পরে
রায়হানের যখন ঘুম ভাঙে তখন ঢাকার রাস্তায় বাস নেমে গেছে। রায়হান একটা চারতলা বাসার নিচের তলায় থাকে, রামপুরায়। মূল সড়ক থেকে আরেকটা গলি হয়ে বেশ খানিকটা আগালে ব্রাইট স্টার কিন্ডার গার্টেন-এর সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের নিচে লোহার চিকন পাতের চলতে ওঠা সবুজ গেট। গেটের বামদিকের নিচটা কেটে বের করে নেওয়া মাথা হালায়া ঢুকে পড়ার আরেকটা গেট - যেরকম সবসময়ই দেখা যায় ঢাকা শহরের এখানে সেখানে।
পুরা গেটটা তৈরি হওয়ার পর থেকে এখনও খোলা হয় নাই। নিচের ছোট গেটটা খুলে, মাথা হালায়া, পুরা শরীরটা কায়দা করে ঠেলে ঢুকায়াই লোকজনের যাতায়াত। সেই চিপা দরোজা ঠেলে, একটু ভিতরে ঢুকলেই মনের ভিতর খচখচ করতে থাকে - গিন্ডার গার্টেনটা কোথায়! দুই দিকে দুইটা ৪ তলা দালান। আরেক দিকে একটা টিনশেডের পিছন দিকের জানলা - দিনের বেশিরভাগ সময়ই যেগুলা হাট হয়ে থাকে - এবং যেগুলা দিয়া রায়হান অন্তত তিন দিন শাড়ি পাল্টানো মধ্যবয়সীদের ঝুলে পড়া স্তন দেখে ফেলে; এদের ভিতর কিন্ডার গার্টেনটা খুঁজে পাওয়া যায় না - যেটি আসলে দরোজা খুললেই যে শাদা চারতলাটি নির্লজ্জের মত সামনে এসে পড়ে তার তিন তলায় - এবং সেটার নিচের তলার বারান্দা থেকে ধোঁয়া ভেসে আসতে দেখে কিছুটা হকচকায়াই যেতে হয়। এই বারান্দাটাই রায়হানের বারান্দা, এবং এটা বারান্দাই নয় কেবল, কিচেনও।
এই বারান্দার গা-লাগা ঘরে সকাল-সকাল রায়হানের ঘুম যখন ভাঙে তখন পূবদিক থেকে একটা হলুদ রঙের তেরছা রোদের ফালি এসে পড়ে সেই ঝুলে পড়া স্তনের টিনশেডটার জং ধরা-ধরা জানলায় আর ঢাকার সকালের সেই রোদের গন্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দার প্লাস্টার দেওয়া ইটের দৈনন্দিন গন্ধের সঙ্গে সেই রোদ মিলে তৈরি হওয়া দ্বিতীয় আরেকটা গন্ধের পাশাপাশি রায়হানের নাকে এসে তৃতীয়ও কী যেন একটা ঠেকে। সঙ্গে সঙ্গে সে ধড়ফড়ায়া ওঠে। ময়লাঅলা চলে এসেছে। তার মানে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে!
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কলিংবেলের অপেক্ষা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু উপায় নাই।
হাতে সময় কম। রায়হানের ফ্ল্যাটটাকে বলা উচিত দেড়-রুমের। সে যে ঘরটায় থাকে তার পাশের ঘরটা আসলে পুরা ঘর না। তার ঘরটার তুলনায় এর সাইজ অর্ধেক; এবং প্রথম যেদিন এ বাসায় আসে সে, তালা খুলে বাড়িওয়ালি ভদ্রমহিলা যখন ফ্ল্যাটটা দেখায়, অস্বস্তির মত একটা গুমোট হাওয়া দরোজা ঠেলে, একেবারে রায়হানের নাক-মুখ ঘেঁষে চলে যায়। একটা শাদা বেড়াল একতাড়া পুরানা পত্রিকার অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে ছুট লাগায়; আর একটা ভাঙা খাটের কঙ্কাল, পুরানা তুলা বের হওয়া তোশকের পাশে পড়ে থাকে বাচ্চাদের চালানো তিন চাকার একটা ভাঙা সাইকেল।
বাড়িওয়ালি ভদ্রমহিলা, যেন কিছুটা লজ্জামেশানো গলায়, রায়হানকে বলে - সে উঠলেই এগুলা সরায়া ফেলা হবে। কিন্তু সেই পুরানা খাট, পত্রিকার - তূপ, ট্রাই-সাইকেল পরে আর নাড়া হয় না, রায়হানও ভালোই মানায়া নেয় ওগুলার সঙ্গে, যেন তার সংসারের সদস্য।
পাশের ঘরের দরোজার নিচ দিয়া আজকের দৈনিকটি দিয়া যাওয়া হয়েছে। রায়হান টুথব্রাশে পেস্ট ভরাতে ভরাতে, আয়নায় দিনের প্রথমবারের মত নিজের চেহারা দেখতে দেখতে, দরোজার নিচ থেকে রঙচঙে দৈনিকটি টেনে নিয়া তাতে চোখ বসাতে বসাতে কলিং বেলের পাখির কিচ-কিচ শব্দটা ভেসে ওঠে - যে ব্যাটারি দেওয়া কলিংবেলটা গত মাসের শেষদিকে একটা টিউশনির টাকা হাতে পেয়েই রায়হান কিনে ফেলেছিল; এবং সে খুব অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দরোজাটা খুলে ময়লা জমায়া রাখা সবুজ বাল্টিটা ময়লাওয়ালা ছেলেটার দিকে আগায়া দেয় এবং ময়লাওয়ালা সেই ছেলেটা তার দিকে খুবই অনভ্যস্ত আর অস্বস্তিকর একটা দৃষ্টি হেনে জিজ্ঞাস করে - রায়হান সারে নাইক্কা?
রায়হান প্রথমবারে কিছু বুঝে ওঠে না। তারপর ছেলেটার দিকে ঠিকঠাক তাকায়া দেখে।
না, এই ছেলেই প্রতিদিন আসে ময়লা নিতে। এ আজ তারে চিনতে পারে না ! রায়হানের মুখে এখন টুথব্রাশ। সে ময়লাওয়ালা ছেলেটারে পাত্তা না দিয়া, ময়লার বাল্টিটা আগায়া দিয়া বাথরুমে গিয়া ঢোকে, এবং আবার তার মনে পড়ে, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, রামপুরা থেকে টিএসসি পৌঁছানো ৪৫ মিনিটের কমে হবে না, জুথির আসার কথা ৮ টায়, জুথির সঙ্গে তার সকালের রোদ পোহানোর কথা, এই আইডিয়া জুথির, এবং জুথি এসে ফিরে গেলে তার আজকের দিনটা কেমন কুৎসিত হয়ে যাবে এটা ভাবতে ভাবতে তার বিষ্ঠাত্যাগ শেষ হয়ে যায়, সকালের ঠাণ্ডা পানি যখন তাকে বিভক্ত করে করে আগায়, তার জুথির চুলের নরম মনে আসে, এবং ময়লাওয়ালা ছেলেটার নির্বিকার প্রশ্নটাও কেন জানি মনে ভাসে, সে তাড়াহুড়া করে গিয়ে দাঁড়ায় আন্ডারওয়্যারের স্টিকারে প্রায় পুরাটা ভরে ওঠা বেসিনের আয়নার সামনে, নিজেকে দেখে, আশ্বস্ত হয়, জুথি তারে চিনে ফেলবেই...
টিএসসির ফুটপাথের পাশে, দেওয়ালে, পা ঝুলায়া বসে থাকে জুথি। জুথি আসে হলুদ জামায়। জুথির চশমার রূপালি ফ্রেমে রোদ ঠিকরায়া পড়ে।
জুথি বসে হাঁটুর সঙ্গে আরেক হাঁটু কাত করে লাগায়া। হাত দুইটা, দুইটা হাঁটুর উপর দিয়া লম্বা করে দেয়। জুথির কালো রঙের হাতব্যাগটা পাশে বসে ঝিমায়। জুথি কি টায়ার্ড, এই সম্পর্কটা টানতে টানতে? জুথিকে দেখতে দেখতে রায়হান আশেপাশে ফ্লেক্সিলোডের দোকান খুঁজতে থাকে। এবং পূর্ব রামপুরার সেই গলি ধরে আগাতে আগাতে, ডানদিকে যে মোবাইল ফোনের দোকানটা পড়ে, শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে থাকা গেঞ্জি পরে যেসব মডেল হাতে মোবাইল নিয়া টগবগ করতে থাকা বুকের দিকে তাকায়া থাকে যেখানে, সেই দোকানটার মোটা টালি খাতা হাতে বসে থাকা ষোল-সতের বছরের ছেলেটার ঝকঝকে দাঁত তার চোখে ভাসে এবং প্রতিদিনের মত আজও, যে দোকানটায় ঢুকতে ঢুকতে তার মাথায় খেলে, এই ছোকরা কি রাতের বেলা দোকানের ঝাঁপি ফেলার আগে আগে, এই লাল গেঞ্জির মডেলদের বুকে মাথা গুঁজতে গুঁজতে মাস্টারবেশন করে -সে দোকানটায় আজ ভিড় থাকে কম ।
রায়হান ঢোকার পর অন্য অন্য দিন যেমন হয়, সেই ছেলে রায়হানের দিকে তাকায়া চোখে চোখে একটা হাসি দেয়, সম্ভবত নিয়মিত গ্রাহককে চোখের অভ্যর্থনা জানায়, মার্কেটিং পলিসি হিসাবেই হয়তো - আজ সেটা ঘটে না...
রায়হানের আগে আগে আরও জনাতিনেক কাস্টমার দোকানটায় ভিড় জমায়। ছেলেটা লোকগুলার কাছ থেকে তাদের মোবাইল নাম্বার শুনে শুনে টালি খাতাটায় টুকতে থাকে, তারপর তাদের জিজ্ঞাস করে যে, তারা তাদের বলার অধিকার কতটুকু বাড়াতে চায়, এই ফাঁকে রায়হান দোকানটায় ঢুকে চতুর্থ ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়া থাকে, ছেলেটার হাতের অজানা রঙের বলপেনটার দিকে তাকায়া থাকে এবং দেখতে থাকে: সে ছেলেটার সামনে গিয়া ৫০ টাকার একটা নোট আগায়া দিয়া বলতেছে ফ্লেক্সি - ৫০, ছেলেটা তার দিকে না তাকায়াই জিজ্ঞাস করে, নাম্বার কন। অথচ এই নাম্বার, রায়হান জানে, সে নিজে ভুলে গেলেও এই ছোকরা ভুলবে না, এত এত বার সে ফ্লেক্সি করাইছে এখান থেকে। দলা পাকানো একটা চিন্তা গিলে ফেলে রায়হান ঠায় দাঁড়ায়া থাকে এবং তৃতীয়, দ্বিতীয় হয়ে যখন তার পালা চলে আসে আসে, রায়হান ধুম করে বের হয়ে এসে, দোকানের বাইরে, লাগালাগি দুইটা কদাকার নকশার দালানের মধ্যে জায়গা করে নিয়া, অবাঞ্ছিত দুইটা নারিকেল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কাঁপতে কাঁপতে, বিদ্যুতের তারেদের জটিলতা গলে যে আকাশটুকু কোনমতে নেমে আসে নিচে, শ্বাস নিয়া সেটা একেবারে শুষে নিতে চায়।
রায়হান জুথির দিকে আগাতে থাকে।
জুথি মোবাইল বের করে। কারে ফোন করে জুথি? রায়হানের মোবাইলে ভাইব্রেশন দেওয়া। মোবাইল তার বুকপকেটে। বুকপকেট কাঁপে। রায়হান আগায়।
আর দশ গজ দূরে জুথি মাথা ঝুঁকায়া বসে থাকে। কী করবে রায়হান জুঁথির কাছে গিয়া? কী বলবে? অন্য অন্য দিন যা বলে তা-ই? একজন অপরিচিত লোক এসে কাছ ঘেঁষে বসলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে জুথি? ব্যাপারটা নিয়া কৌতুহল হয় রায়হানের। আবার ব্যাপারটা ঘটার সম্ভাবনা ঠাহর করে সে ভেতরে ভেতরে কেঁপেও ওঠে । চিনবে না আমারে জুঁথি? না। হইতেই পারে না এটা।
পুরা পৃথিবী আমারে ভুইলা যাইতে পারে। জুথি আমার ফেস্ চিনবেই। আর আমার মোবাইল নাম্বার? এইটাতো আছে জুথির কাছে। রায়হান আগায়। টিএসসির রাস্তায় টুংটাং করতে করতে তিনটা রিকশা চলে যায়।
রায়হান আগায়...
২.
রায়হান জুথির থেকে হাত পঁচিশেক দূরে, মুখ ঘুরিয়ে টিএসসির প্রাচীরে বসা। আড়চোখে সে জুথিরে দেখে। জুথি একটা বাদামঅলা ছোকরারে ডাক দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার তো - রায়হান ভাবে। জুথি এরকম অপেক্ষার টাইমে বাদাম চিবাবে? ওয়েট করাটা কি ও এনজয় করে? নাকি জুথি প্রতীক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে প্রতীক্ষা থামায়া দিছে? কিংবা জুথি কি আদৌ প্রতীক্ষা করে? রোদ অনেকটা জাঁকায়া ওঠে।
টিএসসি রোদের বলকে ভেসে যেতে থাকে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে জুথির সঙ্গে রোদ পোহানো সাঙ্গ করে জুথিকে নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোনো বাসে উঠে পড়ত রায়হান। কিন্তু জুথি কেন এখনো এই ঝাঁঝালো রোদে বসে আছে? ও কি এখনো বিশ্বাস করছে, ঠিকই চলে আসবে রায়হান? নাকি নিজের ভিতর ডুবে ডুবে বাদাম চিবানোর এক ধরনের আনন্দ নেয় সে?
একটা কাক এসে রায়হান আর জুথির মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় বসে। তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে উড়ে চলে যায়। এরপর এসে বসে আরেকটা কাক।
রায়হান ভাবে সে জুথির কাছে এসেই অপরিচিত মানুষের মত বলবে, আপনি কি কারো অপেক্ষায় আছেন? যদি জুথির কাছে সত্যি সত্যিই অপরিচিত হয়ে ওঠে সে, তাহলে এটাই সবচেয়ে নিরাপদ প্রশ্ন। আর যদি সে সেই পরিচিত রায়হানই থাকে তাহলে জুথি এটাকে তার আর দশটা ফাজলামির একটা হিসাবেই নিবে এবং এই ফাজলামি তো এর আগেও সে করেছে জুথির সঙ্গে। তাই জুথি সন্দেহ করবে যে রায়হান পরীক্ষা করে দেখছে জুথি তারে চিনতে পারছে কি-না, এই সম্ভাবনা আর থাকে না। কিন্তু রায়হান জুথির কাছাকাছি, মানে বিশ-পঁচিশ হাত দূরত্বে এসে, কী কারণে জানি দেয়ালটায় বসে পড়ে। জুথিকে মোকাবেলা করার সাহসের অভাব থেকেই এটা করে কি-না নিশ্চিত হতে পারে না সে।
এই দূরত্ব থেকে পালায়া যাওয়াও যায় না। সে বসে থাকে। জুথি তাকায় না তার দিকে। ঘড়ি দেখে। বাদামঅলারে ডাক দেয়।
জুথির দিকে আগানোর সাহস হয় না রায়হানের।
৩.
রায়হান হাঁটতে শুরু করে। ঢাকা ছুটে যায়। রিকশা-রিকশা-রিকশা। কার-কার-কার।
ধুলা। হকার। লটারি-লটারি। ভাই, বাম্পার ড্র। আর মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টা।
ওভারব্রিজ। আব্বা এবং আম্মাজান, আমার কিডনিতে পাথর জমছে। অথচ, আব্বা এবং আম্মাজান, জেবনেও ভাবতে পারি নাই, কারো সামনে হাত পাততে হইবে। আমি একজন বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছেলাম। আইজ আমার কিডনিতে পাথর।
১০-১১-১২। ১০-১১-১২। মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া। ১০-১১-১২। নিয়া যান ভাই, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লটারি।
রায়হান হাঁটতে থাকে। হাঁটতে থাকে। হাঁটা থামায়। রামপুরার একটা বাসে ওঠে। তাকে ব্রাইট স্টার কিন্ডার গার্টেন-এর সাইনবোর্ড লাগানো বাড়িটার নিচতলায় গিয়া খুঁজে দেখতে হবে, সেখানে এখন আছে কে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।