সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে এক অন্ধকার রঙা মূর্তি সূর্যের উপর দাঁড়িয়ে যায়, আর তখন শেষ সেজদা দেয়ার সময় মুসল্লিরা বিষয়টা টের পেয়ে পূবের দিকে সেজদা দিতে যায়; কিন্তু তাদের ইমামের হঠাৎ খেয়াল হয় পূব দিকেতো তাদের প্রিয় কালো ঘরটি নেই। কেন তারা সেদিকে নতজানু হয়ে বসবে! তাই অসংখ্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে সূর্যের উপরে দাঁড়ানো মূর্তিটাকে ভেঙে ফেলতে। কিন্তু স্নধ্যার হলেওতো তা গনগনে, তাই মুসল্লিরা নিজেদের ভস্মে বেহেশতের অমায়িক প্রশান্তিতে শেষ অঙ্গারের মত জ্বলতে থাকে।
আমাদের অতিনিকটবর্তী প্রাচীন ভারতীয়দের বোধহয় অনেক আগেই সতর্ক থাকা উচিত ছিলো, এই পৌত্তলিকতা বিদ্বেষীদের অনুপ্রবেশের সময়টাতে। কারণ তাদের অতীত ঘাটতে গেলে দেখা যায় তারা তাদের প্রিয় কালো ঘরটি থেকে অনেক মূর্তি নির্দয় হৃদয়ে অপসারণ করেছিলো।
তারা এমনই, এবং তারা এখনও এমনই। তাদের প্রবাহিত ধর্মীয় সত্ত্বাটির বির্যবান ঘোড়াটি অনেক আগে থেকেই শিল্পীর বোধটাকে পায়ের তলে দ'লে পশ্চিম আকাশের দিকে ছুটেছে। তাদের কাছ থেকে আমরা কি করে আশা করি শিল্পীর বহুমাত্রিক হৃদয়কে মূকুট ভেবে তাদের মাথায় পরবে। তাদের কাছে শিল্পচর্চা এক পৌত্তলিকের মূর্তি পূজার মতই গর্হিত কাজ। তারা যেখানে তাদের ধর্মীয় উপনিবেশ গড়তে গিয়েছে, সেখানেই তাদের পাগলা ঘোড়াটিকে লেলিয়ে দিয়েছে গোলাপ বাগানে।
শিল্পচর্চাই যে ধর্মে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সেখানে মূর্তি ভাঙাতো খুবই সামান্য কাজ। আজ এতদিন পরে হাজার বছর প্রবাহিত ঐতিহ্যের শ্রোতে তারা যদি একটা প্রকান্ড বাঁধ দিয়েই দেয় তাহলে আর বিস্মিত হবার কি আছে!! আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু যখন আমরা সতর্ক হয়েছি বা হচ্ছি তখন ডারঊইন মহাশয়ের আধা ইউনিভার্সেল তত্ত্বটি আমাদেরকে নৈরাশ্যের শেষ সীমানায় দাঁড় করিয়ে সামনে শেষহীন মরুভূমিটিকেই শুধু দেখিয়ে দেয়। সেটা হলো "শক্তিমান সবসময়ই টিকে থাকে"। তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র কি শেই মূল্যবোধের ভিত্তিতেই তার নাটবল্টু এঁটেছে যে, অগনিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি যদি একত্রিত হয় একই আকাশের তলে তাহলে গুটিকয়েক আপন শক্তিতে শক্তিশালী শিল্পীসত্ত্বা -যারা ক্ষুদ্র শক্তির কয়েক কোটি লোকের সমান, তারা পরাজিত হয়ে যৌবনেই বৃদ্ধের কফিন বানাতে উদগ্রীব হবে।
আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না এই অনেক ক্ষুদ্র শক্তির মিলিত দানবটি একজন, কেবল মাত্র একজন শিল্পী সত্ত্বার চেয়ে শক্তিশালী। কেননা দানবটির চলার পথটি নির্দিষ্ট কারো দেখিয়ে দেয়া পথ অর্থাৎ দানবটি আদতেই অন্ধ। কিন্তু শীল্পী তার নিজের চোখটিকেই তার পথ ভেবে নিয়েছে। প্রকৃতির এই খেয়ালও আমাকে ক্লান্ত করে দেয় যে, আগুনের মত এক সত্য আবিস্কারের পাপে তারই গুপ্ত আগুন পুড়িয়ে দেয় একজন কোপার্নিকাসকে।
"ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
নড়ে চলে ধীরে"
হয় আমাদের থামাতে হবে সেই কল অথবা থামতে হবে নিজেদেরকেই।
আমার স্বপ্ন চেয়েছিল আমাদের এই রাজধানী শহরের মোড়ে মোড়ে যে ভাস্কর্য (পাথরের অপচয়) এরা একদিন নিজের অসৎ, নির্জিব সত্ত্বার কাছে প্রয়াশ্চিত্ত করতে হেটে যাবে বঙ্গপসাগরের দিকে, নিজেদেরকে বিসর্জন দিতে। কিন্তু তা হলো না আমার স্বপ্নের কাছে পরাজিত না হয়ে হলো শিল্পচর্চা (তাদের কাছে পৌত্তলিকতা) বিদ্বষী কিছু মানুষের টুপির নীচে আটকে পরা খা খা মগজের ফাঁপা অন্ধকারের কাছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিনিয়োগকৃত দড়ির কাছে। এটা আমাকে খুব বিস্মিত করেনি কারণ, তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিই এটা এবং রাট্ষ্রের কাছে যা আদি ও অকৃত্রিম ব্যবহারযোগ্য কৌশল। এবং তারা দুইই অনেক আগে থেকেই এমনই!!! তাদের কাছে একজন কবি রামদা'র ধাঁর পরীক্ষা করার বস্তু ছাড়া আর কিছুই না, নজির হুমায়ুন আযাদ। আমি আপামর ধর্মীয় বিশ্বাসে বাধ্যগত বিশ্বাসী সাধারণ মানুষকে এই অপরাধে বা গুনে দন্ডিত করতে পারি না।
দন্ডিত করতে পারি সাধারণ মানুষকে যারা নিজেদের লাভালাভের নিমিত্তে ব্যাবহারযোগ্য করে তৈরী করে চলেছে, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। আমিও চাই এই সব ভাস্কর্য নামক পাথরের অপচয়কে প্রতিস্থাপন করা হোক তবে তা ধর্মীয় প্রভাবে নয়, তা হোক কোন প্রকৃত ভাস্করের হাতুড়ির শ্পর্শে। এমনই ভাস্কর্য গড়া হোক যাকে মুর্তি বা পুতুল বলে ভুল করবে না।
এর প্রতিবাদে সচেতন শিল্পী সমাজের যে আন্দোলন চলছে তা তার পুরো সামর্থটুকু দেখাক।
কিন্তু যেসব শিল্পিরা এই আন্দোলনে
নেতৃ্ত্ব দিচ্ছে তাদের শিল্প বিষয়ক ভূমিকা
এবং পিঠটানের প্রবণতা ভুলে গেলে
আমাদের ভুলে গেলে চল্বেনা।
আর কাদের কাছে আমাদের এই সংস্কার প্রস্তাব
তাদের বিলোপ না হলে
এটা শিল্পিসত্তার পুনরমিলনী ছাড়া অন্যকিছু হবে না।
আবার এই সব শিল্পিরা সব ভুলে দৌড়াতে থাকবে
ধর্ম মন্ত্রির আদরের নাত্নির আকিকা অনুষ্ঠানে গান গাইতে বা তার
মরা বোউএর মুর্তি বানাতে।
কিন্তু আমাদের সাবধান হতে হবে সেই সব শিল্পী নামক বিভ্রান্তদের থেকে। এবং শিল্পী নামক বিভ্রান্ত বড়লোকদের হঠাৎ শিল্পপ্রমী সন্তানদের থেকে যাদের পিতা মাতারাই এইসব সরকারী সীদ্ধান্তের নীতি নির্ধারক। আরো আছে গুলশান বনানীর আধা লাস ভেগাসীয় আলোর নীচে হঠাৎ গলা চেপে ধরে লালনকে গায়ক বানিয়ে ছেড়েছে যারা।
তবে একটি সফল অভিযানে অনেক কীটানূও থাকে, প্রতিপক্ষের দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের সামর্থ প্রকাশের জন্য তাদেরকে মেনে নিতে হয় এটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের মহান সরকার মহাশয়েরা যাহারা শিল্পকে কদর করে শুধু মাত্র পথের মোড়ে মোড়ে নিজেদের মনুমেন্ট দেখার জন্য তারা যে কি, তারা যে কে, তারা এসেছে কোথা থেকে, তারা যাবেই বা কোথায় তা কম বেশি আমাদের সবারই জানা।
যাই হোক আমরা সেই সময়ের সব চলন্ত মুর্তি
যাদের প্রতিবাদের মিছিলে হাতা ছারা আর কোনো
পথ সামনে খোলা নেই
আসুন আমরা চেস্টা করিনা
একই সাইক্লন সেন্টারের ছাদের নিচে দাঁড়াতে
এই ঝড় থেকে
পরিত্রাণের পথের মানচিত্ত্র
এখন আমাদের চোখে উদ্ভাসিত।
আসুন পোড়াই পুরনো গ্রন্থ
তবে যাক ধর্মের সেই প্রাচীন মূঢ় সনাতন কলের দিকে ছুটে যাক আমাদের শেষ সামর্থবান অস্ত্রটি। যা জয় করে আনবে শিল্পীর সেই স্বাধীন, প্রাতস্বিক হৃদয়টিকে।
আমরা বরং সেই হৃদয়টিকে দিয়েই বানাব আমাদের অক্ষয় ভাস্কর্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।