[আগের দুই পর্বে আশাতীত সাড়া দেবার জন্য আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, প্রিয় সহযাত্রীগণ। আজকে তৃতীয় পর্ব। ]
শ্রেণীর সঙ্গে বিত্তের একটা সম্পর্ক আছে, তা তো বলাইবাহুল্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে - উচ্চবিত্ত বলতেই যেমন প্রাচুর্যপূর্ণ বিত্তসম্পন্ন শ্রেণীটির কথা মনে আসে, নিম্নবিত্ত বলতেই যেমন বিত্তের অভাবে বিপর্যস্ত ও নিগৃহিত শ্রেণীটির চেহারা ভেসে ওঠে, মধ্যবিত্ত বললে সেরকম কোনো সুনির্দিষ্ট চেহারা ভাসে না। ফলে, বিত্তের বিচারে কে যে মধ্যবিত্ত সেটাই নির্ধারণ করা দুস্কর হয়ে ওঠে।
তবু বিত্তের বিচারে এই শ্রেণীটির একটি সংজ্ঞা দাঁড় করাতে চাইলে কেউ হয়তো বলবেন - যে শ্রেণীর বিত্ত-সম্পদের পরিমাণ উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণের মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্থানে আছে তাকে বলা যায় মধ্যবিত্ত। কিন্তু এই সংজ্ঞা দিয়ে মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করা যাবে না, কারণ বিভিন্ন দেশে মধ্যবিত্তের সম্পদের পরিমাণ ও জীবনযাপনের ধরন একই নয়। অর্থাৎ এমন কোনো আন্তর্জাতিক পরিমাপ নেই যা দিয়ে সব দেশের মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করা যায়। অন্য দুই শ্রেণীর বিত্তের সঙ্গে তুলনা করতে হলে আগে দেখতে হবে ঠিক কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে একজনকে উচ্চবিত্ত বলা যাবে বা ঠিক কতোটুকু বিত্তহীন হলে তাকে আমরা নিম্নবিত্ত বলবো। এই বিবেচনায় একজন ইউরোপীয় বা আরব উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণ আর বাংলাদেশের একজন উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণ নিশ্চয়ই এক হবে না।
উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত হবারও তো কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই! অতএব বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত আর ইউরোপিয়ান/আমেরিকান/আরব মধ্যবিত্ত এক জিনিস নয়। আর সমস্যাটা এখানেই। বিষয়টি অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয় বলে তারা একই তত্ত্ব দিয়ে দুই দেশের একটি শ্রেণীকে ব্যাখ্যা করতে চান এবং তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। বিভিন্ন দেশের মধ্যবিত্তদের সম্পদের পরিমাণ যেমন বিভিন্ন হতে পারে, তেমনই এই শ্রেণীতে সম্পদের বিভিন্নতার কারণে তৈরি হতে পারে বিভিন্ন উপশ্রেণী - যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশে। এইসব উপশ্রেণীর অস্তিত্বই বলে দেয় যে, মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করার একমাত্র উপায় সম্পদ নয়।
আরো কিছু আছে।
সেগুলো কি কি?
দু-একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করি। মধ্যবিত্ত শব্দটির সঙ্গে বোধহয় শহর বা নগরের একটা সম্পর্ক আছে, আমরা মোটামুটিভাবে ওই শব্দটি দিয়ে শহুরেদের কথাই বলি। কি রকম? ধরুন, এই আমাদের কথাই - যারা এই শহরে বাস করছি, চাকরি বাকরি করছি, কিংবা টুকটাক ব্যবসা-বানিজ্য (যে ব্যবসা দোকানদারির ওপরে কোনোদিনই ওঠে না) করে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত আছি এবং সমাজে মধ্যবিত্ত বলে একটা পরিচিতি ও মর্যাদা পাচ্ছি, তাদের সঙ্গে গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল একজন কৃষকের তুলনা করা যেতে পারে। হয়তো ঐ স্বচ্ছল কৃষকটির আয় ও ব্যয়ের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য আছে এবং সারা বছরে হয়তো তার কিছু উদ্বৃত্তও থাকে।
জমিজমা-বাড়িঘর ইত্যাদির হিসাব নিলে বিত্তের বিচারে ওই কৃষক অবশ্যই একজন মধ্যবিত্ত। অন্যদিকে এই আমরা - সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষ - উদ্বৃত্তের কথা ভাবতেই পারি না, খানিকটা সঞ্চয়ের জন্য আমাদের রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়, তবু আমরাই মধ্যবিত্ত - গ্রামের ওই কৃষকটি 'কৃষক'ই অথবা বড়জোর 'শ্রমজীবী'।
নগর-সম্পর্ক ছাড়াও মধ্যবিত্তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো অ্যাকাডেমিক শিক্ষা। তবে কেবলমাত্র শিক্ষাই সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। এর একটি উদাহরণও দেয়া যায়।
একবার 'বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প' নামে একটি কার্যক্রম চালু করা হয়েছিলো, যার উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এই কার্যক্রমের আওতায় ঢাকার রাস্তায় অনেকগুলো বাস নেমেছিলো - সম্ভবত অনেকেরই তা চোখে পড়েছে। এইসব বাসের চালকরা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু বাসযাত্রীরা এবং সমাজের অন্যান্য মানুষ তাদেরকে কখনোই একজন বাস ড্রাইভারের চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি, তারচেয়ে বেশি কোনো মর্যাদা দেয়নি। অথচ এই ড্রাইভারটির যে সহপাঠী কোনো উচ্চপদে চাকরি করেছে তাকে ঠিকই মর্যাদাপূর্ণ আসনটি ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে - শুধু শিক্ষা হলেই চলে না, চাই একটি ভালো চাকরিও! এমনকি আজও আমাদের সমাজ শিক্ষিত যুবকদের ব্যবসা করাটাকে ভালো চোখে দেখে না। অর্থাৎ বিত্ত-শিক্ষা ছাড়াও সমাজে একটি মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বশীল অবস্থান মধ্যবিত্ত হওয়ার অনেকগুলো উপাদানের অন্যতম একটি উপাদান।
তাহলে কি বিত্ত, শিক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থান দিয়েই এই শ্রেণীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যাবে? এখানে সঙ্গত কারণেই নারীদের প্রসঙ্গ এসে যায়। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার বলে যাদেরকে চিহ্নিত করি, সেসব পরিবারের বেশিরভাগ নারীরই উচ্চশিক্ষা নেই, তারা কোনো সম্পদের বা বিত্তের মালিক নন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত নন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের কোনো আলাদা আইডেন্টিটি নেই - স্বামী বা বাবার পরিচয়ে তাদেরকে পরিচিত হতে হয় - তাহলে তাদেরকে কীভাবে মধ্যবিত্ত বলা হয়, কেনই-বা বলা হয়? কোনো বিচারেই তো তারা এই শ্রেণীতে পড়েন না! তাহলে?
এর কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদেরকে আরো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। সেটি হলো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ।
প্রকৃতপক্ষে এই মূল্যবোধই মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এবং এই মূল্যবোধগুলো মধ্যবিত্ত পুরুষদের চেয়ে নারীরা অনেক কঠোরভাবে ধারণ করে থাকেন। পুরুষরা অনেকসময় এসব ঝেড়ে ফেলতে চায়, বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্তের সীমানা ডিঙিয়ে উচ্চবিত্তের এলাকায় ঢুকতে চায়, তাদের জন্য এই ঝেড়ে ফেলাটা খুবই জরুরী। কিন্তু তারা প্রথম বাধাটা পায় নারীদের কাছ থেকেই - মা, বোন, স্ত্রী, এমনকি কন্যার কাছ থেকেও। যাহোক এ প্রসঙ্গে একটু পরে কথা বলা যাবে।
তার আগে বলা দরকার যে, মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই মূল্যবোধ। এই শ্রেণীর মূল্যবোধ-নীতিবোধ-ঔচিত্যবোধ সবই বহু ভুলভ্রান্তি, স্ববিরোধিতা ও পরস্পরবিরোধিতায় ভরা। শুধু তাই নয় - এগুলো প্রায় ভাঙাচোরা, জোড়াতালি মারা। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, যেমনই হোক এদের একটা মূল্যবোধ আছে। কথাটা অবশ্য কেমন যেন শোনায়, কারণ মূল্যবোধ সব শ্রেণীরই থাকে - তাদের নিজেদের মতো করে, হতে পারে তা মধ্যবিত্ত-মূল্যবোধের মতো নয় - অন্যরকম, কিন্তু অন্যরকম মানে তো খারাপ নয়! কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল্যবোধের কথা উঠলেই মধ্যবিত্ত-মূল্যবোধের কথা মনে পড়ে কেন? পড়ে কারণ - এই শ্রেণীর অন্তর্গত চিন্তাশীল অংশটি বেশ জোরেশোরে তাদের মূল্যবোধের কথা বলে, ফলাও করে প্রচার করে, মূল্যবোধে সংযোজন-বিয়োজন ঘটায়, এসবের পক্ষে প্রবলভাবে দাঁড়ায়, ব্যাখ্যা করে, কোথাও এতটুকু ব্যাত্যয় দেখলো গেলো গেলো বলে রব তোলে এবং এসব মূল্যবোধগুলোকেই জগতের পক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় (এবং অনিবার্য এবং অনস্বীকার্য) মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে।
অন্য শ্রেণীর লোকজন তা করে না। মধ্যবিত্তরা এতটাই সোচ্চার ও দৃঢ়কণ্ঠ যে, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণীও তাদের কথায় আস্থা রেখে সেই মূল্যবোধকেই সত্য হিসেবে ধরে নেয়। তারা যা বলে তার কতটুকু তারা নিজেরা পালন করে সেটা অবশ্য একটি সঙ্গত প্রশ্ন, এবং সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর কেউ না পেলেও একথা বলা যায় যে, তারা একটি ব্যাপারে তুমুলভাবে সফল হয়েছেন - নিজেদের কথাগুলো তারা বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন।
ফলে, এমনকি, উচ্চবিত্তরা সমাজের সবচেয়ে সুবিধাজনক ও ক্ষমতাশালী অবস্থানে থাকলেও নিজেদের নিজস্ব মূল্যবোধগুলোর কথা জোরেশোরে বলার সাহস পায় না। জোরেশোরে দূরে থাক, নিম্নকণ্ঠেও বলে না - বরং তাদের আদৌ কোনো ভিন্ন রকমের মূল্যবোধ আছে কী না, কেউ তা জানতেই পারে না।
সমাজের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার ফলে তাদেরকে নানা সভা সমাবেশে যেতে হয়, প্রিন্ট মিডিয়ায় নানান বাণী দিতে হয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চেহারা দেখাতে হয় (বস্তুত এগুলো তাদেরই সম্পত্তি), আর এসব জায়গায় গিয়ে তাদেরকেও মূল্যবোধ, নীতিবোধ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো - তারা যা কিছু বলে তা-ও মধ্যবিত্তদের শিখিয়ে দেয়া! নিজেরা যে মধ্যবিত্তের সীমানা ডিঙ্গানোর সময় এসবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছিলো (অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একথা বলা যায় যে, এদেশের উচ্চবিত্তরা মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে এসেছে, এবং এই রূপান্তরের জন্য তাদেরকে মূল্যবোধ-বিরোধী অনেক কাজ করতে হয়েছে। অন্তত আমাদের উচ্চবিত্তদের উচ্চবিত্ত হবার পেছেনে একটা না একটা লুটের বা চুরির বা ডাকাতির বা লাম্পট্যের গল্প আছেই। প্রায় কেউই সৎপথে 'বড়লোক' হয়নি, অন্তত এদেশে), সেটা তারা এমনভাবে চেপে যায় যে, মনে হয়, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ রয়েছে! অন্যদিকে নিম্নবিত্তেরও কিছু মূল্যবোধ আছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে তাদের মধ্যে কথা বলার কেউ নেই। এখানটায় উচ্চ- ও নিম্নবিত্তের মধ্যে চমৎকার মিল আছে - উভয়েরই কথা বলার জন্য বুদ্ধিজীবী নেই।
বুদ্ধিজীবী আছে কেবল মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে, অন্য কোনো শ্রেণীর তা নেই - এটি মধ্যবিত্তের আরেকটি পরিচয়চিহ্ন।
আগামী পর্বে এই শ্রেণীর জন্ম-ইতিহাস, মূল্যবোধ ও মূল্যবোধের চর্চা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইলো।
আগের পর্বগুলোর লিংক --
মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০১
Click This Link
মধ্যবিত্তের পরিচয়চিহ্ন ০২
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।