মাহবুব লীলেন
ধাক্কাটা কিসের সাথে লাগল বুঝে উঠার আগেই ডান দিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে উড়ে গিয়ে পানিতে ঝপাৎ। গল্লুৎ করে এক দলা পানি ঢুকে যাচ্ছিল মুখে। আটকানোর জন্য মুখ ঝামটা দিতেই পানিগুলো পেটে না ঢুকে ঢুকে গেলো তালুতে। হাঁচচু দিয়ে তালু পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি আরো বড়ো একটা চালান সরাসরি ঢুকে গেছে পেটে
একটা ছটফটানি দিয়ে একটু শ্বাস নিতে চাইলাম। বাতাসের বদলা ভেতরে ঢুকে গেলো পনি।
মাছেদের মতো একটা কানকো থাকলে এখন খুব কাজে লাগতো। পানি চিবিয়ে অক্সিজেন বের করে ফেলতে পরতাম। কিন্তু চোখ আর কানগুলোকে ভেতর থেকে কেউ যেন ঠেলাঠেলি করছে বাইরের দিকে। বুকের ভেতরে যেন বেলুন ফোলাচ্ছে কেউ
একটা মোচড় দিয়ে দুয়েক হাত উপরে উঠে ধীরে ধীরে নামতে থাকলাম নিচে। বাতাসের মতো পানিরও একটা শিনশিন শব্দ আছে।
বাতাসের শব্দ লাগে কানে কিন্তু পানির শব্দ টের পাওয়া যায় দুই কানের মাঝখানে মাথার ভেতরে
পায়েই প্রথম মাটি ঠেকল। কাদা কাদা মাটি। অনেকটা ঢুকে গেলো। তারপর লাগল মাজা। তারপরে মাথার পেছন দিকে নরম কাদার একটা ধাক্কা টের পেলাম।
কান পর্যন্ত ঢুকে গেলো ভেতরে। সব শেষে এসে মাটিতে স্পর্শ করল মেরুদণ্ড
পানি এখানে দেয়ালের মতো স্থির। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। অনেকটা দোলনায় পিঠ ঠেকিয়ে পা আর মাথা নিচে ঝুলিয়ে শুয়ে থাকার মতো। পা আর মাথা মাটির অনেক নিচে।
কিন্তু পিঠটা আলতো করে লেগে আছে কাদায়
হয়তো কিছুক্ষণ না হয় কয়েকদিন পরে হাতের ঘড়িটা বেশ টাইট হয়ে গেলো। মাজার বেল্টটাও ঠেসে বসল মাংস কামড়ে। পরনের জুতা জিন্স এমনকি ঢোলাঢালা ফতুয়াটাও ছোট হয়ে এলো আমার শরীরের মাপে
একটা ঝাঁকি খেলাম। মাজাটা বেশ উঁচুতে উঠে ঝুলে থাকল। মাথাটাও কাদার ভেতর খেকে কিছুটা উঠে এলো।
আরো কিছুক্ষণ কিংবা কিছুদিন...। আরেকটা ধাক্কায় হাঁটু পর্যন্ত শূন্যে উঠে এলো। আরো কিছুক্ষণ পরে পা দুটোও উঠে গিয়ে শুধু মাথার পেছনটাই পড়ে থাকলো কাদায়...
এবার পানির ভেতরে চ্যাং দোলা হয়ে উঠতে থাকলাম আমি। পেট আর বুক উপরে। ঠ্যাং আর মাথা ঝুলে আছে দুই মাথায়।
আর সাম্পানের বৈঠার মতো ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে দুই হাত
পেটের চামড়ায় রোদ লাগার একটু পরেই কাউয়া কা করে আমার উপর একটা কাক এসে বসে হাউকাউ শুরু করে দিলো। তার ডাক অন্য কাকেরা শোনার আগেই ভুসভুস করে একটা ইঞ্জিন বোট উঠে গেলো আমার উপর। অনেক দূর পর্যন্ত ঠেলে নিতে নিতে আলকাতরা মাখানো পুরো শরীরটা পিছলে পার করে দিলেও ঝামেলা বাঁধালো স্টিলের দাঁড়। ঘ্যাচাং করে এসে পেটের একপাশে লাগল দাঁড়টা। উপর থেকে কেউ দু তিনবার ঝাঁকি মেরে খুলতে চাইল।
কিন্তু দাঁড়ের কোনা আমার পেটের ভেতর ঢুকে গিয়ে আটকে আছে চামড়া মাংস প্যান্ট আর বেল্টের সাথে
ট্রলারটা আস্তে আস্তে থেমে গেলো। কেউ একজন বাঁশ নামিয়ে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে ছাড়াতে না পেরে নেমে এসে পা দিয়ে দিলো নিচের দিকে এক ধাক্কা। আমি দাঁড় থেকে খুলে বেশ নিচে নেমে গিয়ে আবার ভেসে উঠতে লাগলাম উপরে...
ততক্ষণে ভটভটি আবার চলতে শুরু করেছে। ওর পানির টানে আমিও কিছু দূর এগোলাম। এর মধ্যেই ঝুপুত করে কাকটা এসে বসল।
সঙ্গে আরো একটা। খপাৎ করে নাভির কাছে দাঁড়ে কাটা জায়গায় একটা কামড় বসিয়ে দিলো
আমিও ভাসছি। কাক দুটোও ভাসছে। হঠাৎ দুইটাই দিলো উড়াল। কয়েক সেকেন্ডের মধে খচাৎ করে পাঁজরে লগির একটা ধাক্কা খেলাম।
হাতা নৌকায় যেতে যেতে মাঝি খোঁচা মেরে দেখে নিলো গরু নাকি মানুষ
ধাক্কায় ঢুকে গিয়েছিলাম পানিঘাসের ভেতরে। কাক দুটো বসছে কি বসেনি। নৌকাটা আবার ফিরে এলো। পানি থেকে দুই তিন ইঞ্চি নিচে ডোবা জিন্সের বাম পকেটে লগির মাথা দিয়ে একটা গুঁতা মারল লোকটা। এরপরে নৌকার ভেতর থেকে একটা মাথা বাঁকা দাও নিয়ে এসে দাওয়ের মুখটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে টান দিলো।
একহাতে ফতুয়া মুঠো করে ধরে একটা আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করল পকেটের ভেতর। না পেরে দাওয়ের মাথা ঢুকিয়ে ঘষে ঘষে পকেটের এক পাশ কেটে মোবাইলটা নৌকায় রেখে জিন্সের ডান পকেট কেটে দেখে পানিভেজা বিড়ির প্যাকেট...
একটা ভটভটির আওয়াজ শুনে লোকটা নৌকা ঘুরিয়ে আমার উপর তুলে দিয়ে আস্তে আস্তে চালাতে লাগল। ভটভটি চলে যেতেই আবার বের করে দাওয়ের কোঁকড়া মাথা দিয়ে টেনে আমার বাম হাত পানির উপরে তুলে দেখল কিছু আছে কি না। কিছু নেই। ডান হাত থেকে দাও দিয়ে বেল্ট কেটে ঘড়িটা তুলে নিলো নৌকায়।
এবার আমাকে উপুড় করে সরাসরি দাওয়ের মাথা ঢুকিয়ে দিলো ফুলে থাকা পেছনের ডান পকেটে। মানিব্যাগটা বের করে টিপে দেখল বাম পকেটে কিছু নেই...
মানিব্যাগ খুলে টাকাগুলো গলুইয়ে রেখে কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলতে লাগল পানিতে। ন্যাশনাল আইডি কার্ডটা ফেলতে গিয়েও ফেলল না। আমার ফতুয়ার বুকে গুঁজে দিয়ে এক ধাক্কায় আবার পানিঘাসের ভেতরে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলো লগি ঠেলে...
উপরে কাউকাউ কাক। নিচে বিরিবিরি মাছ।
যেতে আসতে দুয়েকটা লগির খোঁচা। দুয়েকবার ভটভটির তলায় ঢুকে পড়া আর ন্যাশনাল আইডি বুকে নিয়ে শুরু হলো আমার ভেসে চলা হাওরের পানি থেকে পানির ভেতর...
২০০৮.০৯.০৬ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।