ভয় নেই – এদের চেহারা অন্তত মানুষের মত, ঠাকুরমার ঝুলির চিরচেনা মামদো বা শ্যাঁওড়া গাছে থাকা গেছো ভূতদের মত নয়। আমি আমার নিজের কথাই বলছি। আমার নিজের এই ভৌতিক সত্বার সঙ্গে প্রথম ভালোভাবে পরিচিত হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং টের পাই-আমার এবং আমার মত আরও বেশ কয়েকজন ভূতদের ‘মানুষদের জন্য exclusively বানানো বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পড়তে আসার ধৃষ্টতা দেখানো মোটেই উচিত হয়নি। টের পেলাম যে আরও একটা synonym আছে আমাদের – ‘the outsiders’। এত সব উপাধির মূল কারন একটাই – ঢাকার বাহিরে নিবাস।
আর ঢাকার বাহিরে যে ‘কেবলই জঙ্গল’ তা কে না জানে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে টের পেতে লাগলাম – চারপাশে ফিস্ ফিস্ – সবাই না, তবে কিছু ‘আলোকিত মানব সম্প্রদায়’ নিজেরা রাজধানী-প্রসূত বিধায় ক্লাসের নেতৃ্ত্ব চাইল (হায়রে বাঙ্গালী – আজীবন শুধু নেতাগীরির নেশায় গেল, আর দেশ ভুগে গেল যোগ্য নেতৃ্ত্বের অভাবে)। যাই হোক – এতে আমার মত গোবেচারা ভূতদের কিছু আসলো গেল না। কোনমতে ক্লাস করতে পারলেই হোল। আর আমাদেরত অনেক কাজ – মানুষকে ভয় দেখাতে হবে, তা না হলে আবার ভৌতিক অস্তিত্বও যে বিলীন হয়ে যায়।
নেতাগীরির সময় কোথায়?
মফস্বলের ভূতগোস্ঠীর মধ্যে আমি আবার এক কাঠি সরেস – আমার রক্তে বইছে গাঁও-গেরামের খেটে খাওয়া চাষার রক্ত। আমার দাদা ছিলেন ‘গরীব চাষী গণি মিয়ার’ প্রতিনিধি। ছোটবেলার বড় একটা অংশ কেটেছে আমার এই চিরায়ত পরিশ্রম আর অসাধারন সংগ্রামের পাঁচালি দেখে। তবে সৃস্টি কর্তার কাছে অপরিসীম কৃ্তজ্ঞতা আমার – বাংলার এ রকম অতি সাধারন শ্রমজীবি সম্প্রদায়ই আমার শিকড়। নিজেকে ‘গেঁয়ো ভূত’ ভাবতে আমার বেশ লাগে।
গত দশ বছর ধরে ঢাকা শহরে আমার পরিবার মফস্বলের ভূত হিসেবেই বসবাস করছে। আমার শিকড় ওই গ্রামে- লুপ্তপ্রায় করোতোয়া নদীর তীরে সেই ভূত-রাজ্য।
সমস্যা হয়ে গেল 2nd Year এ-বাংলাদেশে যেসব লিখিত কাগজ বা সার্টিফিকেট কাওকে ‘ভালো বা খারাপ ছাত্র’ বানায়, সেগুলোর ভিত্তিতে ‘ভালো’ বনে গেলাম (আমি সবিনয়ে জানাতে চাই যে এই কথাগুলো ‘কোনভাবেই আমি কি হনুরে’ জাতীয় কোনকিছু বোঝানর জন্য নয় এবং আমি আন্তরিকভাবে লজ্জিত হব যদি এমনটি শোনায়, এছাড়া এসব assessment technique গুলোর কিছু কিছু ব্যাপারে আমার নিজের আপত্তি আছে)। ‘আলোকিত মানব সম্প্রদায়’ আমাকে দলে টানার চেস্টা করল, লাভ হলোনা। ততদিনে মফস্বলের ভূতগোস্ঠীর মধ্যে আমি আমার Niche খুঁজে পেয়ে গেছি, এদের অনেকেই ‘ভালো ছাত্র’ না হলেও মনের গভীরতার নিরিখে আকাশ-সমান হয়ে ছিল আমার কাছে।
অনেক কিছু শিখেছি এদের কাছে। সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম খোদ ঢাকার কিছু সহপাঠিও ‘ভৌতিক’ হবার যোগার, কারন ক্লাসের ‘আলোকিত মানব সম্প্রদায়ের’ কাছে এরা যথেস্ট স্মার্ট নয়, আধুনিক সব ক্যাফে-রেস্তঁরা এরা চেনে না, আমাদের মত সম্ভবত কথা-বার্তাতেও ওঁচা। তবে আস্তে আস্তে পরের বছর গুলোতে ভূতদের সংখ্যাই বাড়তে লাগলো। এদের অনেকেই আবার লেখাপড়াতে ‘ভৌতিক দক্ষতার’ সাথে বেশ ভালো করতে লাগলো। একসময় অবাক হয়ে দেখলাম যে প্রায় সবাই- প্রায় সব মানুষ আর সব ভূতেরা, মোটামুটি মিলেমিশে ‘মানূভ’ হয়ে গেছি।
1st Year এর অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে একদম আলাদা হয়ে গেল।
আসলে এতসব আবল-তাবল কথা আজ বলতাম না। সেদিন আমার এক বড় আপার কাছে, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ান আর এখানে পিএইচডি গবেষণারত, কথাপ্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম – ‘কেমন লাগছে আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে?’। উনি একজন তুলনামুলক ভাবে নতুন শিক্ষক, বললেন – ‘তুমি কিছু মনে কোরোনা (উনি জানেন আমি মফস্বলের ভূত), এসব কোচিং সেন্টারগুলোর কারনে সব মফস্বলের ভূতগুলো ভর্তি হয়, লেকচার কিচ্ছুনা বোঝেনা...কোন মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড নেই...’। কড়া সমাজতান্ত্রিক পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা তারমত কারও কাছ থেকে এমন মন্তব্যে অবাক হলাম বইকি।
সমস্যাটা কি আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যা কিনা তৃণমূল থেকে আমাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার চর্চাকে সযতনে খুন করে, নাকি ওনার নিজের পাঠদানও কিছুটা পরিবর্তনের দাবি রাখে তা বোঝার চেস্টা করলাম। নিছক মফস্বলের আইডেন্টিটি সব কিছুর জন্য দায়ি- এমনটা ভাবতে ভালো লাগল না। এই যদি হয়, তবে তো genealogy ঘাঁটলে বা Pedigree analysis করলে প্রায় সবার শিকড়েই ভূতের ডিএনএ পাওয়া যাওয়ার কথা। মানতে আমার বাধা নেই যে আমার মত মফস্বলের ভূতের আচার-আচরণ, কথা-বার্তা হয়ত আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতার মানদন্ডে পুরোপুরি উতরাতে নাও পারে, তবে এর জন্য ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ হবে কেন? এরকম হলে তো আসানসোলে রুটি-বেলা একজন নজরুল অথবা বরিশালের নিভৃতচারী একজন জীবনানন্দ মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন - ‘ভূত থেকে মানুষ’ হয়েছেন।
আপার কথায় হয়ত যুক্তি আছে যা আমার উর্বর-অমানুষ মগজে ঢোকেনি।
আমি কোনো প্রতিবাদও করিনি। কি লাভ এই ‘সু-শিক্ষিতা’ অগ্রজপ্রতীম কারও সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলে? তাছাড়া আমি চিরঅভ্যস্ত এসবে – মফস্বলের ভূতদের এত সহজে বিচলিত হলে চলেনা।
** আমার এই আবোল-তাবোল লেখা একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, কোনকিছু generalize করার অভিপ্রায় থেকে নয়। আমি আশা করি সবার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম হবে বা অন্যরকম হোক আমার চেয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।