আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাটি বাংলার বাউল শাহ আবদুল করিম



শাহ আবদুল করিম হিমাদ্রি শেখর ভদ্র বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরীতি শিখাইছে দেওনা বানাইছে কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে.......... আবদুল করিম কালনী নদীর তীরে বসে উদাসী নয়নে আপন মনে যিনি রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান তিনি আর কেউনন তিনি হলেন জীবন্ত কিংবদন্তী বাউল আবদুল করিম। কালনী নদীর বাউল বাতাস ও ভাটিবাংলার অপার সৌন্দর্য তিনি ধারণ করেছিলেন তার হৃদয় সত্ত্বায়। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা যাকে তিলে তিলে পীড়ন করতো তিনিই তো পারেন এ রকম কালজয়ী সাধক। তিনি বাউল গান রচনা করে ভাটি বাংলার সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল নত্রে পরিণত হয়েছেন। জন্ম ১৩২২ বাংলায়।

দিরাই উপজেলার বাউল জনপদ উজান ধলগ্রামে। উজান ধলগ্রামের কৃষিশ্রমিক ইব্রাহিম আলীর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে আবদুল করিম ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান। পারিবারিক অনটনের কারণে ছোট্ট করিম গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্তের বাড়িতে রাখালের কাজ করেছেন তিনি। রাখালীয়ার কাজ করে কেটে যায় তার কৈশর বেলা। রাখালের কাজ করতে গিয়ে দিনের বেশীর ভাগ সময়ই তার হাওরের গোচারণ ভুমিতে কেটেছে।

সকালে গরু নিয়ে পথ দিয়ে সারাদিনমান হাওরে গরু চড়িয়ে বাড়ি ফিরতেন গৌধূলীলগ্নে। ভাটি বাংলার চিরায়ত রূপ তার খুবই পরিচিত। মাঠে গরু চড়ানোর সময় তিনি আপন মনে গেয়ে যেতেন তার রচিত, সুরারোপিত বিভিন্ন গান। প্রতিদিনের কর্মকান্ডের মধ্যে গান একটি নিত্য অনুসঙ্গ। অভাবের তাড়নায় প্রচলিত শিা গ্রহণ বাদদিয়ে যে ছেলের জীবনের প্রথম পাঠ শুরু হয়ে ছিলো ভাটিবাংলার কোন এক হাওরের একটি উৎকৃষ্ট গোচারণ ভুমিতে সে ছেলে আবদুল করিম।

ভাটি বাংলার প্রকৃতি ছিলো তার প্রথম শিক। এই প্রকৃতিই তাকে খাঁটি সোনা করে গড়ে তুলেছে। দীর্ঘ বাইশ বছর যাবৎ তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিা গ্রহণ করেনি। এই পুরো সময় তিনি ছিলেন নিরর একজন মানুষ। আভিধানিক ভাবে তিনি নিরর থাকলেও তাঁর তৃতীয় নয়ন তখন অনেক কিছু আয়ত্ব করে নিয়েছে।

সে গোলু ধারণ করার জন্য তিনি ভর্তি হন নাইট স্কুলে। অর জ্ঞান লাভের পর তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটুর গান, সারিগান, কবিগান গাইতেন। তৎকালীন সময়ে ভাটি অঞ্চলের হাওরে নৌকা বাইছ (নৌকা দৌড়) হতো তখন তারা নৌকায় বেয়ে গাইতেন “কোন মেস্তুরী নাও বানইছে কেমন দেখা যায় ঝিল-মিল-ঝিল-মিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও”। এভাবে চলে তার বাউল সাধনা এরই মধ্যে ভাটি বাংলায় মালজোড়া গান খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। মালজোড় গান গানে - গানে জুড়ি, দু’জন বাউলের প্রশ্ন উত্তরের মাঝে মাঝে যে গান গাওয়া হয়।

বাউল আবদুল করিম, নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত বাউল গান রচিয়েতা উকিল মুন্সী সহ ভাটিবাংলার অসংখ্য খ্যাতনামা বাউল সাধকেরা নবীজীর জীবনী, পৌরানিক যুগের কৃষ্ণের জীবনী, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, প্রেম-বিচ্ছেদ, মাটি ও মানুষের গান ইত্যাদি গেয়ে আনন্দের ঢেউ তুলে দিতেন পুরো ভাটি অঞ্চলে। তার রচিত গানের মধ্যে রয়েছে বাউল, মুর্শিদী, জারিসারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি । “শুধু কালির লেখায় আলিম হয় না মন রে কানা অজানা কে যে না জানে আল্লাহ নবী আদম ছবি /এক সূতে বাঁধা তিন জনে” তার রচিত এগানটির মধ্য দিয়ে আধ্যাতিক যোগ সাধনার একটি ধারণা পাওয়া যায় মানুষের জীবনের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে যে সাধনা সাধকগণ যুগ যুগ ধরে করে গেছেন তাকে বলা হয় আধ্যাতিক জীবন। যা ভোগবাদী জীবনধারা থেকে একবারেই আলাদা। আধ্যতিক সাধনার জন্য বাউল করিম আশ্রয় নিয়ে ছিলেন দুইজর গুরুর তাদের একজন হলেন মওলা বক্স মুন্সি অপরজন হলেন পীর শাহ ইব্রহীম মস্তান।

বাউল আবদুল করিম একজন রাজনীতি সচেতন চারণ কবি। তিনি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠাসহ গণমানুষের মৌলিক ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন ভুমিকায় অবর্তীণ হতেন। সমাজের মানুষে মানুষে শ্রেণী বিভেদ দূর করতে আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। মানব প্রেমের মধ্যদিয়ে জগৎ সংসার কে আলোকিত আর সমাজের নিপীড়ত মানুষের মুক্তির আস্বাদ দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। তার রচিত বাউল গানে তা ফোঁটে উঠেছে।

আবদুল করিমের গানে গানে সাম্যবাদের সুর ফোঁটে উঠেছে। নির্যাতিত মানুষের শোকগাথা, শোষণ-বঞ্চণার প্রতিবাদ, শাসিত ও শোষক গোষ্ঠীর কথাই বেশী রয়েছে। আগে কি সুন্দর দিন কাটইতাম গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম..... তাঁর রচিত এ গানটির মধ্যে যে অসা¤প্রদায়িক মনোভাবের ব্যাপ্তি ঘটেছে। আবদুল করিম বাংলাদেশের অন্যতম পুরস্কার একুশে পদক পেয়েছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিশীল রচনার জন্য । ১৯৫৪-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে , ৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে, ৬৯-এর গণঅভ্যুথানে,৭১-এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে,৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি জনতার সমুদ্রে নিজের রচিত গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

গণমানুষের আন্দোলনেন যা জোরালো ভুমিকা পালন করে। যুক্ত-ফ্রন্টের সময় বিভিন্ন সভা -সমাবেশে গান পরিবেশন করেছেন বাউল আবদুল করিম। ভয়াবহ দুর্ভিরে সময় জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে সিলেটে আয়োজিত এক সমাবেশে তার দরাজ কণ্ঠে গেয়েছিলেনÑ স্বরচিত বিভিন্ন গান। গণমানুষের দুঃখ শোকের অনুভুতি ফোঁটিয়ে তুলেছিলেন তার পরিবেশিত এ গানটির মধ্য দিয়ে ‘এবারে দুর্দশার কথা, কইতে মনে লাগে ব্যথা’। বাঙ্গালী জাতির মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে গান মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক গান পরিবেশন করে আশাহত জনতাকে উজ্জিবিত করেছেন।

ঐতিহাসিক কাগমারি সমাবশে বাউল করিম গেয়েছিলেন Ñভাসনী কে নিয়ে স্বরচিত গান জনাব মওলানা ভাসানী, কাঙালের বন্ধু তিনি চিন্তা করেন দিন রজনী। মাত্র বিশ বছর বয়সে আফতাব সঙ্গীত নামে তার রচনাবলী নিয়ে প্রথম বই প্রকাশিত হয় । তার প্রকাশিত আফতাব সংগীতের এখন আর কোন হদিস পাওয়া যায় না। এখন আবদুল করিমের স্বরচিত গানের গীতিকথা নিয়ে ৬ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বই গুলো হলো আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, ভাটির চিঠি, ধলমেলা, কালনীর ঢেউ ও কালনীর কূলে।

১৯৬৫ সালে একটি কাবের আমন্ত্রনে লন্ডনে যান তিনি। সেখানে গান গেয়ে কিছু টাকা উপার্জন করেন। সেই উপার্জিত টাকা দিয়ে দেশে এসে কিছু ধানীজমি কিনেন আবদুল করিম। শেষ সময়ে সেই জমি বিক্রি করে তার গানের বই ‘কালনীর ঢেউ’ ছাপার খরচের যোগান দেন। বাউল করিম ৩৮ বছর বয়সে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের আসাসুরা গ্রামের আবদুর রহমানের মেয়ে সরলা খাতুনকে বিয়ে করেন।

১৩৯৬ বাংলায় সরলা খাতুন একমাত্র ছেলে শাহ- নূর- জালাল ও বাউল করিমকে রেখেই মারা যান। বাউল করিমের যোগ্য উত্তরসুরি তার পুত্র নূর-জালালও বাবার শেখানো পথ ধরেই হাঁটছেন। তিনি বাউল রচনা করেন সুরারোপ করেন এবং নিজেই গান পরিবেশন করে থাকেন। তার দুটি গান কলকাতার সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদনায় বের হওয়া একটি গানের বইয়ে এবং সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী খানের সম্পাদিত বাউল গানের বইয়ে স্থান পেয়েছে। বাউল আবদুল করিমের শেষ ইচ্ছা তার ধল গ্রামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।