ছুটির দিনের আমরা তিন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম ধানমন্ডি লেকে। আশে-পাশে কপোত-কপোতির যুগলবন্দি জুটি দেখে চায়ের কাপে হতাশার চুমুক দিল ইমন ও রাশেদ। কারণটা যথার্থ। বয়সের অংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদর বেতনের অংকটা যে বাড়েনি। ওদিকে চুল-দাঁড়ির রংটাও পাল্টাতে শুরু করেছে।
বাতাসে শুন্য আম্ফালন ছুঁড়ে ইমন তাই বললো-‘বুঝলি দোস্ত,জাতের মেয়ে কালোও ভাল। ’ রাশেদটা বরাবরই ঠোঁট কাটা। পাশ কেটে চলা এক ফর্সা মেয়ের প্রতি প্রলুব্ধ দৃষ্টি হেনে সে বললো-‘যাহ,আলকাতরার কোন টেষ্ট আছে নাকি? ফর্সা মেয়ের ঘামও বেশ সুগন্ধ। ’ইটের জবাবে পাটকেল মারতে দেরি করলো না ইমন-‘কুত্তার নাক আমদানী করলি কবে ?’
ঝগড়া থামাতে অগত্যা দুজনের চায়ের বিল মিটিয়ে আমি বললাম-‘আচ্ছা ঠিক আছে,কালা-ধলা যাই হোক সুন্দর মেয়ে হলে তোদের চলবে। ’ এবার তারা চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।
চোখ পাকিয়ে দুজনই বললো-ঘটক পাখি ভাই,আফনে সুন্দরের কি বোঝেন ? ইহা কি বস্তু তাহা কি কখনো চাখিয়া দেখিয়াছেন? ’
সত্যিই তো। আমি বুঝবো কিভাবে? যৌবনের শেষ ঘাটে রয়েছি,অথচ আজ পর্যন্ত কোন লক্ষী ট্যাঁরা অবধি আমার দিকে দৃষ্টিবাণ হানার আকর্ষন বোধ করেনি। তাই আমি বুঝিনা সুন্দর কি বস্তু ? সেটা খায় না মাথায় দেয় ? তার রং-রুপ,রসই বা কেমন ?
প্রশুগুলো কেমন যেন পাগলাটে। সুন্দর তো নানান রকম হয়। কোনও কোনও সুন্দর কাছে টানে আবার কোনও কোনও সুন্দর দূরেও ঠেলে দেয়।
মানে, হিমালয় বিশাল সুন্দর বলে সমভ্রম হয়, আর ফুল ছোট সুন্দর বলে ছিঁড়ে হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করে, তাও নয়। আমার মনে হয়, একেকটা সুন্দরের আলাদা আলাদা ধরন থাকে। রুপালী জগতের তারকাদের কথাই ধরুন,এক এক জনের সৌন্দর্য একেকরকম। তাই মনে সমভ্রম হয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমার যেমন মৌসুমির জন্য হৃদয়ে তিয়াস জাগে ,তেমনি ভিনদেশের মনিকা বেলুচ্চিকে দেখলে হাতদুটো নিশপিশ করে, তবে অবশ্যই তাঁর সম্মতি নিয়ে !
যড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন,তাই না ? ইনিয়ে-বিনিয়ে আমি কেমন সৌন্দর্যের সঙ্গে কামনা-বাসনা মেশানোর চেষ্টা করছি ? এতেও আবার অনেকে রাগ করে থাকেন।
কারণ আদিম ক্রিয়া-কর্মটির কথা তুললেই লোকে বলে‘ছি, ছি এ আবার কি কথা’ ‘সবকিছুতেই এসব কথা কেন, সুন্দর মানে সুন্দর,আর কি?’ ইত্যাদি জাতীয় কথা। অথচ সুন্দরের আলোচনায় জৈবিক চাহিদার কথাটি আপনি বাদ দিতে পারবেন না। যেমন ধরুন, সাদা-কালোর সম্পর্ক।
সাদারা বরাবরই ঢেঁড়া পিটিয়ে আসছে, কালোরা কুৎসিত-কদাকার। কেন বলে জানিনা, কালো গোলাপ হয়তো তারা দেখেনি।
যাক গে, শুধু বলে ক্ষান্ত হয়নি, কালোরা যে জন্তু-জানোয়ার সমতুল্য সেটা প্রমানে এক জন কৃঞ্চাঙ্গ মহিলাকে উলঙ্গ করে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল সাদারা। যতদুর মনে পড়ে,সেই মহিলার কেতাবি নাম রাখা হয়েছিল সারা বার্টম্যান। কেউ খোঁজ করতে চাইলে ‘হটেনটট ভেনাস’ লিখে গুগলে সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। তবে এই যে কালো মানে ভাল নয়, এই বোধটা কিন্তু বঙ্গদেশে থেকেই গেল। নইলে আংরেজ চলে যাওয়ার ষাট-পঁয়ষট্টি বছর পর আমাদের এই পোড়া দেশেও রং ফর্সাকারী ক্রিমের এত রমরমা কেন বলুন তো! ছোটবেলায় দেখেছি শিক্ষিত বাড়িতে অন্তত প্রকাশ্যে ‘ফর্সা না হলে হবে না’ বলাটা মুশকিল ছিল।
দিনকাল বদলে গেছে। তাই ভাল লাগে না। তবে একটা কথা ভেবে সান্তনা পাই যে, এখন মেয়েরা নয়, ছেলেদের মধ্যেও ফর্সা হওয়ার ধূম পড়েছে। ফর্সার পেছনে মেয়েরা ছোটে ভাল বিয়ের জন্য,কিন্তু ছেলেরা কেন ছোটে, সেটা ব্যোমযাত্রীর ব্যাপার। দেখে মনে হয়, মনের দিক থেকে ‘কলোনাইজড’ হয়ে থাকার যুদ্ধে হারলেও, অন্তত জেন্ডার বিষয়ে একটা ভুল সাম্য এল, তাই আসুক।
শুধু মেয়েরা কেন ছেলেরাও হারুক।
বিলেতি প্রসাধনী ব্যবহারের হিড়িকের মতো ওই দেশের সাহেবদের এক ধরনের মডেল শরীরকে বাঙ্গালীরা রোল-মডেল হিসেবে নিয়ে থাকে। অথচ গোটা বিলেত খুঁজলেও ওই রোল-মডেলের মতো একজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ ! আমার এক সাংবাদিক বন্ধু তথ্যটা জানিয়েছিল-‘লন্ডন অলিম্পিক কাভার করতে সে বিলেত যায়। হিথরোতে নেমেই তার চক্ষু চড়কগাছ। ও মা ! সাদা লোকদের অধিকাংশই ছবির সাহেবদের মতো নয়।
অনেকেই বেশ বেঁটে, মোটা, ও তার মায়ের মত দেখতে। অনেকেই থপথপে চর্বির আড়তদার, কেউ কেউ আমাদের মত লুলা (বলতে নেই) টাইপ। সাদা হলেও তো সাহেব মেম নয় এরা!’ বন্ধুর সত্যভাষন শুনে কি যে নিশ্চিন্তি লাগল কী বলব! কিন্তু নিশ্চিন্ত হলে কী হবে, বিজ্ঞাপন আর সেলুলয়েডের জোরে সেই রোল-মডেলই যে আমাদের সকলের আরাধ্য হয়ে গেল। গোলগাল ভদ্রস্থ বাঙ্গালীদের হারিয়ে টিভি পর্দায় এখন ‘চিকনি চামেলী’রা করে খাচ্ছেন। ভিনদেশের কৃঞ্চাঙ্গ নাওমি ক্যাম্পবেল নানান রকম কায়দা কানুন করে ‘সাদা শরীর’ বানালেন, তাঁকে নকল করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ভারি বুক আর বড় নিতম্বের অধিকারিণী মেয়েরা না খেয়ে না দেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
যদিও পরিবর্তনের এই তালিকায় শুধু কালোরা নয়, সাদারাও আছে। খালি সেরেনা উইলিয়ামসকে কেউ কিছু করতে পারল না। টেনিসের প্রতাপে উনি তার ভারী বুক আর পেছনের নিন্দেকে কোর্টে দাঁড়ানোর কোনও সুযোগই দিলেন না। নিজের ছন্দে আর আমাদের আনন্দে রানি হয়ে থাকলেন সেরেনা।
এই সুন্দরের আইন-কানুন বরাবরই সুন্দর আর কাম্যর একটা বিভেদ তৈরি করে দিয়েছিল।
সাহেবরা এক দিকে কালোদের কালো বলে,আবার বিছানায় তাদের কামনা করতেও পিছপা হয়না। বরং সাদাদের বয়ানে, কালো ছেলে আর মেয়েরা যেন যৌনতার জান্তব প্রতীক বলে বার বার ফুটে উঠেছে। তাই কালো মেয়েদের ধর্ষণ করতে সভ্য দেশগুলোর ‘ইরেকশনে’ কোন গোল বাঁধেনা । কালো ছেলেদের শারীরিক ভাবে বর্বর এবং সম্ভাব্য ধর্ষক বলে সমাজচিন্তা তৈরি করতেও বাধেনি ইউরোপিয়ান সাদাদের।
ইতিহাসের পথ বেয়ে এই যে সুন্দর আর কাম্যের বিভেদ, তা কিন্তু খরস্রোতা নদী হয়ে বইছে আমাদের জীবনে।
বাঙ্গালীর আটপৌরে জীবনে একমাত্র স্বীকৃত যৌনতার জায়গা তো বিয়ে, তাই না? দাঁড়ান, দাঁড়ান, আবার দেখছি কেউ কেউ চটে যাচ্ছেন এই ভেবে যে আমি বিয়ের বাইরে যৌনতার ক্যানভাস করে সমাজকে ফুটো করে দিচ্ছি। সেই কম্মোটি কিন্তু আমার প্রচারের অপেক্ষায় বসে নেই। আমি শুধু বলতে চাইছি, শুধু বিয়ে করলেই যদি যৌনতার স্বাদ মেলে, তবে সেখানেও কেন শুধু সৌন্দর্যের ধারণা দিয়ে পাত্র-পাত্রী বাছা হবে? কেন সেখানেও কামনা-বাসনার কোনও জায়গা থাকবে না? আমাদের ঘুনে ধরা সমাজে অলিখিত একটি ধারনা আছে- ফর্সা ছেলে বা মেয়ের বিয়ে হলে তাদের শিশু সুন্দর হবে। আর ওই সাইনবোর্ডটি আগলে ধরে স্বামী আর স্ত্রী পরষ্পরকে কামনা করে বছর পঞ্চাশেক বিছানা ভাগ করবে, আর কোনও দিকে চাইবে না, এই ধারণার ভিত্তি কি?
ভিত্তিটা পুর্বপুরুষদের হাত ঘুরে আমাদের কাঁধে চেপেছে । তাই ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটি কাউকে বলতে পারে না যে রোমশ কালো মেয়ে না হলে সে জাগ্রত হয় না।
বি এ পাশ ফর্সা মেয়েটি বলতে পারে না ওই ইঞ্জিনিয়ারের কোনও দোষ নেই, কিন্তু সে কাছে এলেই ওর দম আটকে আসে। এত কষ্ট যে,শেষ পর্যন্ত যৌনতাতেই ঘেন্না ধরে গেল। তবুও ওরা হাসি মুখে সংসার করে। ছেলেটি কমপিউটারে কী সব সাইটে মাঝে মাঝে একা একা যায়। সেখানে মোটা কালো রোমশ মেয়েরা ডাকাডাকি করে, শরীর মেলে ধরে।
মেয়েটা তা জানে। কমপিউটারে সব গতিবিধির ইতিহাস তো মোছা যায় না। ছেলেটা বোধ হয় খুব চেষ্টাও করে না। মেয়েটিও কিছু মনে করে না। ও বোঝে।
তার নিজের জন্যেও কিছু ব্যবস্থা করা আছে,সেটা কাউকে বলতে চায় না। তাই থাক। ওরা ঠিক করেছে, একটা বাচ্চার জন্যে এবার চেষ্টা করবে। দুপুরবেলা মেয়েটি ছেলে আর মেয়ের নাম ভেবে ভেবে রাখছে। তবে এসব ভাবলে ওর বড় কান্না পায়।
বালিশ ভিজে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।