা বোঝার জন্য মহা বিজ্ঞ আইনবিশারদ হওয়ার দরকার করে না। আইন এবং আইনের গতি ধারা অনুসরণ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
সেক্টর কমান্ডার ফোরামস বা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শুধু নয়, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ (রাজাকার,আল বদর,এবং তাদের দোসররা বাদে) একাত্তরের এই নর পশুদের বিচার চায়, আমরা জানি, যে জাতি তার জাতির শত্রুদের,স্বাধীনতার শত্রুদের, গণতন্ত্রের শত্রুদের মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন কারীদের বিচার করতে পারে না, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধা জানাবার তার আর কোন পথ নেই। যে শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের সখের সৌধ গড়ে তুলেছি, সেই শহীদের শেষ ফোঁটা রক্তবিন্দুও আমাদের ক্ষমা করতে পারে না, কারণ আমরা এখনো তাদের আত্মত্যাগকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারিনি। কিন্তু আমরা এ-ও জানি কোন সাধারণ আদালতে এই বিচার হতে পারে না।
৩৭ বছর আগের ঘটনা আমাদের প্রচলিত আইনি কাঠামোতে সঠিক ভাবে তুলে ধরার সুযোগ নেই। তাই এই বিচার হতে হবে বিশেষ আইনি আদালতে। আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং সেক্টর কমান্ডার ফোরামস ও সেই দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে।
এখন এবার যদি ওই উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিছু মানুষের দায়ের করা মামলায় যুদ্ধাপরাধীরা ‘বে-কসুর’খালাস পেয়ে আসে বা ‘আমলযোগ্য অপরাধ নয়’ বলে সার্টিফিকেট পেয়ে যায় তাহলে এই দেশে আর কখনোই এদের বিচার করা যাবে না। যে ঘটনাটি ঘটেছিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায়।
ওরা কি সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছেন? এই সুযোগে ফাঁক ফোঁকোর গলে কি আদপেই যুদ্ধাপরাধীরা নিঃষ্কলঙ্ক হয়ে বেরিয়ে আসবে? এই প্রশ্নটার উত্তর জাতির জন্য এই মুহূর্তে সমাধান করা অত্যন্ত জরুরী। এর সমাধান না হলে বাউলের ভাষ্কর্য ভাঙ্গা,রাজশাহী বিশ্বাবদ্যালয়ে নাট্য সংগঠন নিষিদ্ধ করা,এবং ভয়ংকর বিজ্জনক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে,
প্রগতিশীলদেরকে প্রকাশ্যে হত্যা করার উদ্ধত আচরণের প্রতিকার প্রতিরোধ করা যাবে না। আমাদের নাকের ডগা দিয়ে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হন্তারকরা দাঁপিয়ে বেড়াবে। আর আমাদের বাজারী গণতন্ত্রীরা কেবলই গণতন্ত্র এবং ন্যায়-নীতির ভেরেন্ডা বাজিয়ে যাবেন !
২২ নভেম্বর,২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।