বাসার সামনে রাস্তায় ছোট ছোট পিচ্চিরা ক্রিকেট খেলছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাই দেখছি। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, অ্যাই, তুই আমাদের ক্লাশে নতুন এসেছিস না ? ঢাকাইয়া পাবলিক।
রেগে কটমট করে পেছনে তাকালাম। আমার বয়েসি এক মেয়ে দাড়িয়ে আছে।
ভীষণ সুন্দর চেহারা। ফ্রক পড়া। মাথার চুল বেনি করা। হাতে আচার।
তাতে তোর কি দরকার ? আমাকে তুই করে বলেছে, তাই আমিও ছাড়বো কেন।
না মানে তোর নামটা ভূলে গেছি। কি যেন নামটা তাল... তাল... কি তাল যেন !
দাঁত কিড়মিড় করে বললাম তমাল।
ওই হবে। একপ্রকার তালই তো।
তা তোর নাম কি ? আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম।
আমার নাম ? চোখ বড়বড় করে আবার বললো, আমার নাম ?
হ্যা তোর নাম।
কেন, তুলি।
বিড়বিড় করে বললাম, তুলির চোখে ঠুলি পড়িয়ে ছাড়বো।
তা এখানে এলি কেন ? ঢাকাইয়া কুট্টিরা রামদা নিয়ে ‘লড়ানি’ দিয়েছিলো নাকি ?
এতো দেখি আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম। হঠাৎ শুধালাম, ক্লাসে এতো পোলাপান দেখলাম তা তোকে দেখলাম না যে ! কালো তো মনে হয় এজন্যে দেখতে পাইনি।
দেখেছিস দেখেছিস। অ্যা, কি বললি ? কালা ? আমি কালা ? রাগে ওর অসম্ভব ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠলো।
এভাবেই শুরু। তারপর তুলির সাথে আমার ভীষণ ভাব জমে গেলো। ওদের বাসা আমাদের বাসা থেকে একটা বাঁক ঘুরলেই।
প্রায় একই সাথে স্কুলে যাই। যখন ও বেনী দুলিয়ে হাটে তখন একটা দেখার মতো দৃষ্য হয় বটে।
ক্লাসে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজন বন্ধু জুটে গেলো। আর দুসপ্তাহ পরে একেবারে জিগর দোস্ত। তারা দুজন হচ্ছে শফিক আর ইস্ক্রুপ চান্দু।
দুটোই সেরা বদমাস ক্লাসের মধ্যে। অবশ্য ওরা পড়াশুনায় একেবারে ইয়ে। আমি অবশ্য ভালোই। শুধু ভালো না বেশ ভালো। সবসময় ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে থাকি।
আর তিন নাম্বার হচ্ছে তুলি। এই মাইয়ার জ্বালায় কলিজা কালা হয়ে গেলো। পারলে এড়িয়ে চলি এমন অবস্থা। একদিন দরজা খোলা রেখে দোকানে গেছি। বাসায় ফিরে দেখি লঙ্কাকান্ড।
তুলি ডাইনিং টেবিলে বসে তবলা বাজাচ্ছে। আর বলছে, জলদি ভাত দেন খালা। আজ দাওয়াত খেতে এসেছি।
মা হা করে তাকিয়ে আছেন। বাবা সম্ভবত পেপার পড়ছিলেন।
সেটা বন্ধ করে চোখ বড় করে আমাকে দেখে বললেন, এরে, এটা আবার কে ! পাবনা মেন্টাল থেকে ছুটে এলো নাকি ! সেদিন বাসায় আমার অবস্থা কি হয়েছিলো তা না বলাই ভালো।
অবশ্য শুধু স্কুলে বন্ধু না, শত্রুও গজিয়ে উঠলো। ক্লাশের অর্ধেক ছেলে আমার উপর রেগে অস্থির। কারণ তুলিকে নাকি আমি হাত করে ফেলেছি। ওরা আবার ওর সাথে একটু ইয়ে... মানে প্রেম মহব্বত করতে চায় আর কি !
একদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম তুলি নেই।
তো ওর বান্ধবী ডি.এন.ডি. বাঁধ কে জিজ্ঞেস করতে বললো, ওর নাকি জ্বর। আজ সকালেই ও দেখে এসেছে।
মনটা যেন কেমন করে উঠলো। আহারে এমন ছটফটে মেয়ে। স্কুল ছুটি দিতেই ছুটলাম বাসায়।
ব্যাগ রেখে গেলাম ওর বাসায়। দরজায় টোকা দিতেই চশমা পড়া এক আপা দরজা খুলে দিলো।
তুমি নিশ্চই তমাল। তাই না ? এসো, তুলি বলছিলো তুমি নাকি আসবে।
ওর রুমে ঢুকে দেখলাম আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে তুলি।
এসেছিস ? জানতাম আসবি।
তিনদিন পরে সুস্থ হয়ে গেলো ও। সেদিন বিকেল বেলা। বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। মনে হয় ঝড় আসবে-ভীষণ বাতাস বইছে।
হঠাৎ দেখলাম তুলি এদিকেই আসছে। পরনে ভীষণ সুন্দর একটা ফ্রক। বাতাসে পতাকার মতো উড়ছে। মাথার বেনী দুটো বাতাসে দুলছে। দৃশ্যটা এতো সুন্দর যে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
তার ঠিক একবছর পরের কথা। জানুয়ারী মাস। আব্বার বদলীর নোটিশ এসেছে। জিনিস পত্র গোছগাছ প্রায় শেষ। কালই চলে যাবো।
মনটা এতো খারাপ হয়ে গেলো যে ইচ্ছে হলো বিছানায় শুয়ে কাঁদি। ঠিক করলাম কাউকে জানাবো না। তবুও শফিকের কাছ থেকে তুলি জেনে গেলো। কখন যে শুনলো আল্লা মালুম। সেদিন বিকেলে বাগানের সামনে দাড়িয়ে রাস্তা দেখছি।
প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। গাছের অসংখ্য পাতা বাতাসের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। কেমন যেনো একটা বিষন্ন বিকেল। বাগানের গোলাপ ফুল গুলোকে দেখতে লাগলাম। আহা ! কি সুন্দর লাল গোলাপ।
আমার নিজের বাগান যে !
চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম তুলি আসছে। পরণে সেই সুন্দর ফ্রকটা। আজ আর বেনি করা নয়। লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে।
কাছে এসে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো, তোরা কাল চলে যাচ্ছিস, না ?
হু।
আমাকে একটিবারও বললি না। এমনিই চলে যাবি ?
তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
ঠিক আছে। না বললে, নাই। গিয়ে চিঠি দিস।
ভালো থাকিস আর মনে রাখিস আমার কথা।
আমাকে একটা গোলাপ দিবি ?
বাগানের হেসে উঠা সবচেয়ে সুন্দর দুটো রক্তলাল গোলাপ ছিঁড়ে তুলির হাতে দিলাম। বাম হাতে লুকিয়ে রাখা এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। হাত বাড়িয়ে নিলাম ওটা। ভাঁজ করা একটা চিঠি।
উল্টো দিকে ঘুরে হাটতে লাগলো তুলি। অর্ধেক পথ যাবার পর প্রচন্ড দমকা হাওয়া এলো। প্রবল বাতাসে ফ্রকটা আবার উড়তে লাগলো। চুলগুলোও উড়লো।
দেখলাম, মাথা নিচু করে, বাতাসে চুল উড়িয়ে বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গেলো তুলি।
একটিবারও পেছনে ফিরে তাকালো না সে।
18.11.99
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।