৩০ জানুয়ারি ২০১৩, খালেদা জিয়া ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যা বলেছেন, সেটা এমনিতে তো বটেই, এমনকি তাদের নিজেদের দিক থেকেও এক মস্ত রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি। এ কাজ তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে করেছেন অথবা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে করেছেন তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ এর দায়িত্ব অবশ্যই তার নিজের, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ দু'বার অলঙ্কৃত করেছেন এমন এক ব্যক্তির।
প্রবন্ধটি পড়ে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, এক গভীর হতাশা থেকেই এটি লেখা হয়েছে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য আন্দোলন করছে কিন্তু খালেদা জিয়ার কথাবার্তা থেকে মনে হওয়ার উপায় নেই যে, ওই আন্দোলনের ওপর তার কোনো ভরসা আছে।
আওয়ামী লীগ তাদের নানা দুষ্কৃতির কারণে নিজেদের অবস্থা লেজেগোবরে করে জনগণের আস্থা শোচনীয়ভাবে হারিয়েছে এবং এই অবস্থায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হবে এ রকম একটি ধারণা ইতিমধ্যেই জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হলেও এ আশাবাদ যে খালেদা জিয়ার মধ্যে নেই ওয়াশিংটন টাইমসে তার প্রবন্ধটিই এর প্রমাণ। এটা যদি না হতো তা হলে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়ার মতো করে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি লুণ্ঠনজীবী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য প্রার্থনা করতেন না।
খালেদা জিয়ার প্রবন্ধটি থেকে জানা গেল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ যারা দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে কাজ করছে! তিনি লিখেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়তা করার জন্য এখন এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আশা সঞ্চারিত হয়েছে! তিনি তার প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এই বলে যে, এখন দুনিয়ার সময় এসেছে আমেরিকার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য কাজ করার! 'গণতন্ত্রে বিশ্বাসী' কোন ধরনের মানুষের পক্ষে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রতি আমাদের দেশে বা যে কোনো দেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আহ্বান জানানো সম্ভব এটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
তিনি এমন সব কথা তার প্রবন্ধে বলেছেন যা কীভাবে বলা সম্ভব হলো বোঝা মুশকিল।
তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিল অন্যতম প্রথম দেশ, যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল! কে না জানে যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি সামরিক বিরোধিতার জন্য তারা বঙ্গোপসাগরে তাদের সপ্তম নৌবাহিনী নিয়োগ করার হুমকি দিয়েছিল? এহেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি অভিযুক্ত করেছেন এই বলে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র যখন খর্ব হচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! তারা নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আনুগত্য অন্যান্য বিকাশমান বিশ্ব শক্তির দিকে ঝুঁকছে! তাহলে শুধু 'গণতন্ত্র রক্ষার' জন্যই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রেও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন এবং তারা এ কাজে এগিয়ে আসছে না বলে তিনি তাদের 'নির্লিপ্ততার' সমালোচনা করেছেন!
খুব স্পষ্টভাবেই খালেদা জিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এক বিদ্যমান ও বাস্তব ব্যাপার। এ হস্তক্ষেপ আছে এবং ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যেভাবে বাংলাদেশে তাদের গভর্নর জেনারেলের মতো আচরণ করেন ও কথাবার্তা বলেন, তার মধ্যেই এর পরিচয় পাওয়া যায়। এই হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বলতে যেটুকু আছে সে ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক ব্যাপার। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া তাদের আরও বড় আকারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে আহ্বান জানিয়েছেন তার অর্থ হলো, এখানে প্রয়োজন হলে সামরিক হস্তক্ষেপ পর্যন্ত করা এবং বাংলাদেশকে তাদের ষোলআনা মক্কেলে পরিণত করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা।
এই যারা চান তাদের জনগণ ভোট দেবে কেন? কারণ যারা মনে করেন জনগণের ভোট নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি লুণ্ঠনজীবী নিকৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী তাদের সঙ্গে জনগণের বা জনসমর্থনের কী সম্পর্ক? তার প্রয়োজনই-বা তাদের কোথায়?
আমেরিকাকে খুশি করার জন্য খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ অবান্তর এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে সরকার কর্তৃক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণের সমালোচনা করেছেন। একটি দেশীয় ব্যাংকের কার্যপরিচালনা কীভাবে হবে এটাও যদি অন্য দেশের কর্তৃত্ব ও নির্দেশে হওয়ার দাবি যারা করেন, তাদের মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ইত্যাদি সবকিছুই একটা তামাশা এবং বাত কি বাত ব্যাপার ছাড়া আর কী?
হাস্যকর ব্যাপার খালেদা জিয়ার প্রবন্ধের মধ্যে আরও আছে। শেখ হাসিনা তার বুদ্ধি দিয়ে মনে করেন যে, তার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তিই এ ব্যাপারে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং এ জন্য তিনি তার নিজেকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে একাধিকবার তদবিরকারকদের বাইরে পাঠিয়েছেন। এটা আসলে কোনো গুরুত্ব পাওয়ার মতো ব্যাপারই নয়, কিন্তু খালেদা জিয়া তার চিঠিতে এর উল্লেখ বারবার করেছেন।
এর সঙ্গে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার কী সম্পর্ক তিনিই জানেন! বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানাতে গিয়ে শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন ও চেষ্টা কীভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে এটা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল। এর মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের পরিচয় ছাড়া আর কী আছে?
কিন্তু খালেদা জিয়া তার চিঠিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে এসে হস্তক্ষেপ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন তার তুলনায় এসব বিষয় তুচ্ছ। বাংলাদেশের মতো দেশ এমনিতেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ওপর, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিপজ্জনকভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে একেবারে গোলামির ও মক্কেলগিরির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খালেদা জিয়া তাদের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন কোনো গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষই তা সমর্থন করতে পারে না। বর্তমান সরকার দেশের জনগণের জীবন যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, দেশের অর্থনীতিকে সংকটের পর সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করছে, দেশের সব রকম স্বার্থ উপেক্ষা করে পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থ যেভাবে পুষ্ট ও রক্ষা করছে তার হাত থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করে বাঁচার যে কোনো সম্ভাবনা বাংলাদেশের জনগণের সামনে আপাতত নেই, এটাই বিরোধীদলীয় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রবন্ধে বর্ণিত অবস্থান থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও এ দেশের জনগণের জন্য এর থেকে বড় রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?
৪.২.২০১৩
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।