কিছু কিছু বিষয় আমরা নিজেরা মেনে চলার চেষ্টা করলেও শিশুদের ব্যাপারে মোটেও গুরুত্ব দিই না। ভাবি, ও তো এখনও ছোট, একটু বড় হোক, নিজে নিজেই শিখে নিবে বা আমরাই শিখিয়ে দেব। অথবা বড় হলে এসব অভ্যাস আপনা আপনিই চলে যাবে। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কত শিশুর যে ভবিষ্যত আমরা নিজ হাতে নষ্ট করছি তার ইয়ত্তা নেই।
ফার্সীতে একটি প্রবাদ আছে, যার ভাবার্থ : ইমারতের প্রথম ইঁটটি যদি বাঁকা করে বিছানো হয় তবে তার উচ্চতা তারকালোক স্পর্শ করলেও শেষ পর্যন্ত তা বাঁকাই থাকবে।
আমাদের গ্রামাঞ্চলে আরেকটি প্রবাদ আছে ‘‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পরে করে ঠাসঠাস। ’’
শিশুকাল যেমন মানুষের জীবনের সূচনালগ্ন তেমনি তখনকার শিক্ষাও প্রাসাদের ভিত্তিমূলের মতোই ভবিষ্যৎ জীবনের ভালো-মন্দের ভিত্তি। তাই এ সময় একবার শিশুর স্বভাব খারাপ হতে দিলে পরে আর তা শোধরানো সম্ভব হয় না। পাকা বাঁশের মতো তা অনমনীয় হয়ে যায়। আসলে কেউই মায়ের পেট থেকে খারাপ স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না।
প্রয়োজনীয় সুশিক্ষার অভাব এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশের কারণেই সে খারাপ পথে পা বাড়ায়।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-প্রতিটি শিশুই ফিতরাতের (স্বভাব ধর্মের) অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদী, নাসারা বা অগ্নিপূজক বানায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৫)
খোঁজ করলে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি অপরাধী ছোট বেলায় খুব বেশী স্বাধীনতা ভোগ করেছে। ফলে বুঝ হওয়ার পর ঐ অপরাধটা যখন তার স্বভাবের সাথে মিশে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তখন তাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, শাসন করা হয়েছে।
তাতে তার মধ্যে উল্টো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সে আরও বেশী অবাধ্য হয়ে উঠেছে, আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এই যে একটি শিশু কেবল অন্যায় প্রশ্রয় আর আদরের কারণে বখে গেল, বিপথগামী হল এর দায়ভার কি কাল কিয়ামতে মা-বাবাকে বহন করতে হবে না?
কিছু কিছু বদঅভ্যাস বুদ্ধি হওয়ার পর চেষ্টা করলে দূর করা যায়। আর কিছু কিছু অভ্যাস আছে, যা থেকে ফিরানো খুবই কষ্টকর এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে মিথ্যা বলা ও চুরির অভ্যাস সবচেয়ে মারাত্মক।
মিথ্যা সকল অনিষ্টের মূল। মিথ্যায় একবার কেউ অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার কাছে মিথ্যা কোন অপরাধ বা পাপ বলেই মনে হয় না।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার প্রশ্ন করা হল, মুমিন কি ভীরু হতে পারে? উত্তর হল, হ্যাঁ। এবার প্রশ্ন হল, মুমিন কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? উত্তর হল, না! (মুয়াত্তায়ে মালেক, হাদীস : ১৮০৭)
আমরা প্রায়ই কান্না থামানোর জন্য, শিশুকে ভোলানোর জন্য বা তার কাছ থেকে কোনো কাজ আদায় করার জন্য মিথ্যা বলে থাকি, যা পরোক্ষভাবে শিশুকে মিথ্যা বলতে উৎসাহিত করে। যেমন আমরা অনেক সময় বাচ্চাদের বলে থাকি যে, ‘বাবু! এসো তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।
অথবা তুমি এই কাজটা করলে বা এই পড়াটা মুখস্থ করলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। ’’ এতে সে যখন বিশ্বাস করে খুশিমনে দৌড়ে আসে বা পড়াটা মুখস্থ করে পুরস্কার চায় তখন আমরা যেভাবে এড়িয়ে যাই, তা আমরা নিজেরা কিছু মনে না করলেও এবং অন্যান্য কাজের ঝামেলায় তা ভুলে গেলেও বাচ্চারা কিন্তু তা এত সহজে ভুলে যায় না। এতে শিশুর মনে দু ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। এক. মায়ের প্রতি বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয়। দুই. মিথ্যা ও প্রতারণা তার কাছে একেবারেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
ফলে খেলার সাথী ও অন্যদের সাথে সে মিথ্যা বলতে দ্বিধা করে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) এর বর্ণনা, একবার আমার আম্মা কিছু একটা দেবেন বলে আমাকে কাছে ডাকলেন। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আমাদের বাড়িতে বসা ছিলেন। তিনি আমার আম্মাকে বললেন, তুমি কি সত্যিই তাকে কিছু দেবে? আম্মা বললেন, হ্যা! তাকে খেজুর দেয়ার ইচ্ছা ছিল। নবীজী বললেন, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার এ কথাটি মিথ্যা বলে গণ্য হত।
(সুনানে আবু দাউদ হাদীস ৪৯৯১ (৪৯৫২)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসে হাতে-কলমে যে শিক্ষা দিয়েছেন আমরা মায়েরা যদি এটা মেনে চলি তবে আমাদের সন্তানদেরকে মিথ্যা ও প্রতারণার দূরতম সংস্পর্শ থেকেও বাঁচিয়ে রাখতে পারব।
শিশুদের চুরি অভ্যাসটাও মিথ্যার মতই মারাত্মক। দেখা গেছে, কোনো শিশু হয়ত লুকিয়ে ওর খেলার সাথীর কোনো খেলনা বা সহপাঠীর কলমটা নিয়ে আসছে আবার কখনো হয়ত বাবার পকেট থেকে না বলে আধুলিটা নিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা বিষয়টাকে নিছক ছেলেমানুষী হিসেবেই দেখছেন। তারপর এই শিশুটিই কিশোরে পরিণত হচ্ছে।
তার চুরির আওতাটাও সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। মা বাবার কাছে অভিযোগ আসছে, তারা যথাসাধ্য এ থেকে ফিরাতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু ততদিনে কাঁচা নমনীয় বাঁশ চারা পেকে শক্ত হয়ে গিয়েছে। এই শিশুটিই বড় হওয়ার পর তার সেই শৈশবের সহপাঠীর পেন্সিল সরানো হাতে সবখানেই থাবা
বিস্তার করছে।
শিশুদের এ দুটি জঘন্য অভ্যাস থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ফলপ্রসূ পন্থা হল শিশুর কচি অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে দেয়া।
মা বাবা যদি শিশুকে শাসনের ভয় দেখিয়ে বা অন্যরা খারাপ বলবে এই ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করতে চান তবে এটা হবে সাময়িক। মা বাবা বা অন্য সবার অগোচরে যেখানে শাসন কিংবা লোক-লজ্জার ভয় থাকবে না শিশু দ্বিতীয়বার এ ধরনের কাজে উৎসাহী হতে পারে। কিন্তু যদি তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, এটা পাপ, এমন করলে আল্লাহ নারাজ হবেন এবং আল্লাহ সব সময় সবাইকে দেখছেন, কোন কিছুই তার দৃষ্টির আড়ালে নয়, তাহলে শিশুর সব বদঅভ্যাস আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে, এটা খুব জোর দিয়েই বলা যায়। ‘‘আল্লাহ সারাক্ষণ দেখছেন’’ কেবল এই বিশ্বাসটাই সুরক্ষিত বর্মের মতো শিশুকে সব ধরনের অন্যায় অপরাধ থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।