অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
আজ অঘোষিত ছুটির দিন ছিলো শহরে।
গত ৩ দিন ধরেই একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে তেমন রোমাঞ্চিত হওয়ার উপকরণ ছিলো না। বরং এই বৃষ্টি গায়ে মেখেই দৈনন্দিন জীবনযাপনের হ্যাপা সহ্য করতে হয়েছে। রাস্তায় নামলেই ভিজে একশা হয়ে ঘরে ফেরার সমস্ত পথ শীতে কুঁকড়ে থাকা।
শাওয়ারের নীচে ভুল করে দাঁড়াতে চেয়ে, পানির তীক্ষ্ণ শীতল শরবিদ্ধ হয়ে পালিয়ে আসা কাঁপতে কাঁপতে।
সুতরাং গা গোসল বন্ধ করে দুদিন শরীরে রেক্সোনা মেখে ঘুরতে হলো।
গতকাল সারারাত এলেমেলো হাওয়ায় জানালার পর্দা কেঁপেছে, তবে সংবাদের সাথে সংশ্রবহীন জীবনে জানতে পারি নি কক্সবাজারের নিম্নচাপ রেশমী হয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সারারাত ঘুম আর না ঘুমানোর ভেতরে কাঁটিয়ে যখন সেহেরীর একটু পরেই উঠতে হলো , সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যথারীতি বৃষ্টিকে অভিসম্পাত মনে মনে।
রেইনি ডের বন্ধ অনেক দিন নেওয়া হয় না। এমনও কিছু কিছু দিন আসে যখন নিজেই নিজেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
এমন অঘোষিত ছুটি ঘোষণা করে আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমানো যায় আয়েশ করে। আগাপাশতলা ভেবে সেই ইচ্ছাকে দমন করেই রাস্তায় নামলাম ছাতা মাথায়। এই বর্ষায় অনেক দাম দিয়ে ছাতা কিনেছিলাম, তবে আমার মতো অভাগার যা হয়, ছাতা কেনার পর থেকেই বৃষ্টির নাইট ডিউটি, সারাদিন ভারবাহী গাধার মতো ছাতা ব্যাগি নিয়ে ঘুরি, আর আষাঢ় আর শ্রাবন , বাংলার বর্ষা ঢাকা শহরে তার কান্না রেখে গেলো রাতের অন্ধকারে। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে সামনের রাস্তায় জমা পানিতে ঝকঝকে আকাশের প্রতিফলন দেখে বুঝেছি গত রাতে ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিলো। সারা দিন বৃষ্টির অপেক্ষায় ছাতাব্যাগে শহরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।
এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে কায়দা করে নতুন কেনা ছাতা দেখাবো মানুষকে। তেমন উপলক্ষ্য পেলাম না।
তবে এই কার্তিক মাসে যখন রাস্তায় গরম কুকুরেরা নির্লিপ্ত সঙ্গম করবে তখন আকাশের মুখ গোমড়া। বলা যায় না হয়তো সদ্য জেগে উঠা বাংলাদেশের ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ আকাশের মেঘেরাও ইসলামী চেতনায় ঋদ্ধ। এই অবসরে আসলে মন্দের ভালো হলো ছাতা কেনার টাকার সদগতি হচ্ছে।
আমিও সেই নতুন ছাতা বৃষ্টিতে ধুতে পারলাম। শহরের মানুষ অন্তত দেখতে পেলো আমারও ছাতা আছে, যেখানে সেখানে আদুর মাথায় ঘুরে বেড়ানোর দিন শেষ।
সামনের রাস্তার পানি এড়িয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছানোর নানবিধ কসরত, প্রায় রিকশাশূণ্য শহরের গুটিকতক রিকশাওয়ালাকে ভাই, মামা, চাচা নানাবিধ সম্বোধনের পরেও মন যোগাতে ব্যর্থ হয়েই কাদাপানি আর সুয়ারেজের পাইপ বেয়ে চলে আসা আবর্জনায় মাখামাখি হয়েই বড় রাস্তায় যাওয়ার প্রচেষ্টা।
বাস কাউন্টারে পৌঁছানোর পরে দেখলাম লাইনে আমিই প্রথম ব্যক্তি, একটু অবাক হলেও ঘড়িতে দেখলাম ৭টা ১৮, অথচ শুকনার দিনে বাসা থেকে এখানে হেঁটে পৌঁছাতে খুব বেশী হলে ৭ মিনিট লাগে, এই পানি না ছোঁয়ার প্রতিজ্ঞায় আমি ১৫ মিনিট লাগিয়ে পেরিয়েছি এতটুকু পথ।
শহরের রাস্তায় তেমন ভীড় নেই, প্রাইভেট কারগুলো অন্য সময় পানি ছিটিয়ে ছুটে যায়, আজ রাস্তায় ট্রাফিক বলতে আমার মতো গুটিকয় বেকুব ছত্রধারী, আর সিএনজির ভেতরে আয়েশ করে বসে থাকা একাকী মানুষ।
রিকশার পাত্তা নেই।
শেষ পর্যন্ত বাস এসে পৌঁছালো কাউন্টারে, রাস্তার শেষ সীমানায় বাসকে টিকেট চেয়েছি, সে টিকেট যখন হাতে দিলো তখন বাস কাউন্টার ছেড়ে চলে গেছে। চলতি বাসকে থামিয়ে উঠলাম বাসে, ৫২ সীটের বাসে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আসে খুব বেশী হলে ২০ জন মানুষ। বাসের সীট ভেজা, জানালার কাঁচ ঝাপসা। অবশ্য এমন পরিস্থিতি নতুন না, এক দিন সমস্ত রাস্তাই এই বাসে ড্রাইভার আর হেলপার বাদে মানুষ ছিলো ৪ জন।
তবে ৭টা ২৫এর বাসে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না তেমন।
এমন ফাঁকা বাসে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, যখন অনেকগুলো স্থানেই অধিস্থিত হওয়া সম্ভব তখন কোথায় বাথান গড়বো এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেই হয়। শেষ পর্যন্ত একেবারে শেষের সীটে গিয়ে বসে পড়লাম।
জানলার ঝাপসা কাঁচের উপর দিয়ে পানি পড়ছে। রাস্তার অন্য পাশের ঠেলা গাড়ী ভর্তি পাকা কলা, মানে গাঢ় হলুদ কলা দেখে মনটা ভালো হওয়ার বদলে বিষন্ন হয়ে গেলো।
কৃত্রিমতা শুধু শহরের মানুষের আচরণেই নেই বরং ইদানিং শহরের সব কিছুতেই কৃত্রিমতা। সব কিছুই প্রযুক্তির কল্যানে টেকসই হয়ে যাচ্ছে। প্রাক্তন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর প্রবাদ এখন কার্বাইডে কাঁঠাল পাকানো হয়েছে। শহরে ভেজালের মাত্রা বেড়েছে, এই পাকা কলার ভেতরেও নিশ্চিত কেমিকেল দেওয়া আছে।
সেদিন এক বন্ধু বললো, শালার কি জামানা আইলো, আগে বাজারে গেলে বেছে বেছে পোকা ছাড়া সব্জি কিনতাম, এখন বাজারে গেলেই আমি পোকাওয়ালা সব্জি খুঁজি।
পোকা যখন খেয়ে বেঁচে আছে তখন এটাতে বিষাক্ত কেমিকেল নেই। সেই পোকা ধরা সব্জির অর্ধেক ফেলে দিয়ে বাকি অর্ধেক পরিবার নিয়ে খাই।
বুদ্ধি মন্দ না, কার্বাইডে পাকানো ফল খেয়ে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে, এখন পোকা ধরা ফল দেখেই ভালো লাগবে, একপাশ পোকায় খাবে অন্য পাশ আমি, বুদ্ধের বানী ২০০৮ এ এসে এভাবেই নবজন্ম লভিবে।
বৃষ্টিতে মাখোমাখো সকালে রেডিওতে শুনলাম সুমনের গান প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বীতিয়ত আমি তোমাকে চাই, অনেক আগের কৈশোর মনে পড়লো, রাফি একদিন রাস্তায় ধরে ক্যাসেট দিয়ে বললো এই গানটা তোকে শুনতেই হবে। নতুন দিনের গান।
সুমনের তোমাকে চাইয়ের সাথে তখন পরিচয়। রাফি চারুকলার পাঠ চুকিয়ে অনেক দিন হলো ঢাকাছাড়া, ক্রমশ তার মানসিক স্থিরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছে যেকোনো বিষয়েই, প্রাণভয়ে মরিয়া একজন মানুষ মায়ের কাছে আশ্রয় খুঁজছে, সান্তনা খুঁজছে। সুমনের গানের সাথে এইসব দৃশ্য ভেসে আসে। কার্জন হলের পুকুর পাড়ে একদিন সুমন গান শুনিয়েছিলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে ঘুরে ঘুরে বাংলার ঐতিহ্যকে উপলব্ধির চেষ্টা ছিলো তার।
সেখানেই শুনেছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে তার গাওয়া গানের কিছু অংশ,
সেই সুমন বাংলাদেশের জামাই হলো, চাটুজ্যে পদবি ছেড়ে কবীর সুমন হয়ে উঠলো।
এই বিষয়টা আমাকে পীড়িত করে, মুসলিম হয়ে উঠবার বিষয়টাতে আপত্তি নেই কোনো, মানুষ যেকোনো ধর্মই গ্রহন কিংবা বর্জন করতে পারে, তবে সুমনের এই মুসলিম হয়ে উঠবার পেছনে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। ইসলামকে উপলব্ধি করে তার ধর্মান্তরিত হওয়া নয় বরং মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করবার কারণেই তার এই ধর্মত্যাগ।
এইসব ভাবনা শেষ হতে না হতেই বাস গন্তব্যে চলে আসলো। অন্য যেকোনো দিন প্রাইভেট কারের যন্ত্রনায় যে পথটা পার হতে লাগে ৪০ মিনিট, এই বৃষ্টিভেজা অঘোষিত ছুটির দিনে সেই পথটুকুই পার হতে লাগলো ১০ মিনিট। অদ্ভুত দেশ, অদ্ভুত এই ঢাকা শহরের মানুষেরা।
ব্যাংকগুলো ঋণের প্রস্তাব নিয়ে বসে আছে, গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী, সবকিছু কেনার জন্যই ঋণ দেয় তারা।
মানুষ নিচ্ছে, প্রাইভেট কারে সয়লাব হয়ে গেলো ঢাকা শহরের রাস্তা। অন্তত এই বৃষ্টি ভেজা দিনে মনে হলো একটা প্রাইভেট কার থাকলে খুব এখটা খারাপ হতো না, এই রাস্তার পানি মাড়াতে হতো না, সারাটা রাস্তায় ভেজা শরীর নিয়ে ঘুরতে হতো না। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি আমার আগাপাশতলা ভিজে চুপচুপে, সে কাপড় খুলে ফেলবার কোনো উপায় নেই।
অনেকেই নিজেকে ছুটি দিয়ে বসে আছে।
একজন বললো আসলে এই বৃষ্টির দিনে বিবাহিত মানুষেরা কেউই বৌয়ের আঁচল ছেড়ে আসতে চাচ্ছে না।
বৌ নিয়ে এই বৃষ্টির দিনে থাকবার মজাই আলাদা।
অবিবাহিত সেই ছেলেকে বললাম, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে অনেক অভিজ্ঞতা তোর, কিন্তু তোর এই অভিজ্ঞতা কোথায় হইলো, ঘরের ছাদের নীচে না কি ভেজা মাঠে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।