( শেষ কিস্তি)
এর আগেও হয়েছে আস্থাভোট:
ভারতের লোকসভার ইতিহাসে এটাই প্রথম আস্থা ভোট নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ১০ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে এ ধরণের ভোট। প্রথম আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে।
গত ২৯ বছরে অনুষ্ঠিত ১০টি আস্থা ভোটের মধ্যে সরকার পক্ষ ৬বার বিজয়ী হয়। ভোটাভুটির আগেই প্রধানমন্ত্রী হার স্বীকার করে পদত্যাগ করায় ২ বার ভোটই অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৭৯ সালের আগে কখনো আস্থা ভোটের প্রয়োজন হয়নি। কেননা ১৯৫২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত লোকসভায় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী ছিল।
মনমোহন সিং-ই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি তার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত আস্থাভোটে লোকসভার সদস্য না হওয়ার কারণে ভোট দিতে পারেননি। তাছাড়া ১৯৮৯ সালের পর তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ৪ বৎসর ধরে অফিস করার পর আস্থা ভোটের সম্মুখীন হলেন। ভিপি সিং পরবর্তী ৬ জন প্রধানমন্ত্রীই তাদের প্রথম ২ বছর অফিসকালের মধ্যে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হন।
এছাড়া ১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য আস্থাভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং এবং ১৯৯৬ সালের ২৭-২৮মে অনুষ্ঠিতব্য আস্থাভোটের মুখোমুখি হয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী, নিশ্চিত পরাজয়ের কথা ভেবে ভোট অনুষ্ঠানের আগেই পদত্যাগ করেন।
বিগত আস্থাভোটসমূহ:
১ম দফা আস্থা ভোট
১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট চরন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জনতা পার্টিতে ভাঙ্গন দেখা দিলে লোকসভায় প্রথম আস্থা ভোটের প্রয়োজন পড়ে। ভোটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সমর্থন পাবেন না বুঝতে পেরে চরন সিং পদত্যাগ করেন। এমনকি তিনি পার্লামেন্টে পর্যন্ত আসেননি।
২য় দফা আস্থা ভোট
প্রথম আস্থা ভোটের প্রায় এক দশক পরে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং ভারতীয় লোকসভায় দ্বিতীয় বারের মত আস্থা ভোটের সম্মুখীন হন।
ভোটে জয়লাভ করেন তিনি এবং তার সরকার টিকে যায়।
৩য় দফা আস্থাভোট
২য় দফা আস্থাভোটের মাত্র ১১ মাস পর ১৯৯০ সালের ৮ নভেম্বর ইস্যুতে বিজেপি সমর্থন প্রত্যাহার করলে ভি পি সিং আবার আস্থা ভোটের সম্মুখীন হন। আস্থা ভোটে ভিপি সিং ১৪২-৩৪৬ ভোটে হেরে যান। উগ্রপন্থী হিন্দুদের সমর্থিত বিজেপি ষোড়শ শতকে নির্মিত অযোধ্যার বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির স্থাপনের দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোন সিদ্ধান্ত না দেয়ায় বিজেপি সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল।
সরকারের পতন নিশ্চিত করতে কংগ্রেসও বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছিল সেসময়।
৪র্থ দফা আস্থা ভোট
১৯৯০ সালের নভেম্বরে চন্দ্র শেখর রাজীব গান্ধির কংগ্রেসের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু মাত্র ৫ মাসের মাথায় রাজীব গন্ধীর কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার কররে চন্দ্র শেখর পদত্যাগ করেন।
৫ম দফা আস্থা ভোট
১৯৯১ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাও আস্থাভোটের সম্মুখীন হয়ে ২৬৫-২৫১ ভোটে বিজয়ী হন। পরবর্তীতে সমর্থন কমে গেলেও পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন।
৬ষ্ঠ দফা আস্থা ভোট
১৯৯৬ সালে মে মাসে অটল বিহারী বাজপেয়ী আস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভোটের পূর্বেই পদত্যাগ করেন। কারণ টিকে থাকার মত সমর্থন তার সরকারের ছিলনা।
৭ম দফা আস্থাভোট
একই বছরের জুন মাসে এইচ ডি দেব গৌড় একটি আস্থাভোটে জিতলেও মাত্র ১০ মাস পর কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের কারণে তার সরকারের পতন হয়।
৮ম দফা আস্থাভোট
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে আইকে গুজরাল ইউনাইডেট ফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারানোর পর ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন।
৯ম দফা আস্থা ভোট
আইকে গুজরাল সরকারের পতনের পর এনডিএ ১৯৯৮ সালে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। ফলে ১৯৯৮ সালের মে সাসে অনুষ্ঠিত এক আস্থা ভোটে বাজপেয়ী বিজয়ী হন।
১০ম আস্থা ভোট
১৯৯৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত আস্থা ভোটে বাজপেয়ী মাত্র ১ ভোটের জন্য হেরে যান। এসময় তার পক্ষে ২৬৯, বিপক্ষে ২৭০ ভোট পড়েছিল।
বাজপেয়ীই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাঁর দুবার আস্থা ভোটে হারের নজির আছে ।
বিগত অনাস্থাভোটসমূহ:
১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভারতীয় লোকসভায় বিরোধীদের পক্ষ থেকে ২৬ বার অনাস্থা প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়। তন্মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ১৫ বার, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও নরসীমা রাও প্রত্যেকে ৩ বার, মরাজি দেশাই ২ বার এবং জওহর লাল নেহেরু, রাজিব গান্ধী এবং বাজপেয়ী প্রত্যেকে ১ বার করে অনাস্থা ভোটের সম্মুখীন হন।
১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত উপস্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী মোপরাজি দেশাই ১৯৭৯ সালের ১২ জুলাই পরাজিত হয়ে পদত্যাগ করেন এবং বাকি সবগুলোই অনাস্থা প্রস্তাবই বাতিল হয়ে যায় অর্থাৎ এগুলোর ফলাফল ছিল নেতিবাচক।
আস্থা ভোট - অনাস্থা ভোট:
আস্থাভোট হচ্ছেÑ নির্বাচিত সরকার কর্র্তৃক পার্লামেন্টের সদস্যদের প্রদত্ত একটি প্রস্তাব, যেটির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ভোট দিয়ে পার্লামেন্টের সদস্যরা সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন কিংবা অনাস্থা জানাতে পারেন।
এ প্রস্তাব সরকারের সদস্যরা যৌথভাবে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের যে কোন সদস্যই পার্লামেন্টে উপস্থাপন করতে পারেন। অধিকাংশ সদস্য যদি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় তবে ঐ সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে। আর যদি বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সরকারের সামনে দুটি বিকল্প থাকে। সরকারের পদত্যাগ কিংবা আগাম সাধারণ নির্বাচন । সরকারকে এ দুটি বিকল্পের একটিকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে অনাস্থা ভোট হচ্ছেÑ পার্লামেন্টে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদল কর্তৃক আনিত প্রস্তাব। সরকারকে পরাজিত কিংবা দূর্বল করার উদ্দেশ্যে বিরোধীদল এ ধরণের প্রস্তাব উপস্থাপন করে থাকে।
আস্থাভোট ও অনাস্থাভোটের মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। পার্থক্যটি হলোÑআস্থাভোটের প্রস্তাব সরকার উপস্থাপন করে কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাব উপস্থাপন করে বিরোধীদল।
বিশ্বের প্রথম অনাস্থাভোট:
পার্লামেন্টের ইতিহাসে প্রথম অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৭৮২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে।
সেসময় আমেরিকার সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধে ইয়র্কটাউনে বৃটিশরা পরাজিত হলে গ্রেট ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের বিরুদ্ধে এ অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ, রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।