বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
গ্রামের মধ্যে হোটেল কিংবা কাদামাটির প্রলেপ
রহমান সাহেব পাগলাটে ধরনের লোক। দীর্ঘদিন খুলনার ইউসুফ জুটমিলে চাকরি করেছেন। এখন গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।
স্ত্রী দীর্ঘদিন হলো মৃত। ছোট মেয়েটা ঢাকায় থাকে। বড় ছেলেটি অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া তো দূরের কথা, ঢাকাতেও কালেভদ্রে যান রহমান সাহেব। এও তাঁর এক খেয়াল।
তো, বছরখানেক হল এক নতুন খেয়ালে মেতেছেন রহমান সাহেব।
হোসেনপুর গ্রামে রীতিমতো হোটেল খুলে বসেছেন।
হোটেল মানে পৈত্রিক ভিটের ওপর কাচারিবাড়িটাই খানিক সাফসতরো করে নিয়েছেন। ছ-সাতটি ঘর। শহর থেকে অথিথি আসবে।
ঘরসংলগ্ন পরিস্কার বাথরুম করেছেন। শহরের অতিথির প্রথম দাবী ঘর সংলগ্ন পরিস্কার বাথরুম । খববেরর কাগজের বিজ্ঞাপনে সে কথা বলাও হয়। কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়। হোক।
হোটেল থেকে আয়ও তো হবে। হচ্ছেও। শহরের পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে লোক আসছে । খরচ তো কক্সবাজারের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ। তবু রহমান সাহেবের আয় ভালোই।
টাকা জমিয়ে মায়ের নামে গ্রামে একটা বার্ধক্যনিবাস করবেন ভাবছেন।
হোটেলের রাঁধুনি রাঙার মা। বৃদ্ধা। বিধবা। স্বামী মরার পর ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
পুবপাড়ায় খালপাড়ে বসেছিল। কথাটা শামসুলের মুখে শুনে রহমান সাহেব নিজে গিয়ে ডেকে এনেছেন।
তা, হোসেনপুর গ্রামটি এমন কিছু আহামড়ি নয়। তবে যথারীতি সবুজ। আর শহর হল ধূসর।
শহরের মানুষ হোসেনপুরে এলে চোখের আরাম টের পায়। এখানে আকাশের নিচে বিস্তর চাষের জমি। গাছপালা। মাঠ। পুকুর।
গ্রামের পুব দিকে বড় একটা দিঘী। লোকে বলে, চন্দ্রদিঘী। দিঘীর পাড়ে শতাব্দী প্রাচীন এক ছায়াময় বটবৃক্ষ।
অতিথিরা ঘুরে ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়।
গ্রাম ঘুরিয়ে দেখায় শামসুল।
ষোলসতের বছরের শ্যামলা মিষ্টি চেহারার কিশোর। এতিম। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর চাচার বাড়ি ছিল। ওখানে অনেক কষ্ট। রহমান সাহেবই মায়াবশত ডেকে এনেছেন।
বাপ-মা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া মাথায় উঠেছিল শামসুলের। এখন রাতের বেলা পড়ান শামসুলকে। স্কুলেও নাম লিখিয়ে দিয়েছেন।
গত জুনে মিসেস ইসলাম ঘুরে গেলেন হোসেনপুর।
তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেই ছেলেমেয়েসমেত গিয়েছিলেন মিসেস রুবি ইসলাম । মেয়ের নাম ফরিয়া। সার্টপ্যান্ট পরা গোমড়া মুখের শ্যামলা মতন দেখতে। আসলে মেয়ের জন্যই যাওয়া। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।
সারাদিন টেলিফোনে কথা বলে ...
মিসেস রুবি ইসলামের বড় ছেলের নাম শিহাব। বুয়েটে পড়ে। লম্বা। ফরসা। চশমা-পরা।
একটা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার এনেছে। কাট-এওয়ে। আইভানেজ।
রহমান সাহেব পাগলাটে ধরনের লোক। শিহাবকে বললেন, মাইজভান্ডারি পার নি? স্কুল খুইলাছে রে মওলা স্কুল খুইলাছে হে হে ...বলে বুকে দুম দুম বারি।
মিসেস ইসলাম হেসে বললেন, না না চাচা। ওরা কী সব অলটারনেটিভ শুনে।
শুনি বাবা। বাজাও।
দুপুরের খাওয়ার পর সবাই বারান্দায় বসে ছিল।
শিহাব ঘর থেকে গিটার এনে টিউনটা ঠিক করে পাওয়ার কর্ড বাজিয়ে গাইতে শুরু করে-
দুজনকে মনে হয় দুগ্রহের ...
গান শেষ হলে রহমান সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন, ভালো।
শামসুল দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। ওর মুখচোখে আনন্দের আভা।
শিহাব গিটার রেখে আশপাশটা ঘুরে দেখতে উঠানে নেমে গেল। ওর পিছন পিছন ফারিয়া।
উঠানে রোদ ঝকঝক করছিল। খড়ের গন্ধ। গোবরের গন্ধ। রহমান সাহেব গাই পালছেন। শহরের অতিথিরা খাঁটি দুধের স্বাদ পেয়ে মুগ্ধ।
যা দেখছি ভালোই লাগছে। মিসেস রহমান বললেন।
রহমান সাহেব বললেন, সবাই কক্সবাজার যায় সুখে। আর আমার এখানে মানুষ আসে মনে বাস্প জমলে।
ও।
মিসেস ইসলামের মুখে ছায়া ঘনালো। কি যেন আড়াল করতে চাইছেন।
রহমান সাহেব বললেন, আমি যেই অপিসে চাকুরি করতাম,খুলনায়, সেখানে জুবায়ের রহমান নামে আমার এক কলিগ ছিল। ইন্টারনাল টুরিজমের আইডিয়াটা তারই। আমি রিটায়ার কইরা এখন বাস্তবায়ন করতেছি।
মিসেস ইসলাম বললেন, পেপারে দেখে এলাম। ছেলেমেয়েদের শহরে ভালো লাগছে না। বিশেষ করে মেয়েটার।
বুঝছি। আস্তে আস্তে লাগব।
বিকালে চন্দ্রদিঘীটা দেখলে ভালো লাগবে। যান বেড়াইয়া আসেন। শামসুল নিয়া যাবে। আপনার মেয়ের মনে হয় সমস্যা।
জ্বী।
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। রাতে তেমন ঘুমায় না। খালি জেদ করে।
বুঝছি। বৃষ্টি নামলে সব ঠিক হয়া যাবে।
মানে? মিসেস ইসলাম অবাক।
মানে পরে বলব। বলে রহমান সাহেব উঠে গেলেন।
মিসেস রহমান ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরুলেন। সঙ্গে শামসুল ছিল।
চন্দ্রদিঘীর পাড়ে এসে ফারিয়া একবার ফোন করতে চাইল। রিফাতকে বলবে, ¯স্প্রেডিং অ্যানসিয়েন্ট বানিয়ান ট্রিটার কথা।
মিসেস ইসলাম দিন কয়েক হল মেয়ের সেলফোন জব্দ করেছেন। মেয়েকে ধমক দিলেন। ফারিয়ার মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে।
ইংরেজীতে কী যেন বলল। চাপা স্বরে।
শিহাব বলল, উফঃ, তোমরা আবার শুরু করছ।
বিকেলের আগেই সবাই ফিরে এল। বেড়ানোটা তেমন জমল না।
সন্ধ্যের পর ধুম বৃষ্টি শুরু হল।
খাওয়া-দাও সারতে সারতে নটা বাজল। ফারিয়া খেতে এল না।
রহমান সাহেব মিসেস ইসলামকে বললেন, যান মেয়েরে নিয়া উঠানে যান।
উঠানে যাব কেন? ।
মিসেস রহমান অবাক। উঠানে বৃষ্টি আর অন্ধকার। কাদা।
যান। মেয়েরে উঠানে নিয়া গিয়া জামা খুইলা কাদায় গড়াগড়ি দেন।
কেউ দেখব না।
মানে? মিসেস রহমান অবাক।
রহমান সাহেব বললেন, আপনাগো গায়ে অনেকদিন হইল কাদা লাগে না। তাইতে মনের অসুখ হইসে। যান মেয়েরে উঠানে নিয়া গিয়া জামা খুইলা কাদায় গড়াগড়ি দেন।
কেউ দেখব না। মনের অসুখ সাইরা যাইব। যান। মেয়ের গায়ে কাদা মাখায় দেন। বৃষ্টিতে ভিজেন গিয়া।
এইখানে আরছেন ক্যান? রাঙার মার হাতের রান্না খাইতে?
কথাগুলি বলে রহমান সাহেব ভিতরে চলে গেলেন।
মরিয়া হয়ে তাই করবেন মিসেস ইসলাম। ভাবলেন।
( এই লেখাটি হয়তো কাল্পনিক। কিন্তু আমি ’৯৩ সালের বর্ষায় পদ্মার এক চরে বসে ছিলাম দুপুরে।
অর্ধনগ্ন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নানা কারণে আমার মনে অসুখ করেছিল। আমি পদ্মার ঝিকঝিকে পানির দিকে চেয়ে গায়ে থিকথিকে কাদা মাখছিলাম ... গায়ে থিকথিকে কাদা মাখছিলাম আর সেরে উঠছিলাম। কাদা কি ঠান্ডা! তখন থেকেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই-মনের অসুখের নিদান কাদাজলে আছে।
গ্রামের লোকের মনের তেমন অসুখ কই?
ওদের কেবল ভাতের কষ্ট ...
সেটা দূর করা যায় যদি মাঝে মাঝে আমরা ওদের কাছে গিয়ে দিন কয়েক থাকি। ওদের উঠানের কাদা মাখি গায়ে সন্ধ্যারাতের বৃষ্টিতে ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।