আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সার্ক- অনন্য রাষ্ট্র সংঘ যার জাতীয় ভাষা হিন্দী

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

মায়া ভীষণ ব্যধি, অন্ধ করে দেয়। সাময়িক অন্ধত্ব ঘুচে না কোনো ভাবেই। আজকে ছেলে আলুথালু হয়ে ঘুমিয়ে আছে তার চিরিয়াখানায়, হাতে ভেড়া ধরে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে দেখে আবারও মায়ময় অন্ধত্বে লীন হলাম। কিনবো কিনবো করেও অনেক কিছুই কেনা হয় না আমার, সাধ আর সাধ্যে মিলমিশ হয় না বলেই দেবো দেবো বলেও অনেক কিছুই দেওয়া হয় না ছেলেটাকে। অবশ্য ছেলেও বোধ হয় নিজে থেকেই উপলব্ধি করতে পারে আমার দারিদ্র।

নিয়মিত খেলনার দোকানে যায়, খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে আর আমার মুখের দিকে তাকায়। খেলনার দাম শুনে চোখ কপালে উঠে যায় আমার। অবশ্য বাংলাদেশে সস্তার খেলনা বলতে সেই চীন থেকে আমদানি করা খেলনা, সেগুলো কয়েকদিন ভালোই চলে এরপরে বিগড়ে যায়। আর চীনা জিনিষ চীনাম্যানের মতোই একবার বিগড়ে গেলো তো সম্রাজ্য লোপাট হয়ে যাবে। আমার চেহারা দেখেই অনুমাণ করে নেয় আদৌ এই খেলনা তার কপালে জুটবে কি না, তাই যখনই বলি বাবু রেখে দাও, ও গুঁছিয়ে খেলনার দোকানে খেলনা রেখেই আমার সাথে বাইরে চলে আসে।

এরপরও মাসের প্রথম দিনটাতে ওর জন্য একটা খেলনা বরাদ্দ থাকেই। দৈনন্দিন খরচের একটা অংশ জমিয়ে যখনই মনে হয় কোনো একটা ছোটো খেলনা কিনে দেওয়া সম্ভব, ওকে নিয়ে যাই, তবে আমার নিজস্ব হাতখরচ জমানো টাকা সপ্তাহে কখনই ২০০ পেরোয় না, আর দোকানে গিয়ে কোনো কিছুর দাম জিজ্ঞাসা করলেই সেটার অংক কোনো ভাবেই ৪০০ টাকার নীচে নামে না। অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব নিয়ে ছেলেকে নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরি, শেষ পর্যন্ত পথচারী দোকানীকে জিজ্ঞাসা করে দরদাম করেই খেলনা কিনে আনি বাসায়। এতেও ছেলের আপত্তি নেই। যাই কেনা হয় ওটা নিয়েই মেতে থাকে।

কয়েক দিন আগেই দাদা বাসা থেকে ওকে নিয়ে ফিরছি, সামনের দোকানে থেমে একটা খেলনা পছন্দ করলো, গাড়ী, বললাম বাবা অনেক গাড়ী আছে তোমার, আর গাড়ী নেওয়া যাবে না। পরে পছন্দ করলো এক ব্যগ ভর্তী জীব-জন্তু, বিচিত্র রংয়ের দুইটা রামছাগল, ভেড়া, গন্ডার, জিরাফ হাতি , মুরগি সব মিলিয়ে নানাপদের ১২টা জন্তু ১২০ টাকা। সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। হাতি ছুটছে, ঘোড়া ছুটছে, ছাগল ম্যাঁ ম্যাঁ করছে, সেসব নানা তরিকায় সাজানো হচ্ছে, নিয়মিত ভাবি ওকে নিয়ে সত্যিকারের চিরিয়াখানায় যাবো একদিন, ঢাকার পরিস্থিতি একটু সুবিধার হলেই নিয়ে যাবো। ঈদের বন্ধেই নিয়ে যাবো একদিন ওকে হয়তো।

সেই খেলনার মাঝে আলুথালু ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে দেখি আর মনে হয় ওর বেড়ে ওঠা ঠিকমতো হচ্ছে না। ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া দরকার। ঘুর দরকার। সমবয়সী ছেলে ময়েদের সাথে মেশা উচিত ওর। এইভাবে নিজের ঘরের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে থাকা শৈশব ওর প্রাপ্য না।

মনে মনে স্কুল খুঁজি, সত্যি কারের কোনো স্কুল যেখানে প্লেগ্রুপ মানেই প্লেগ্রুপ। অহেতুক জ্ঞানবিতরণের প্রচেষ্টা নেই, ছোটো ছোটো বাচ্চারা যাবে, নিজের মতো সমবয়সীদের সাথে খেলবে, সামাজিক হয়ে উঠতে শিখবে। এমন একটা স্কুল খুঁজে পেলাম না। নামে প্লে গ্রুপ কিন্তু ভর্তি করবার পরেই নার্সারি রাইম আর ধারাপাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে ওকে। অবশ্য বেড়ে উঠবার নানা ঝামেলা আছে, বাসার মানুষ যেসব ঝামেলাকে মোটেও ঝামেলা মনে করে না।

লাজুক স্বতস্ফুর্ত ছেলেটা এখনও অপরিচিত মানুষের সামনে নিজের টয়লেটে যাওয়ার কথা বলতে পারে না। খুব বেশী ভীড় দেখলে টয়লেট চেপে ঘুরতে থাকে আর অস্থির হয়ে যায় ভীড় এড়ানোর জন্য। তখন ওকে দেখে বুঝতে হয় ওর টয়লেটে যাওয়ার সময় হয়েছে, ওকে সিসু করাতে হবে। ওর বেড়ে ওঠা দেখি আর একটা কথা মনে মনে ভাবি, আমাদের শৈশবে শুরু হয়েছিলো সার্ক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বিশেষত প্রাক্তন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোকে নিয়ে একটা সংঘ গড়ে উঠেছিলো।

ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যবধান ছিলো, রাজতান্ত্রিক- গণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক রাজতান্ত্র কিংবা সামরিক তন্ত্র, সকল রকম মশলাই ছিলো এই সার্কে। দিন বদলেছে, বাংলাদেশেও অন্তত ৬ টা সরকার হয়ে গেলো সার্ক তৈরির পরে। ভারতে ৭টা নির্বাচন হলো, নেপালের রাজতন্ত্র উৎখাত হলো, ভুটানের ফুটবল দল খেলা শুরু করে বাংলাদেশকেও হারিয়ে দিলো। মালদ্বীপের মামুম গাইয়ুম, মন্দ লোকে কাইয়ুম বলতে চায়, রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের যে ধারা শুরু করেছিলেন সেটা থেকে সরে আসছেন, মালদ্বীপেও গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে শুনছি। তবে বিগত ২৩ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

এখন আমার ছেলের শৈশবে হানা দেয় হিন্দি সিরিয়াল। অনেক আগে আমাদের শৈশবে এন্টেনাতে থালা বাসান বাটি ঝুলিয়ে ভারতীয় ছায়াছন্দ দেখবার আনন্দ এবং সাফল্যগাঁথা আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে নেহায়েত রুপকথা শোনাবে। এখন রিমোটের বোতাম চাপলেই সনি স্টারপ্লাস, জিটিভি দুরদর্শন ওয়ান নানাবিধ চ্যনেলের ছ্যাবলামি চোখে পড়তে বাধ্য, একই সাথে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতেও সেসবের অনুকরণ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া। মনোলোভা বিজ্ঞাপন, বিপণনের তরিকা শিক্ষা এইসব বদগুণ সহজে আত্মস্ত করতে পারলেও টেলিভিশনকে দুরশিক্ষণে ব্যবহারের ভারতীয় উদ্যোগকে অনুকরণ করতে পারি নি আমরা। নাচ আর গানের অনুষ্ঠানের অনুকরণ করছি, বিজ্ঞাপণের অনুকরণ করছি, এমন কি তাদের সিনেমা টিভি স্টারদের জীবনিও দেখছি দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়।

অচিরেই সার্ক এমন একটা সংঘ হয়ে উঠবে যার জাতীয় ভাষা হিন্দি, সেই রাষ্ট্র সংঘে মহাত্মা গান্ধীর তুলনায় তার বখে যাওয়া ছেলের ভুমিকায় অভিনয় করা অক্ষয় খান্না বেশী আলোচিত। সেখানে রাষ্ট্র নায়ক পরিবর্তন হলে তেমন বিশাল আলোড়ন উঠে না কিন্তু খানের বংশধর আর কাপুর বংশধরেরা কি প্রক্রিয়ায় কোন সিনেমায় কাকে বদল করছে কাকে রাখবার অনুমতি দিচ্ছে এই নিয়ে সরগরম হয়ে থাকে বিনোদন আর টেলিভিশন। সুতরাং আমাদের সার্কের অনন্য সাংস্কৃতিক ঐক্য হিন্দি সিনেমা, অনন্য রাষ্ট্র নায়ক সম্ভবত বর্তমানে অক্ষয় কুমার, বলিউডের বাদশাহই এখানে রাষ্ট্রনায়কের ভুমিকা গ্রহন করেছে। মালদ্বীপ থেকে আফগানিস্তান বিশাল একটা ভুখন্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হোগা মেরে শাহরুখ সালমান আমির অক্ষয় ক্যাটরিনা সেলিনা ঐশ্বইরা হাবিজাবি মেকাপ করা মানুষেরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ভয় লাগে, আমার ছেলে বেড়ে উঠছে এমন এক পরিবেশে যেখানে কোনো দিন সে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী শুনবে না বরং তেরে আঁখে ভুলভুলাইয়া শুলে কোমড় দুলিয়া নাচবে আমার ছেলে মায়া অন্ধ করে দেয়, কষে থাপড়ানো উচিত মনে হলেও বুঝতে পারি না থাপড়াবো কাকে আমার পরিবারকে, যারা নিত্যদিন এই অখাদ্য বিনোদন হিসেবে ভক্ষণ করছে তাদের না কি আমাদের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকদের, যাদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণেই এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সম্ভব হয়েছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.