আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কক্সবাজার ভ্রমন ০৩

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

চট্টগ্রামে বাস পৌঁছালো যখন তখন রাত সাড়ে ৪টা। দীর্ঘ ছুটিতে আর যাই হোক আর না হোক আমার রাত জাগবার অভ্যাসটা পোক্ত হয়েছে। সুতরাং সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আমার এখন ঘুমাতে যাওয়ার সময়। শরীরটাও ঘুমঘুম, স্বপ্ন দেখছি কক্সবাজার পৌঁছেই হোটেলের রুমে ঢুকে ঘুম দিবো। যা থাকে কপালে।

এমনই বাস হেড রেস্টে দুই সেলাই, একটা বাঁচিয়ে ঘাড় রাখলে অন্যটাকে খোঁচা খায়। নীচে নেমে সিগারেট ধরানো যায়। অবসরে সিগারেটের চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কই? আমার পেছনের দম্পতি তখন ঘুমে। ছেলেটা মেয়েটার ঘারের উপরে উপুর হয়ে ঘূমাচ্ছে। হয়তো কোলেই উঠে ঘুমাতো, তবে এই বাসের সীটের মাঝের বাধাটা অনতিক্রম্য, কোনোভাবেই নড়ানো যায় না।

সুতরাং কেতরে ঘুমিয়ে থাকা দম্পতিকে রেখেই সিগারেট টানতে নেমে যাওয়া যায়। চিটাগাংয়ে যাদের নামার কথা তারাও নেমে গেছে। কন্ডাক্টরের তাড়া, সিগারেট টানবার যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলো না, হুড়মুড় ছেড়ে দিলো বাস। আমিও নিয়মিত ঘুমের সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। অবশ্য তাতে কোনো লাভ হলো না।

আধোঘুম আধো জাগরণের ভেতরেই বাস ছুটছে কক্সবাজারের পথে। রাস্তা তেমন সুবিধার না। কার্পেটিংয়ের সমস্যা। একটু উঁচি নীচু রাস্তা হলেই মাথার উপরে ঘন্টা বাজতে থাকে। সেই সাথে যোগ হয়েছে পানির আওয়াজ, হঠাৎ হঠাৎ ই ঘর ঘর করে পানি পড়তে থাকে কোথাও।

আমি নিশ্চিত না কোথায় পড়ে তবে আওয়াজ শুনে ভয়ে ভয়ে থাকি, এই শীতের রাতে নাইতে দিলে নির্ঘাৎ নিউমেনিয়া হয়ে যাবে। ইনানি রিসোর্টে যখন বাসটা ১৫ মিনিটের জন্য যাত্রাবিরতি ঘোষণা করলো তখন ঘড়িতে ৬টা ১৫। সূর্য উঠেছে। ভেতরের এসিটা অনেক বেশী আরমদায়ক লাগছে এখন। তবে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই, নেমে যেতে হবে।

বিলাসবহুল বাসের পেছনে একটা টাট্টিখানার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিলাম, তবে এখানে সেই সুযোগ নেই, পেশাপ চেপে বসে আছি অনেকক্ষণ। অন্তত লোড রিলিজ না করলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। দ্রুত নেমে পড়লাম। সারা রাত না ঘুমানোর প্রতিজ্ঞা করলেও মেয়েটাও এখন ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। মুখ ধুয়ে নাস্তা করবার আগ্রহ পেলাম না।

এক কাপ চা খেয়ে মনে পড়লো অনেক কিছুই সাথে আনা হয় নি। ব্যগ যখন গুছিয়েছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো অনেক কিছুই এনেছি। তবে এখন মনে হচ্ছে প্রাত্যহিক জিনিষপত্র আনা হয় ন। টুথপেষ্ট, টুথব্রাশ, স্যান্ডেল, শর্টস কিনতে হবে। দোকানে ঢুকে দেখলাম অনেকগুলো বীচ স্যান্ডেল রাখা।

তবে কোনোটাই পায়ে আটবে না। তখনই মনে পড়লো একটা তোয়ালেও কিনতে হবে। শালার। পছন্দ করে একটা বীচ স্যান্ডেল কিনলাম ছেলের জন্য। কিনে মনে হলো বড় হতে পারে।

তবে এখানে অদ্ভুত এক কারণে প্রয়োজনীয় মাপের জিনিষপত্র অপ্রতুল। বাচ্চাদের বীচ স্যান্ডেলগুলোর মাপ একটাই। বড়দের বীচ স্যান্ডেলের মাপ ৩৮ থেকে ৪১। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের পায়ের মাপ এই সীমানার বাইরে। বড় জুতা পড়তে সমস্যা হয় না, ছোটো পায়ে বড় জুতা সহ্য হয় কিন্তু বড় পায়ে ছোটো জুতা পড়ে ঘুরবার যন্ত্রনা অসীম।

১৫ মিনিট গিয়ে ২০ মিনিট, ২০ মিনিট গিয়ে ২৫ মিনিট। ডেরাইভারের দেখা নাই। অবশেষ সব গুছিয়ে যখন রওনা দিলাম তখন তখন বাজে ৬টা ৫০। এই শালাদের ঘড়ির ঠিক নাই। কক্সবাজার পৌঁছালাম যখন তখন ৮টা বাজে।

জানতাম হোটেলে বুকিং দেওয়া আছে। ঈদের দিনে থাকলে ৫০ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পাওয়া যেতো তবে ঈদের পরের দিন থেকে কোনো ডিসকাউন্ট নেই। এমন কি রুম এভেইল্যাবলও না। সী প্যালেসের সামনে নামলাম। বন্ধুর কাছে শুনলাম এখানেই থাকবো।

বিশাল হোটেল। মনটাই ভালো হয়ে গেলো। আমি তখন মনে মনে একটা রাইটিং প্যাড আর একটা কলম খুঁজছি। সেই সাথে স্টেশনারী কিছু কিনাবর জন্য একটা দোকান। তালতলায় সারি সারি হোটেল আর খাওয়ার দোকান।

তবে তেমন যুৎসই একটা স্টেশনারী দোকান নেই। সি প্যালেসের সামনে অনেকগুলো বার্মিজ দোকান দেখলাম। সেগুলোতেও সমুদ্রসৈকত উপযোগী জিনিষপত্র আর আচার। এইসব দিয়ে আমার কোনো উপকার হওয়ার সম্ভবনা নেই। থাকবার জায়গাটা দেখে নিজের মতো সামনে হাঁটতে থাকি।

হঠাৎ বন্ধু ফোন দিলো মোবাইলে, ব্যাটা গাড়ল কই যাস? আইতাছি ব্যাটা খাড়া একটু। হোটেলে যাইবি না? ঐ তো হোটেল। আরে না ব্যাটা আমিও ভাবছিলাম সেইরকম, তয় আমাগো হোটেল এইডা না। আমাগো হোটেল হইলো সিগাল। রিকশায় যাইতে হইবো।

আমি সাধু চেহারা করে রিকশায় উঠে পড়লাম। ভাঙাচোড়া রাস্তায় ঠোক্কর খেতে খেতে আগাচ্ছি। সীগাল হোটেলের সামনে গিয়ে নেমে পড়লাম। অনেক দিন কক্সবাজার আসি নি। আমার কক্সবাজার তেমন পছন্দ না।

অন্তত সমুদ্র দেখে সমুদ্রের সৈন্দর্য্যে আপ্লুত না হয়ে বিরক্ত হয়েছিলাম শেষ বার বর্ষায় কক্সবাজারের সমুদ্র ঘোলা কাদা পানির বিস্তৃনতা। এমন ঘোলা পানি দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। ঘুমে অস্থির হয়েই সিগালের রিসেপশনে পৌঁছালাম। চমৎকার, সুন্দর দুজন মেয়ে অভ্যর্থনাকারী পাওয়া গেলো। তারা আরও চমৎকার ভাবে অপারগতা জানালো।

আপনাদের রুম এখনও দেওয়া সম্ভব না। ১২টায় চেক আউট করলে রুম পাবেন। নাস্তার টেবিলেই বৌয়ের ফোন, তখন ঘড়িতে বাজে মাত্র ৯টা। নাস্তার টেবিল থেকেই বাসায় ফোন দিলাম। ছেলে ধুপধাপ ছুটে এসে ফোন ধরবে।

ফোন ধরার আনন্দেই সে মুগ্ধ। হ্যালো, আচ্ছা ঠিকাছে বাই, টাটা আল্লাহ হাফেজ। আচ্ছা রাখি তাহলে। ফোনের মধ্যেই আম্মার গলা শুনি, ঠিকমতো পৌঁছাইছি। পিচ্চি কি করে? এই তো ঘুম থেকে উঠলো।

খেলতেছে। খাইছে ও? নাহ এখনও খায় নাই। বাবু আব্বু ফোন করছে। বাবা তো বাতরুমে। পিচ্চির জবাব শুনি, মনটা বিষন্ন হয়ে যায়।

বাবা বাতরুমে নাই- আম্মা তখনও বুঝানোর চেষ্টা করছে ফোনের এইপাশে আমি আছি। ছেলে নিশ্চিত আমি সামনের সিঁড়িতে কোথাও আছি। তার আওয়াজ শুনি, এইপাশ থেকে ঐপাশে যায়, কক্সবাজার শহরটাকে বিশাল একটা জেলখানা মনে হয়। শালার আজকে রাতেই ঢাকায় চলে যাবো। নাস্তা শেষ করে গেলমা তোয়ালে কিনতে।

থানা ছাড়িয়ে কোথাও, দমকল বাহিনীর অফিসের কাছাকাছি। ভাইয়েরা কি কক্সবাজারে আসছেন? আমরা সম্মতি জানাই। ইদানিং বীচে যাইতে ভালো লাগে না, খালি মানুষ আর মানুষ। দোকানি চমৎকার হেসে বললো আরে ভাই আগ্রার মানুষ কি তাজমহল দেখতে যায়। আমি আপনি কি সমুদ্রসৈকতে যাবো? ট্যুরিস্ট শহরগুলো খুব দ্রুতই দখল হয়ে যায়।

স্থানীয় অধিবাসীদের ভোগান্তি চলতেই থাকে। সম্পূর্ণ শহরটাই ধীরে ধীরে বস্তি কাম শপিং মল হয়ে যায়, কক্সবাজারের পরিণতিও তেমন হচ্ছে। শহরটাতে উঁচু দালান বলতে কয়েকটা সরকারী ভবন বাদ দিয়ে শুধু হোটেল আর মোটেল। সিভিউ, বিচভিউ, হ্যানত্যান হোটেল। সস্তা আর দামি হোটেলে ভর্তি শহরের নিজের মানুষ কোথায়।

বাইরের মানুষেরা পয়সা খরচ করে বড় বড় হোটেল বানিয়েছে, ব্যবসা সেই ৩ মাসের ট্যুরিস্ট সিজন, এর পরের শহরটা জনশূন্যতায় খাবি খায়। দোকান থেকে কেনাকাটা শেষ করে আবার হোটেলের দিকে ফিরে আসি। মাঝ রাস্তায় অন্য বন্ধুরা ফোন দেয়। কি রে পৌঁছাইছিস ঠিক মতো? হোটেলে উঠছিস। গাড়ীতে করে আসছে আরও পাঁচ বন্ধু, ওরা রওনা দিয়েছে চিটাগাং থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে।

পাশ থেকে একজনের গলা শুনলাম, শালারা নলা কইয়াই হোটেলে রুম পাইতেছে না। আমি গেলে রুম নিয়াই ছাড়তাম। আপাতট লবিতে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। মানুষগুলা এমন কৃপণ কেনো? পাশের সোফায় বসে থাকা মহিলার কথা শুনে তার দিকে তাকালাম। অবশ্য হোটেলে ঢুকবার পরে সেই রিসেশশনিস্ট ছাড়া এমন কোনো মেয়ে দেখলাম না যাদের দিকে দুদন্ড তাকিয়ে থাকা যায়।

আমরা কি এতক্ষণ রুম দখল করে বসে থাকতাম। অভিযোগ কিংবা অনুযোগের কারণ বুঝলাম। তারা বসে আছে, অথচ চেক আউট হবে কখন তারা জানে না। নদীর এই পার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস- কি আর করার এই হোটেলে অপেক্ষা না করে বরং সমুদ্র সৈকতে যাই। সমুদ্র সৈকতে গিয়ে তব্ধা খায়া গেলাম।

চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। মানুষের ভীড়ে সমুদ্র দেখা যায় না। যে পাশেই চোখ যায় মানুষ আর ছাতা। বাংলা লিঙ্ক আর ওয়ারিদ- আর বিভিন্ন মাপের মানুষ। সমুদ্র সৈকতে রীতিমতো মেলা বসেছে।

অবশ্য ছেলেদের সবার পরনেই হাফপ্যান্ট, মেয়েরা সবাই সালোয়ার কামিজ। ছেলেদের উদাম গা দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে মনে হলো যদি বাংলাদেশেও ক্লথ অপশনাল বীচ থাকতো অন্তত খারাপ হতো না। বন্ধুকে ফোন দিলাম, শালারা গাড়ি ঘুরায়া ঢাকা যা গিয়া, এইখানে সমুদ্র দেখা যাইতেছে না মানুষের মাথার ভীড়ে। এক চক্কর হেঁটে খান্ত দিলাম। সম্ভব না।

এমন গরম, সূর্য সোজা চামড়া ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতরে। ঘুমের চাহিদাও প্রবল হয়ে উঠেছে। হোটেলে ফিরে শুনলাম একটা রুম ম্যানেজ হয়েছে। ৪২০ নাম্বার রুম। হেঁটে হেঁটে উঠলাম ৪ তলায়।

সুবেশী মানুষটা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই নাকটা ঠোক্কর খেলো অন্য পাশের দেয়ালে। এত ছোটো রুম। শালার এই রুমের ভাড়া প্রতি রাতে ৪ হাজার। তার উপরে বারান্দা নেই, খুপড়িতে বসে আছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।