সত্য বিস্মৃত রাজনীতির ফসল
ফকির ইলিয়াস
-------------------------------------------------------------
বাংলাদেশে ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন না হলে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এর হিসাবটি রাজনীতিকদের অজানা নয়। তারপরও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া নানা ধরনের আলটিমেটাম দিয়ে যাচ্ছেন কেন? এর কারণ কি? তাহলে কি বেগম জিয়া বুঝে নিয়েছেন, নির্বাচনী ফলাফল চারদলীয় জোটের অনুকূলে নাও আসতে পারে?
চারদলীয় জোট এই দেশে ক্ষমতার স্খায়ী বন্দোবস্ত চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, ‘সংবিধানের’ দোহাই দিয়ে তারা একটি স্খায়ী ত্রাসের রাজত্ব বজায় রাখবে। হাওয়া ভবনের নামে তাই তারা এ দেশে এমন এক ধরনের দুর্নীতি-লুটপাট শুরু করেছিল, যা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুকুরচুরি বলে বিবেচনা করছিল দেশের মানুষ। খয়রাতের ঢেউটিন যখন এমপিরা নিজের কাজে লাগায়, গুঁড়োদুধ যখন নিজের পুকুরের মাছকে খাওয়ায় তখন জনগণের আর কিছু বলার থাকে না।
জোট সরকারের শেষ সময়ে এসে দেশের মানুষ সবকিছু বলা ব করে দিয়েছিল প্রায়। সেই সরকারের বড় বড় মন্ত্রী, একাত্তরের ঘাতক রাজাকার মন্ত্রীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেই বেড়াচ্ছিলেন, দেশ উন্নয়নে ভেসে যাচ্ছে। তারা ছক তৈরি করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানও হবেন চারদলের তাঁবেদার। আর সে লক্ষ্যে তারা সংবিধান রক্ষার নামে রাষ্ট্রপতিকেই তদারকি সরকারের প্রধান করেছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে। জনগণ সেদিন হেসেছিল।
হেসেছিল গোটা বিশ্ববাসী। এটা ছিল সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাংবিধানিক কৌতুক।
চারদলীয় জোটের সেই তীব্র সামন্তবাদকে ভেঙে খান খান করে দেয়ার জন্যই এদেশে ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। আমি সে প্রশ্নটি আজও করছি তখন কোথায় গিয়েছিল বেগম জিয়ার সাংবিধানিক দোহাই? সবকিছু খামোশ করে দিয়ে ওয়ান ইলেভেনের নায়করা যখন ক্ষমতার বিবর্তন ঘটান তখন চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। এর পরের ঘটনাবলি সবার জানা।
দুই প্রধান দলের অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকে। মামলা হয়। তারপর হাজত বাস। এরপর জামিন। যারা দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন, লজ্জায় তাদের রাজনীতি ছেড়ে দেয়াই উচিত ছিল।
তারা তা না করে বরং এখন নানা হুঙ্কার ছাড়ছেন। কীভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন সেই দরকষাকষি করছেন। নতুনভাবে লুটপাটের হিসাব করছেন।
বেগম খালেদা জিয়া তার সর্বশেষ চারদফার মাধ্যমে জনগণের চোখকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাইছেন। হজযাত্রীদের ভোট দেয়ার ব্যবস্খা গ্রহণের দাবিও এখন তাদের একটি ইস্যু।
দশ লাখেরও বেশি অভিবাসী বাঙালি শুধু ইংল্যান্ডেই থাকেন। সব মিলিয়ে বিদেশে কর্মরত আবাসী-অনাবাসী বাঙালির সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ লাখের কাছাকাছি। এদের ভোটাধিকারের সুষ্ঠু সুরাহা এখনও হয়নি। তাহলে তো মাননীয় হজযাত্রীদের জন্য অ্যাবসেন্টি ব্যালটের ব্যবস্খাই করতে পারেন নির্বাচন কমিশন। তারা চাইলে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দতাবাসের মাধ্যমেও ভোট দিতে পারেন।
কিন্তু আমার মত হচ্ছে, এবার তারা হজ করতে যাচ্ছেন, সুতরাং মহান আল্লাহর রাহেই তাদের বেশি সময় ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশের নির্বাচনে এবার তারা ভোট দিতে না পারলেও এমন ক্ষতি কি? জীবনে ভোট তো তারা অনেক দিয়েছেন। বেঁচে থাকলে আরও দেবেন। চারদলীয় জোট এটাকে অহেতুক একটা বড় ইস্যুতে পরিণত করার চেষ্টা করছেন কেন?
দুই.
চারদলীয় জোট যখন এসব টালবাহানায় ব্যস্ত তখন সুধা সদনের সামনে মিছিল করছে আওয়ামী লীগাররা নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা বেশকিছু আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র বরাদ্দ করেছেন।
বেশ ক’জন মধ্যম শ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা এবার মনোনয়ন পাননি। বরং তারা অর্ধচন্দ্র খেয়েছেন।
বেশকিছু আসনে আওয়ামী লীগ নেত্রী এমন কিছু দলীয় কর্মীকে মনোনয়ন দিয়েছেন যাদের নামও এলাকার মানুষ ভাল করে শোনেননি। এদের চেনেনও না। এর মাধ্যমে দলীয় সভানেত্রী সব ‘সংস্কারপন্থি’ তরুণ নেতাদের জানাতে চেয়েছেন বিদ্রোহের ফল কি হতে পারে।
এই নবীন এবং অপরিচিতদের মনোনয়ন দেয়ার অন্য উদ্দেশ্যও আছে। আর তা হচ্ছে ওইসব আসনের সিংহভাগই চৌদ্দদলীয় মহাজোটের অন্য শরিকদের দেয়া হবে।
অতএব মনোনয়ন পেলেই যে কেউ আওয়ামী মহাজোটের প্রার্থী হতে পারছেন, তেমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে কথা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের যদি মনোনয়ন দেয়ার অগ্রাধিকার দল বিবেচনা করে থাকে তবে তো যোগ্য ও ত্যাগীরাই প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়ার কথা। নাকি শেখ হাসিনা নতুন রাজনৈতিক ট্রেন্ড চালু করে দলের অভ্যন্তরীণ ‘বাধ্য’ এবং ‘বিদ্রোহী’ শাখাগুলো চিহ্নিত করতে চান?
একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের প্রথম প্রায়োরিটি থাকা উচিত তার দেশের স্বার্থ।
দেশের স্বার্থে কীভাবে একযোগে কাজ করতে হয় তা আবারও দেখিয়ে দিয়েছেন মার্কিনি দুই রাজনীতিক। বারাক ওবামা দীর্ঘ মিটিং করেছেন পরাজিত প্রার্থী জন ম্যাককেইনের সঙ্গে। তারা পরস্পরকে সাহায্যের সুদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে যা যা করণীয়, তারা উভয়ে তা করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির এটাই হচ্ছে প্রকৃত সৌন্দর্য।
বাংলাদেশে যদি এর পাঁচ শতাংশও বাস্তবায়িত হতো তবে পাল্টে যেত দেশের রাজনীতিক চেহারা।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করছে দেশের মানুষ। ট্রুথ কমিশন হোঁচট খেয়েছে আদালতে। এর ভবিষ্যৎ কি, আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নির্ভর করছে আগামী সরকারের ওপর। অন্যদিকে মহাজোটের অন্যতম শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচন এবং ক্ষমতার ভাগবন্টন নিয়ে দীর্ঘ মিটিং করেছে শেখ হাসিনার সঙ্গে।
আমি টিভিতে যখন হাসিনা-এরশাদ বৈঠকের একান্ত দৃশ্যটি দেখছিলাম তখন আমার মনে পড়ছিল সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা। দেশে তো বটেই, বিদেশেও তীব্রভাবে গড়ে উঠেছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। নর হোসেন, মিলন, বসুনিয়া, সেলিম, দেলওয়ারের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল যে এরশাদের হাত, তিনি এই বাংলায় নির্বাচনে জিতে আবার মহাজোটের ‘রাষ্ট্রপতি’ হতে চান। এরশাদের দাবি, তার হাতে এ বিষয়ে লিখিত চুক্তিও নাকি রয়েছে।
বেগম জিয়ার ঘাড়ে সওয়ার হতে ঘাতক রাজাকার এবং শেখ হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ঘাতক স্বৈরাচার নব্য প্রতিষ্ঠা চাইছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
একদিন হয়তো কেউ কেউ বলবে, এই দেশে ভাষা আন্দোলন হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়নি। ক্ষমতার মোহে এভাবেই সত্য থেকে বিস্মৃত হওয়া যায়? এমন হওয়া উচিত কি? সত্যকে অস্বীকার করে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন রচনার হামাগুড়ি দিচ্ছেন এরা রাষ্ট্রের প্রকৃত বু হতে পারেন না। রাজাকার এবং স্বৈরাচার দুই অপশক্তিই গণতন্ত্রের দুশমন।
নিউইয়র্ক ১৮ নভেম্বর, ২০০৮
---------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ২১ নভেম্বর ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।