শুভ্র'র বয়স খুব বেশী নয়, মাত্র ১২ বছর বয়স ওর। খুব সুন্দর ছিল ছেলেটা, খুব সুন্দর করে কথা বলতো ও। মাঝেমধ্যেই ওর সাথে গল্প করে সময় কাটাতাম আমি। গল্প করতাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কখনো ওর কথা বলতো ও, কখনো আমার কথা বলতাম আমি।
কথা হতো প্রতিদিন।
কোনো এক জোছনা ভেজা রাতে আমি বসে আছি, চুপচাপ বসে থেকে জোছনা দেখছি। গাছের পাতার আড়াল থেকে অপূর্ব চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে। এক টুকরো মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে চাঁদের খানিকটা অংশ। রূপালী জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক, ভেসে যাচ্ছে অপূর্ব এ পৃথিবীটা! শুভ্র আমার কাছে এলো, পাশে এসে একদম খুব কাছ ঘেসে বসলো ও।
ওর মুখে খেলা করছে বিচিত্র এক ধরনের হাসি, চিকচিক করছে ওর চোখ দুটোও। খুব কৌতুহল নিয়ে ও কিছু প্রশ্ন করলো আমাকে।
“আচ্ছা ভাইয়া তুমি জানো কী, আমাদের দেশে ঠিক কতোজন মানুষ বাস করে ?”
আমি মাথা নেড়ে হেসে বললাম, “খুব যদি বেশী হয় তবে ১৩ কোটি। ”
“আচ্ছা এই ১৩ কোটি মানুষের প্রত্যেকে যদি ১ টাকা করে দান করে তবে তো ১৩ কোটি টাকা জমা হবে, তাই না ?”
আমি ওর কথা শুনে মৃদু হাসলাম এবং তারপর বললাম, “ তাই তো হবার কথা। ”
“ঠিক আছে, ১ টাকা নয়, সবাই যদি ৫০ পয়সা করেও দান করে তবে তো সাড়ে ছয় কোটি টাকা হবে, কী হবে না ?”
আমি ওর কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম, তারপর বললাম, “তা তো হবেই, কিন্তু কেন বলোতো ?”
আমার কথা শুনে মৃদু হাসলো ও।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “কারণ আছে। ”
শুভ্র'র চোখ দুটো চিকচিক করছে এখনো। জোছনার মৃদু রূপালী আলোয় তার চোখ দুটো আরও একটু বেশী চিকচিক করে উঠলো যেন! শুভ্র চুপ করে আছে, চুপ করে আছি আমিও। কোনো কথা বলছি না। এভাবে কাটলো আরও কিছুক্ষণ, তারপর ও আবারো বলতে শুরু করলো- “আচ্ছা ভাইয়া, আমাদের এই ১৩ কোটি মানুষের মধ্যে কমপক্ষে তো ৫ লক্ষ মানুষ সিগারেট খায়, খুব কম করে হলেও তো তারা দিনে ১টি সিগারেট খায়।
আর যদি খুব কম দামেরও হয় তবে তো তারা ১ টাকা দামের সিগারেট খায়, তাই না ?”
আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম, তারপর বললাম, “হ্যাঁ, তো কী হয়েছে ?”
আমার কথা শুনে হেসে ফেললো শুভ্রও, হেসে হেসে বললো, “কারণ আছে, খুব ভয়ংকর একটা কারণ আছে ভাইয়া!”
ধীরে ধীরে শুভ্র মাথাটা উঁচু করলো তার। তারপর দৃষ্টি মেলে দিল দিগন্ত বরাবর। দেখতে থাকলো চাঁদটাকে, যেটা এখনো এক টুকরো মেঘের নিচে লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে স্নিগ্ধ জোছনাটাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে, আমাদের চারপাশটাতে! জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবী। সে জোছনার অপূর্ব আলোয় আমরা বসে আছি, শুধু আমরা দু’জন বসে আছি।
হঠাৎ নিরবতা ভেঙে শুভ্র বলতে শুরু করলো তার কথাগুলো- “জানো ভাইয়া, আমার ১৩ কোটি টাকার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই সাড়ে ছয় কোটি টাকারও। আমি একটু বাঁচতে চাই। খুব জানো, খু-ব বাঁচতে ইচ্ছে করে আমার। ঠিক তোমাদের যেমন বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোমাদের মতো করে নীল আকাশটাকে দেখতে ইচ্ছে করে, পূর্ণিমার অপূর্ব ঐ চাঁদটাকে দেখতে ইচ্ছে করে! ঐ যে নীল ধ্র“ব তারাটাকে দেখছো, যেটার সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে তুমি, সেই নীল ধ্র“ব তারাটাকেও দেখতে ইচ্ছে করে আমার।
দু’চোখ ভরে মুগ্ধ হয়ে দেখতে ইচ্ছে করে! রঙিন একটা প্রজাপতি দেখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে দেখতেও! জানো ? আমি বেশী কিছু চাইনি, চাইও না। শুধু একটু বাঁচতে চাই আমি! জানো ভাইয়া, আমার দুটো কিডনির প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু গরীব ঘরে জন্মেছি বলে তোমাদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে আজ। বেশী না ভাইয়া, খুব যে বেশী চাইছি তাও না। মাত্র ৫০ পয়সা! তোমাদের মধ্যে থেকে মাত্র ৪ লক্ষ মানুষ যদি আমাকে ৫০ পয়সা করে দান করে, তবে জমা হবে ২ লক্ষ টাকা।
আর সেই ২ লক্ষ টাকা হলে আমি চিকিৎসা করাতে পারবো। বাঁচতে পারবো তোমাদের মতো করে। আমি আবারো হাসতে পারবো, কাঁদতে পারবো, তোমার সাথে কথা বলতে পারবো, নীল আকাশটাকে দেখতে পারবো, রূপালী জোছনাকে গায়ে মেখে আবারো আমি মুগ্ধ হয়ে বসে গল্প করতে পারবো তোমাদের সাথে। রঙিন একটা প্রজাপতিকে হয়তো একদিন ছুঁয়েও দেখতে পারবো, অনুভব করতে পারবো তার কোমলতা, অবলোকন করতে পারবো তার সৌন্দর্যও! আমাদের দেশের মাত্র ৪ লক্ষ মানুষ, মাত্র ৪ লক্ষ মানুষ যদি ৫০ পয়সা করে দান করে, যদি তারা একদিন একটা সিগারেটও না খায়, আর সে একদিনের একটা সিগারেটের টাকাটা যদি আমাকে দান করে, তাহলে আমি বাঁচবো ভাইয়া, আমি বেঁচে থাকতে পারবো তোমাদের মাঝেই!”
চোখ দুটো চিকচিক করছে শুভ্র’র, আর সে চিকচিক করা অংশটা ধীরে ধীরে জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার গাল দুটো বেঁয়ে, তপ্ত নোনা জল। ভিজে যাচ্ছে সে, ভিজে যাচ্ছে তার কোমল গাল দুটো।
যে গালে হয়তো এক সময় তার বাবা চুমু খেয়েছিলেন, বা পরম স্নেহ নিয়ে তার মা তাকে আদর করে দিয়েছিলেন একদিন, সেই গালটা ভিজে যাচ্ছে আজ! হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার চোখ দুটোও ভিজে যাচ্ছে যেন, আর সে ভেজা অংশটা জল হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার গাল দুটো বেঁয়ে।
মাথাটা নিচু করে ছিল শুভ্র, এবার মাথাটা একটু উঁচু করলো সে। অপলক দৃষ্টি মেলে দিল ঐ বিশাল আকাশটার দিকে, যে আকাশটা এখন আর নীল নেই। অপূর্ব রূপালী জোছনায় রূপালী হয়ে গেছে এখন সেটাও। হঠাৎ একটা রংধনু চোখে পড়লো তার।
সাত রঙ দিয়ে রাঙানো রংধনু নয়, রূপালী একটা রংধনু দেখলো সে, কষ্টের রংধনু!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।