আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘শিল্পী তৃপ্ত হলে তাঁর সৃষ্টি থেমে যায়’

গান গাইছেন ’৬২ সাল থেকে। দীর্ঘ পাঁচ দশকে বাংলা গানের শ্রোতাদের ভরাট আর মধুর কণ্ঠে শুনিয়েছে মন ছোঁয়ানো অসংখ্য গান। তিনি সবার প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। গান করার পাশাপাশি ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে একজন সফল উপস্থাপক হিসেবেও নিজেকে পরিচয় করে দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি আবারও ‘গানে গানে দেশে দেশে’ নামে বাংলাভিশনে শুরু করেছেন নতুন একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের উপস্থাপনা।

গুণী এই শিল্পী এক আলাপচারিতায় নিজের পাঁচ দশকের ক্যারিয়ার ও বাংলা গানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন লিমন আহমেদের সঙ্গে। আপনার গানের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই। আপনার গান গাওয়ার শুরুটা কিভাবে? গানের শুরুটা ছেলেবেলা থেকেই। বাবাকে দেখতাম প্রতিদিন নজরুল-রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। খুব আবেগ আর দরদ দিয়ে উনার গাওয়া গানগুলো আমাকে মুগ্ধ করত।

মূলত এখান থেকেই আমার গান গাওয়ার অনুপ্রেরণা। তবে আমি একাডেমিকভাবে সঙ্গীতে কোন শিক্ষা নেইনি। বিভিন্ন সময়ে গানের বিভিন্ন গুরুদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছি। যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখেছিলাম আব্দুল আহাদের কাছে। আমাদের সে সময়ে আহাদ ভাই ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর্দশ একজন শিক্ষক।

তাছাড়াও তিনি ছিলেন সরাসরি কবিগুরুর ছাত্র। তো এভাবেই গানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছি। স্কুল- কলেজ জীবনে নানা রকম অনুষ্ঠানে গান করতাম। আর একজন মৌলিক শিল্পী হিসেবে আব্দুল হাদীর শুরুটা ৬২ সালের দিকে। একটি পকিস্তানী উর্দু ছবিতে গান করে।

কিছুদিন পর ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে একটি বাংলা চলচ্চিত্রে দ্বৈত গানে কণ্ঠ দেই। এই ছবিটি অবশ্য মুক্তি পায়নি। কিন্তু বাংলা গানে আমার শিল্পী জীবনের শুরুটা সে ছবিতেই। তারপর থেকেই তো চলচ্চিত্রে নিয়মিত গাইছি। পাশাপাশি রেডিওতে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলাম।

আর বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমি ছিলাম প্রথম দিকের শিল্পী। ১৯৬৫ সালে বিটিভির যখন যাত্রা শুরু তখনকার বিটিভির প্রথম চারজন প্রযোজকের আমিও ছিলাম একজন। সে থেকে আজ অবধি গান তো গেয়েই চলেছি। পাঁচ দশকের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে আপনার কাজের মূল্যায়ন কেমন? সব কাজের মাঝে আপনার প্রিয় কাজ কোনগুলো? আসলে হিসেব করে বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া হিসেবটা করতে চাইনি কোনদিন।

আমার কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীতে আমি গাইতে এসেছি, গেয়েছি। মানুষকে ভালোবাসার গান, মানুষের আপন হয়ে ওঠার গান। দেশকে মূল্যায়নের গানই আমি সর্বদা গাইতে চেয়েছি। কতটা পেরেছি তা আমার জানা নেই। এটা সম্পূর্ণ বাংলা গানের শ্রোতাদের ওপর নির্ভর করছে।

তবে নিজের কাছে যা ভালো লাগে তা হলো গান গাইতে পেরেছি। হয়ত তারমধ্যে সত্যিই ভালো কিছু গান ছিল। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সময়ের পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানান অর্জন তারই প্রমাণ দেয়। কতগুলো ছবিতে প্লেব্যাক করেছি এটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। আর গানের পরিমাণ বলা তো একেবারেই অসম্ভব।

তাই স্বাভাবিকভাবেই কষ্টকর এত গানের মাঝে প্রিয় গান খুঁজে বের করা। আমার কাছে আমার গাওয়া প্রতিটি গানই সুন্দর এবং প্রিয়। তিনটি বা পাঁচটি গান বাছাই করা সম্ভব নয়। তবে চলচ্চিত্রে আমার কিছু গান রয়েছে যেগুলো আমাকে একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। জীবনের এ বেলাতে এসে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে চাই আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কবি শামসুর রাহমান, গাজী মাযহারুল আনোয়ারসহ সেইসব বিখ্যাত গীতিকারদের যারা আমার জন্য কালজয়ী অসংখ্য গান লিখেছিলেন।

গীতিকারের প্রসঙ্গ যেহেতু আসলই তাই এবার জানতে চাইব আপনার গানের গীতিকারদের সম্পর্কে। সেইসঙ্গে আপনার সহশিল্পীদের সম্পর্কেও? গীতিকারদের সম্পর্কে বলার কিছু নেই আবার শেষও নেই। একজন ভালো কথার গীতিকার একজন ভালো শিল্পীর রূপকার। চাইলেই লিখে ফেলা যায় না, “চোখের নজর এমনি কইরা”, “কেউ কোনদিন আমারে তো কথা দিল না” ,“জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো”, “আছেন আমার মুক্তার” ইত্যাদি গান। এর জন্য উন্নত রুচির প্রয়োজন, সাহিত্যনির্ভর চিন্তার প্রয়োজন।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না উল্লেখ্য গানগুলোর মতো গানই আমাকে আজকের আব্দুল হাদী বানিয়েছে। অবদান থেকে যায় আরও পেছনের কিছু মানুষের। তারা হলেন গানের সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক। একটি ভালো কথার গান তখনই সবার হয়ে ওঠে যখন গানটি ভালো সুর এবং মিউজিকের সঙ্গে মিশে যায়। আমার গানের সংখ্যার মতো গীতিকারদের তালিকাও অগুনতি।

শুধু এইটুকু বলতে পারি আমার সমকালীন বাংলা গান লিখেন প্রায় সবার গানই আমি গেয়েছি। সেই আবু হেনা মোস্তফা কামাল দিয়ে শুরু আর এই প্রজন্মের কবির বকুল পর্যন্ত। একই বিষয় সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকের বেলাতেও। ঠিক তেমনি আমার সহশিল্পীদের ক্ষেত্রেও। ফরিদা ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, ফেরদৌসী রহমান থেকে সর্বশেষ কনক চাঁপা।

এর মাঝখানে প্রায় সবার সাথেই আমার দ্বৈত কণ্ঠে গান রয়েছে। আমি আনন্দিত ক্যারিয়ারের এমন বিশালতায়। তবে এখানেই শেষ নয়। আরও চলবে ততদিন যতদিন আমি গাইতে পারি। আপনি তো স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের প্রথম থেকেই আছেন।

আমাদের বাংলা গান আন্তর্জাতিক বাজার না পাওয়ার অন্তরায় কোন কারণগুলো রয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বাংলা গানের আন্তর্জাতিক মান সব সময়ই ছিল। কিন্তু ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতার অভাবেই বহির্বিশ্বে আমাদের বাংলা গানের বাজার তৈরি হয়নি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা গান, সুর, মিউজিক ও বাদ্যযন্ত্রের বেশ কদর রয়েছে। আর যেসব দেশে বাঙালীরা আছেন সেসব দেশে বাংলা গানের প্রচলনও আছে। এবং বলা যায় ছোট হলেও একটা বাজার সেখানে গড়ে ওঠেছে।

কিন্তু এ দেশের বাংলা গানের বিরাট একটা আন্তর্জাতিক বাজার হতে পারত ভারত। বিশেষ করে কলকাতাসহ ভারতের সেসব প্রদেশ যেখানে বাঙালীদের বসবাস। নানা কারণে আমরা সে বাজার তৈরি করতে পারিনি। এখানে আমাদের দুর্বলতার চাইতে ভারতীয়দের অনীহা বা এদেশী কালচারকে সম্মান না করার প্রবণতাটাই মুখ্য। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বরাবরই শিল্প-সংস্কৃতিতে আমাদের এপার বাংলা ওপার বাংলার চাইতে অনেক এগিয়ে।

সঙ্গীতের মেধায় যেমন আমাদের প্রজন্ম এগিয়ে ছিল তেমনিভাবে নতুন প্রজন্মও এগিয়ে রয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম নিয়ে আপনার অভিমত? আমাদের সঙ্গীতের নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমি আশাবাদী। নতুনদের অনেকেই ভালো গাইছে। আমাদের অনেক মেধাবী গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পী রয়েছে। তবে গীতিকারকারদের কথার মানকে আরও উন্নত করতে হবে।

হালকা গানে খ্যাতি পাওয়া গেলেও টিকে থাকা কষ্টকর। প্রেম-বিরহের পাশাপাশি মানুষ-মানবতা-দেশকে নিয়েও গান করতে হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে নিজের যে দায়িত্ব রয়েছে তা প্রত্যেককেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে পালন করতে হবে। গান শুধু বিনোদনই নয়, এটি সমাজের আয়নাও বটে। বিষয়টি মাথায় রেখে গান করতে হবে।

তাছাড়া অগ্রজ গুণী মানুষদের সম্মান করাও শিখতে হবে। যে সম্মান করতে জানে সেই সম্মানের যোগ্য হয়। আমার বিশ্বাস ভাল নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেলে তারাই সকল সঙ্কট দূর করে আবারও বাংলা গানের ধারাকে জাগিয়ে তুলবে। আজকালকার গানের অনুষ্ঠানের শিল্পীরা দেখা যাচ্ছে কিছু দিন পরেই হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতল গহবরে। তাহলে কি তারা "তৃপ্ত" হয়ে যাচ্ছে ? (উপরের অংশটুকু জকন্ঠের একটি রিপোর্ট থেকে নেয়া) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।