বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
১৯৭১। ২৬ মার্চ। সকাল বেলা।
একটা ছোট্ট উঠান; কাঁঠাল গাছ, শ্যাওলা ধরা প্রাচীর। উঠানে রোদ ছিল। রোদ ছিল কাঁঠাল গাছে আর শ্যাওলা-ধরা পাঁচিলের গায়।
গতরাতে একটা যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে । অরেকট যুদ্ধ চলছিল উঠানটায়।
যুদ্ধটা চলছিল আমার মা-বাবার মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে!
আমার মা, থলথলে, বেঁটে;আমার বাবা দীর্ঘ শীর্ণকায়। দুজনের হাতেই রবীন্দ্রনাথের গেরুয়া পরা মাটিট রঙা একটা বারো ইঞ্চি মূর্তি; ওটা নিয়ে উঠানের ওপর ধস্তাধস্তি চলছে। আমার তখন চার বছর বয়েস। আমি উঠানের ওপর ধস্তাধস্তির দৃশ্যটা দেখছি।
যতটুকু বুঝতে পারিÑ আমার বাবা চাইছেন মূর্তিটা ভেঙ্গে ফেলতে, উঠানের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে। মা কিছুতেই দেবে না; মূর্তিটা না-ভেঙ্গে উঠানে পুঁতে ফেলতে চান মা। পরে বিপদ কেটে গেলে ধুয়ে মুছে ঘরে আবার সাজিয়ে রাখবেন।
বললাম আমার তখন বয়স চার বছর। ওই বয়েসের কথা কি কারও মনে থাকে? আসলে ৭১-এর পর থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালির আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল একাত্তর।
আমিও বয়স্কদের আসরে বসে হাজারবার ঘটনাটা শুনেছি। কিংবা মায়ের মুখে ...
গতরাতেই পাঁচিল ডিঙিয়ে কয়েক জন লোক পুলিশ লাইন থেকে প্রাণে বেঁচে আমাদের উঠানে আশ্রয় নিয়েছে। দৃশ্যটা তারাও দেখছিল। তাদের চোখে আমি ওই বয়েসেই মৃত্যুভয় দেখেছি।
আজ ভোরে মা-বাবা ওদের খাওয়ালেন, লুঙ্গি-গামছা দিলেন, খোঁজখবর নিলেন।
এ ব্যাপারে আমার মা-বাবা একমত।
কেবল ওই বরীন্দ্রনাথ নিয়েই ...
অথচ ওই সময়ে আমাদের পরিবারে সুখশান্তি ছিল। সহসা কলহ হত না। কেবল ওই রবীন্দ্রনাথ নিয়েই ...
আমার বাবা, পরে জেনেছি,ছিলেন moderate muslim, আওয়ামী লীগের মিটিং-এ যেতেন আবার ...আর আমার মা আগাগোরা কাব্যপ্রেমিক, romantic। সেই ১৯৬১ তেই ইডেন কলেজে নাটক করতেন ...
উঠানে রোদের ভিতরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা নিয়ে ধস্তাধস্তি চলছে।
রোদ পড়েছিল কাঁঠল গাছে, প্রাচীরের ওপর। প্রাচীরের ওপাশে জমাজমি; টিনশেডের ঘর। তারপর একটা সরু গলি। যে গলি ধরে হাঁটলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যাওয়া যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আমাদের বাড়ির খুব কাছে।
গতরাতে আর্মিরা ঢাকায় ক্র্যাক ডাউন করেছে ...যত্রতত্র অনেক লাশ ...
আমার moderate muslim বাবার ধারনা রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা এ সময় বিপদজনক।
আমার কাব্যপ্রেমিক romantic মা ঝুঁকিটা নিতে চান। মূর্তি ভাঙ্গার বদলে উঠানে পুঁতে ফেলতে চান।
মূর্তিটা নিয়ে শেষমেষ কী হয়েছিল আজ আর মনে নেই।
কাউকে যে জিজ্ঞেস করব তেমন কেউই বেঁচে নেই।
এখন লিখতে লিখতে আমার মনে হলো: রবীন্দ্রনাথের সেই মূর্তিটা গত ৩৬ বছর চোখে পড়েনি আমার!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।