আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ ভাটি দিনের মধুমতি

আজ প্রায় কুড়ি বছর পর হাসিনার সাথে দেখা হল। মহাকালের হিসেবে কুড়িটা বছর সামান্য হতে পারে কিন্ত মানবজীবনের হিসেবে নেহাত কম সময় নয়। কুড়ি বছর আগে হাসিনার চুল ছিল অবাধ্য ঝরণাধারার মত— হাতখোঁপায় আটকে রাখা যেতনা বলে আমাদের মেজাজী মা কতবার যে তার চুলে আগুন দেয়ার হুমকি দিতেন! তবুও হাসিনা সে চুল একাকী বাঁধতে শেখেনি-- অধিকাংশ সময়ই তার ঢেউ খেলানো চুলগুলো তার প্রশস্ত পিঠ ছাপিয়ে হাঁটুতে এসে লুটোপুটি খেত। সেই চুলেরা আজ অধিকাংশই হাসিনার থেকে বিদায় নিয়ে কোন অজ্ঞাত ভূমিশয্যা লাভ করেছে। বাকি যারা এখনো কোনমতে টিকে আছে তাদের বর্ণ বিবর্ণ-ধূসর-- ঠিক হাসিনার জীবনের মত।

হাসিনার জন্মবছরটার কথা আমার আজো মনে আছে, মনে থাকবে আমৃত্যু। পঁচাত্তরের কোন একটা দিন হবে; ওর জন্মের কিছুদিন পরই আমরা রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সপরিবার হত্যাকাণ্ডের খবর শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অবশিষ্ট জীবিত সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানিয়ে হাসিনার নামকরণ করা হল এবং তার অল্প কিছুদিন পরেই আমি একদিন নওশার সাজে নকশাদার নৌকায় চেপে ভরাযৌবনা মধুমতির উথাল-পাতাল বুক বেয়ে গিয়ে আব্বার হাত ধরে বিয়ের আসরের মধ্যমনি হয়ে বসলাম। মাত্র তিনমাস বয়সী হাসিনার সাথে বারবছরী আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের বিয়ের সময় আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা আর আজ মনে পড়েনা-- লজ্জ্বা-টজ্জা কিছু পাচ্ছিলাম বলেও মনে হয়না। তিনমাস বয়সী হাসিনাকে সেদিন চোখের দেখা দেখেছিলাম কিনা তাও আজ মনে নেই।

কিন্ত এর মাত্র কয়েক বছর পর আমাদের পরিবারে এমনকিছু ঘটনা ঘটে যায় যা আমাকে রাতারাতি পরিণতবয়ষ্কমনষ্ক করে তোলার পাশাপাশি স্মৃতিকে করে তোলে উজ্জ্বল, অক্ষয় ও অমোচনীয়। আমাদের বিয়ের পরবর্তী বছরের ভাদ্রমাস। ফের উন্মাতাল, কুলনাশিনী মধুমতির বুকে আমাদের পানশি ভাসে। আমার নওশাবেশী আব্বার পিছুপিছু লম্বা ঘোমটাটানা আমার শাশুড়ীআম্মা টানা টানা চোখে কাজল পরানো হাসিনাকে কোলে করে আমাদের বড় ঘরটায় প্রবেশ করে। অল্পসময়েই আমাদের উঠানে বাঁধভাঙা মানবঢলের প্লাবন।

লোকেদের কথাবার্তায় আমি অল্পেই বুঝতে পারলাম যে কী ঘটেছে। আমার ভীরু-নরম মা কয়েকবার ফিট্ হলেন, সুস্থও হলেন, বছর কয়েক পর মারাও গেলেন। আমি পূর্ণযৌবনে পদার্পণ করলাম, হাসিনা তখন নেহাৎই শিশু। একটা ছোট্ট মেয়ে মাথায় চুড়োঝুঁটি কিংবা আজানুলম্বিত খোলা চুল নিয়ে এক্কা-দোক্কা, ছি-বুড়ি, কানামাছি খেলছে আর তার স্বামী আমি শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে চোখ ভিজিয়ে ফেলছি। আমার শাশুড়ি আমার আব্বার ঘরে ঢুকে অভ্যস্থ হাতে দরজায় খিল তুলে দিচ্ছে আর আমি একাকী শয্যায় যৌবনের নানাবিধ বদভ্যাস অনুশীলন করে চলছি ।

এতটা বিসদৃশ ব্যাপার কেবল আমার ভাগ্যেই লেখা ছিল! পড়াশুনায় যথেষ্ঠ ভাল ছিলাম। সেই ভালটাকে যথাযথভাবে কাজেও লাগালাম। বিএ পাশ করে গ্রাম ছাড়লাম। এক সুযোগ্য মুরুব্বীর জোরে জেলাপ্রশাসনে নাজির পদে চাকরীটা সহজেই হয়ে গেল। হাসিনা তখন বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে যৌবনে পা রাখি রাখি মুহূর্তে।

আজকের দিনের শহুরে হিসেবে সে তখন নিতান্তই শিশু নিশ্চয়; কিন্ত তখনকার দিনের পাড়াগেঁয়ে হিসেবে তার তখন স্বামী-সংসার বুঝে নেবার বয়স হতে চলেছে। বাড়ি থেকে তার মা তাই আমাকে ডেকে পাঠাল। আব্বার তখন বয়স হয়েছে-- শরীর দিনে দিনে অশক্ত হয়ে পড়ছে। হাসিনার মাই তখন আমাদের সংসারে কর্তা-গৃহিনীর দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। মহিলার যোগ্যতা ছিল-- নয়ত প্রথম স্বামীর সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়ে বেয়াইয়ের হাত ধরে চলে আসতে পারতনা।

আব্বারও নিশ্চয় সম্পত্তি বৃদ্ধির লোভ ছিল কিংবা সুন্দরী-প্রতাপশালিনী নারীর উষ্ণ-নিবিড় সান্নিধ্যলাভের দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষা ছিল। সে যাই হোক, এসবের ফল হিসেবে আমার আর হাসিনার জীবনটা যে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও নিতান্ত পুতুলখেলা হয়ে দাঁড়াল! ক্ষোভে, ঘৃণায় আমি মহিলার চিঠিরও কোন জবাব দিলামনা; বাড়ি যাওয়াতো দূরের কথা। প্রকৃতপক্ষে আমি দিনে দিনে যত বড় হয়েছি, যত শিক্ষিত হয়েছি-- পুরো বিষয়টা আমার কাছে ততই কদর্য ঠেকেছে। এজন্য মাঝে মাঝে ঐ নিষ্পাপ হাসিনাকেও আমার অসহ্য লাগত-- মনে হত যেন ওকে উপলক্ষ করেই এতবড় দূর্ঘটনা ঘটতে পেরেছে, নইলে আমার আব্বা আর যাই হোক চরিত্রহীন ছিলেননা। কিন্ত আজ বুঝি যে হাসিনা আসলে ছিল পুতুলখেলার পুতুলের চেয়েও কম ক্রিয়াশীল পদার্থ।

আমাদেরকে নিয়ে খেলেছে সামাজিক অনিরাপত্তা, সম্পত্তি লোলুপতা, লালসা-রিরংসা-- আর এসবই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার সুযোগসন্ধানী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশমাত্র। নাজিরগিরি বহুকাল আগেই ছেড়েছি। কিছুটা মেধা, বাকিটা মামা(পাতানো) ও অনেকখানি বা হাতের জোরে পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কিছুকাল কাটিয়ে এখন আমি একজন সুইডিশ। দেশে যাওয়া হয় কি হয়না। আব্বা মারা গেছে বছর দশেক হল।

ভাই-বোনরাও এখন যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত-- অধিকাংশই শহরবাসী। হাসিনার খবর বিশেষ কিছু রাখিনি; শুধু জানতাম যে ওর বিয়ে হয়েছে আরেক ভূ-স্বামী পরিবারে। হায়রে সম্পত্তির নেশা! যে জীবনীর উপর হাসিনার কিছুমাত্র হাত ছিলনা সেই জীবনীই হাসিনাকে ভাল বিয়ের সম্ভাবনাবঞ্চিত করছিল। পড়াশুনাও অবশ্য ওর বেশিকিছু হয়নি। বেশ বাড়ন্ত গড়নের হওয়ায় স্কুলে পড়াশুনাকালেই ওর মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মেয়ের একটা হিল্লে করতে।

ওকে বৌ হিসেবে মেনে নিলে ওর মা খুশি হত, নিশ্চিন্ত বোধ করত; আর এজন্য ওর প্রতি চোখ তুলে তাকাতেও ছিল আমার বিতৃষ্ণা। ওকে তাই খুব সহজেই আমি অস্বীকার করতে পেরেছিলাম। হাসিনার মায়ের চিঠির জবাবে আব্বাকে আমি পরিষ্কার জানিয়েছিলাম যে তাদের নিজ নিজ প্রয়োজনে আমাদেরকে নিয়ে তারা তথাকথিত বিয়ের নামে যে পুতুলখেলা খেলেছিল আমি তা ঘৃণা করি। ওটা কোন বিয়েই নয় এবং আমি কোনদিনই হাসিনাকে স্ত্রী বলে ভাবিনি। তাছাড়া আইনগতভাবেও ঐ বিয়ের কিছুমাত্র ভিত্তি নেই।

আব্বা প্রথমে চটেছিল খুব। আমাকে সম্পত্তি খেকে বঞ্চিত করাসহ আমার মুখ নাদেখা জাতীয় হুমকিও দিয়েছিল। কিন্ত আমি টলিনি। ততদিনে আমি উড়তে শিখে গেছি। আব্বার তৈরি খাঁচায় প্রত্যাবর্তনের দরকার আমার ছিলনা।

তাছাড়া মুখে মুখে যত হুমকিই আব্বা দেননা কেন আমার মুক্ত আকাশে বিচরণের জন্য যে জ্বালানী দরকার তার যোগান পেতে কিন্ত আমাকে বেগ পেতে হয়নি। আমার একেকটা উড্ডয়নের জন্য আমাদের পরিবার থেকে কয়েক বিঘা করে জমি বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্ত সেটা আমার মাথাব্যাথার বিষয় ছিলনা। এরপর বিশটি বছর কেটে গেছে। বিদেশী স্ত্রী, সাদা ফুটফুটে সন্তান নিয়ে আমার সমৃদ্ধ সুখী জীবন। কবে কোন বর্বর পিতা আমার জীবনে কী ঘটনা ঘটিয়েছিল তা আর আমাকে ততটা ভাবায়না।

আব্বার প্রতি আমার রাগটাও অনেক কমে গিয়েছে। এমনকি মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় যে তাদের খাঁচা থেকে মুক্তির ব্যাকুলতার দরুণইতো আমার আজকের সাফল্য-- আমার অন্য ভাইয়েরাতো আমার অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন পৃথিবীর বিচিত্র কিছু খবর যেমন-- বৃষ্টি নামাতে ব্যাঙের বিয়ে, ভূমির উর্বরতা বাড়াতে কেঁচোর বিয়ে, গাছের বিয়ে, ভূতের বিয়ে জাতীয় খবরগুলো জানতে পারি তখন সেই মধুমতি নদীতে উজান ঠেলে চলা নওশার নাও মনে পড়ে। একটু হাসি পায় আবার একটু বিষণ্নও হই বৈকি। ২০১০ সালের আগস্টের একদিন।

আমি মধুমতি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। সেই মধুমতি আজ আর নেই। এখন এটা ক্ষীণতোয়া শান্ত-মিষ্টি একটা নদী। দুইপাড়ে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। একসময় যে নদীর এপাড়ে দাঁড়ালে ওপারের দিগন্তরেখামাত্র চোখে পড়ত সে নদীর এপাশ-ওপাশ এখন অনায়াসে কথা বিনিময় করা যায়।

তবুও নদীটাকে আমার বড় ভাল লাগল-- বড় আপন। নদীর পাড়ে আমার সাথে আজ হাসিনা। আমার আসার সংবাদ পেয়ে ম্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে। জীবনে এই প্রথম আমার হাসিনার সাথে এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা হলঃ ঃ ভাবীরে আনলেননা ক্যান, ভাইজান? ঃ তোর ভাবীরে আনলে শীতে আইতে হত। এই ভাদুরে গরম তার সহ্য হইতনা।

ঃ ভাবী খুব সোন্দর, না ভাইজান? আমি নিঃশব্দে একটু হাসি। ঃ তোর খবর বল। তোর স্বামী মারা গেল কীভাবে? ঃ পানিতে পড়ে। তারতো মিরিগি ব্যারাম ছিল। হাসিনার স্বামীর মৃগীরোগের খবর আমার জানা ছিল।

ওরা এটা না জানিয়েই হাসিনাকে বৌ করে নিয়ে যায় বটে কিন্ত জানাজানি হবার পর ওর মা ওকে আর পাঠাতে চায়নি। কিন্ত হাসিনাই নাকি জোর করে গিয়েছিল। এনিয়ে মা-মেয়ের খানিকটা মনোমালিন্যও হয়েছিল। ঃ তোর ছেলেতো বড় হইছে দ্যাখলাম; পড়াশুনা কী করছে? ঃ আমি কিন্তক ভাইজান এসব নিয়া আলাপকরার জন্যি আপনেরে এহানে ডাইকে আনি নাই। এবার আমার স্পষ্টতঃ অস্বস্তিবোধ হতে লাগল।

হাসিনা আমাকে নদী দেখাবার কথা বলে এখানে এনেছে। নদী আমি একাই দেখতে পারি কিন্ত সেকথা হাসিনাকে আজ বলিনি। বাল্যকালের রূঢ়তা আজ আমাকে নিশ্চয় মানায়না। ঃ তুই কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাস? আপনেরে বিশেষ কিছু বলার কপাল নিয়া কি আর আমি দুনিয়ায় আইছি? আমার খালি একখানই কথা ভাইজান--একই অন্যায় আপনের-আমার দুজনার সাথেই অইল কিন্ত আপনে ঠিকই পরতিবাদ করি আপনার ভাগ্য আপনে গড়ি নিলেন। আমি ক্যান পারলামনা ভাইজান? ঃ সবার ভাগ্যতো আর----- ঃ থাক ভাইজান, ভাগ্যের দোহাই আমারে আপনেও দিয়েননা।

ও আমি জনমভর শুনছি। দ্যাড়শ বিঘা জমির মালিক আমি পরের বাড়িতে, পরের আশ্রয়ে,পরপরভাবে মানুষ হইছি। আমার সম্পত্তি যারা ভোগদখল করছে তারাও আমারে সুনজরে দ্যাখেনাই। আপনের ভাইবোনগো চড়-থাপ্পড়, চিমটি-খামচা খাইয়াই আমি বড় হইছিলাম। মায়ের কীর্তির জইন্য আপনাগো পরতিবেশিরাও আমারে ঠেস দিয়া কতা কইত।

সব হজম করছি। কুনোদিন মুখ তুইলাও কারো সাথ কতা কইনি; ক্যান জানেন? আমি নিরবে ওর মুখের দিকে তাকালাম। আমার চোখে ওর ভেজা ভেজা চোখের তীক্ষ্ণ-স্থির দৃষ্টি রেখে বলল, আপনের জইন্য, কেবল আপনেরে পাব বইলা, নিজেরে আপনের বৌ বলি মানতাম বইলা। ‘কিন্ত---’ আমি কিছু একটা বলতে গেলাম। ঃ থাক ভাইজান, আমি জানি।

আমারে বৌ বলে কুনোদিন আপনে ভাবতে পারেননি, এইতো? আমাদের বিয়ারে বৈধ বিয়া বলা যায়না, এইতো? তাতে কী ভাইজান? আমিতো মনে মনে আপনেরে স্বামী বইলাই জানছি। একজন মিরগী রুগীর সাথে আমার দুইবছর সংসার করতে হইছে , সাধ্যমত মানুষটার যত্নও করছি কিন্তক কুনোদিন ভাবিনাই যে স্বামীর সংসার করছি। আমার কপাল যখন ভাঙছিল তখন আপনি দ্যাশেই ছেলেন ভাইজান, চাইলে আমি পালায়া ফরিদপুর গিয়া আপনের পায়ে ধরতি পারতাম, আপনেরে স্বামী দাবী করি সামাজিক বিচার চাইতে পারতাম, আপনের বাপও এর পক্ষে ছিল; কিন্তক ক্যান করিনি জানেন? ঃ কেন? আমার কণ্ঠের ক্ষুব্ধতা আামর নিজের কানেও বাজল। ঃ কারন ভালবাসার মানুষেরে জোর করি বাঁধতে নেই, যদিনা সে নিজেই বাঁধনে জড়াতে আগায়া আসে। এতক্ষণে আমার ভেতরটা কেমন কাঁপতে শুরু করল।

এই প্রায় পড়ন্ত যৌবনে এক বিগত লাবণ্যময়ীর মুখে তার ব্যর্থপ্রেমের হাহাকার শোনাটা যে কতটা অস্বস্তির যদি সেই প্রেমাস্পদ হয় স্বয়ং। ঃ দ্যাড়শ বিঘা জমিন আমার কুনো কামেই আসেনি ভাইজান। ওর বদৌলতে আমার না বাড়িছে সম্মান, না গড়তে পারছি আমার জীবন। বরং ঐ জমিনের লোভে যারা আমার দিক চোখ তুলে চাইত, আমার অস্তিত্ত্ব তাগের কাছে চক্ষুশূলের মতই মনে হইত। ক্ষমতাহীনের সম্পদ তার বিপদের বড় কারণ ভাইজান, আমার জীবনে আমি তা হাড়ে হাড়ে বুঝছি।

আমি কী বলব ওকে? কী বলে সান্ত্বনা দেব? দেড়শ বিঘা জমিতো ওর এখন সত্যিই নেই। যতদূর জানি ওর মায়ের অংশটায় আমার আব্বার ঔরশে ওর মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া ভাই-বোনদের সমঅধিকার। আর ওর অংশটাতো কবেই কত প্রয়োজনে বাঁধা দেয়া, বিক্রি করা শুরু হয়েছিল। এমনকি আামর বিদেশ যাত্রার সময়েও--------: সে যাহোক, এখন যে ঐ সম্পত্তির ঠিক কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা আমার জানা নেই। তবে পৃথিবীর খবর যতখানি জানি তাতে এটা জানি যে হাসিনার কথাই ঠিক-- ক্ষমতাহীনের সম্পদ সত্যিই তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়-- পরিবার-সমাজ-সংসারেতো বটেই, যুগে যুগে দেশ এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে।

ঃ সম্পত্তি নিয়ে আমার কুনো দুঃখ নেই ভাইজান। আমার দুঃখ কেবল একটাই-- যে সম্পত্তি ঠেকাতে আমার মা আমার জন্মের পরই আপনের সাথে আমার কবুল করি দিছিল, যে সম্পত্তির কারণে মা আমার আমারে বুকে করি আপনের বাপের ঘর করতি আসতে বাধ্য হইছিল সেই সম্পত্তি আমার জীবনে আপনেরে আটকাতে পারলনা। বিষয়-সম্পত্তির মায়াজাল কাটি আপনে ঠিকই বারায়া যাতি পারলেন। তাহলি অর্থের ক্ষমতা কতটুক ভাইজান? ক্যান মানুষ এর জন্যি এত হা-পিত্যেশ করে? এই জটিল প্রশ্নের জবাব দিতে কেন জানি আমার ইচ্ছে করলনা। এ কথাও বলতে ইচ্ছে করলনা যে এই সীমিত সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপ্তিময় সম্পদের হাতছানি আমাকে নিয়ত তাড়িত করত।

কুয়োর ব্যাঙ হয়ে সীমিত গণ্ডির মাঝে লাফালাফি করা কিংবা খুঁটোয় বাঁধা গরুর মত শুয়ে শুয়ে জাবরকাটা আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিলনা। আমার সংকল্প ছিল, সংকল্পের দৃঢ়তা ছিল, পুরুষ হয়ে জন্মাবার সুবিধাটুকু ছিল, আর ছিল ভাগ্যের সমর্থন। আমার যা ছিল তা হয়ত হাসিনার ছিলনা। লিঙ্গগত পার্থক্য তাকে তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা থেকে বহুদূরের কঠিন বাস্তবের বেড়িতে আটকে রেখেছিল যার পেষনে আর যাই হোক আত্মপ্রতিষ্ঠার সংকল্পের অঙ্কুর গজিয়ে ওঠার অবকাশ পায়না। তার ভেতর তাই কেবলই ছিল একজনের প্রতি অন্ধ-নিঃশর্ত সমর্পন।

কিন্ত কেবল একপাক্ষিক প্রেম আর সমর্পন দিয়ে জগতে কীইবা হয়? ওতে কেবল নিজেকে নিঃশেষে ক্ষয় করাই হয়, জয় হয়না কিছুই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিমাকাশে অস্তাচলগামী রক্তবর্ণ সূর্যটা অসুখী নববঁধূর নিরুৎসুক পতিগৃহে যাত্রার মত করে একটু একটু অদৃশ্য হচ্ছে; যেন শেষবারের তরে এতকালের আপনভাবা ঠাঁইটাকে, অবাধ বিচরণের আঙিনাটাকে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ছলছল চোখে দেখে নিচ্ছে। হঠাৎ আমার মনে হলঃ এমনি করেই বুঝি একদিন হাসিনা তার স্বামীর ঘরে গিয়েছিল-- আহা! কত নিদারুণ ছিল সেই যাত্রা! জীবনে এই প্রথম আমি হাসিনার হাত ধরলাম। তারপর বললাম, বাড়ি চল হাসিনা, রাত হয়ে এল যে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।