সেলিম আল দীন কেন দীন হলেন না আরো অনেকের মতন!
রবিউল করিম
সেলিম আল দীনকে নিয়ে, তাঁর নাটক নিয়ে নানান পণ্ডিতজন নানা ভাষণ দিয়েছেন এবং তা নমস্য। আমার এই লিখনের সাথে তার কোনো মিল-অমিল খুঁজতে চাওয়াটা বোকামী হবে পূর্বেই পাঠককে এটি জানিয়ে রাখতে চাই। আমি একজন সাধারণ দর্শক হিসাবে এ ক’দিন তাঁর জন্মোৎসবকে ঘিরে নাটক উপভোগ করলাম শিল্পকলা মিলনায়তনে। যার অন্যতম আয়োজক ছিলো ঢাকা থিয়েটার। যৈবতী কন্যার মন, প্রাচ্য, নিমজ্জন, হরগজ এই চারটি নাটক সেখানে মঞ্চস্থ হয়েছে।
প্রতিটি নাটক দেখার পরই একরাশ মৃত্যু, মৃত্যুকেন্দ্রিক চিন্তা আমাকে অবশ, বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। আমার মাঝে প্রশ্ন জেগেছিল, কেন তিনি শুধু মৃত্যু নিয়ে, মানবিক বিপর্যয় নিয়ে নাটক লিখেছেন। হাসি নিয়ে নয়, জয় নিয়ে নয়। শুধু কেন পরাজয়, হতাশা, মৃত্যু। প্রাচ্য রীতিতে যখন থেকে তিনি লিখতে শুরু করলেন তখন থেকেই তাঁর ভেতরে এই চৈতন্য আমাকে বিস্মিত করে।
অথচ এই তিনিই তো লিখেছিলেন, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন এসব। তবে কি এই প্রাচ্যই মৃত্যুকে ঘেরা এক উপাখ্যান। নাকি সেই তুমুল আলোচিত সেই বাক্য, মৃত্যু কেন্দ্রিক সাহিত্য বা শিল্পই জগতে টিকে থাকে, অন্য সব মরে যায়। সেই দার্শনিক জায়গা থেকেই কি তিনি অমর হবার বাসনায় ক্রমাগত লিখে চলেছিলেন এসব? দ্বৈতাদ্বৈতবাদ। তখন তাঁকে ভয়াবহ চতুর বলে মনে হয়।
তার চতুরতার আরো বিবরণ শুনি যখন তার ছাত্ররা বলে যে, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে তিনি এমন সব মূর্খদের শিক্ষক বানিয়ে দিয়ে গেছেন যা কল্পনাতীত। কেননা তিনি ভালো করেই জানতেন, জ্ঞানীরা পূজা করেনা, মুর্খরা পুজা করে। তিনি পুজিত হতে ভালবাসতেন। তিনি গুরুবাদী তরিকায় বিশ্বাস করতেন। গুরু-শিষ্য পরম্পরা।
অথচ দেখি তার শিষ্যের সংখ্যা প্রচুর হওয়া সত্ত্বেও কেউই তাঁকে ধারন করতে পারেন নি সমূহভাবে। তবে কি তিনি প্রকৃতঅর্থেই কোনো শিষ্য তৈরি করতে চাননি? নাকি অক্ষমতা? এক্ষেত্রেও তাকে চতুর বলে মনে হয়। কেননা, তিনি জানতেন একালের শিষ্যরা বড়ই অকৃতজ্ঞ। তাঁর মুত্যৃর পর হয়ত সমূহ কীর্তিই শিষ্যের দ্বারা অবমূল্যায়িত হতে পারে এই ভেবে তিনি তেমন কাউকে রেখে যাননি আমাদের কাছে। তিনি বরং ভরসা রেখেছিলেন আপামর মানুষের উপর।
যারা তাকে ঠকাবে না। তিনি ঠকতে চাননি। এখানে তাকে ভীষণ ভীতুমানুষ ছিলেন বলে আমার মনে হয়! তাঁর মনোজগত কেন এসব দ্বারা তাড়িত ছিল তা বিস্ময়কর ঠেকে। আমাকে ভীষণ দোদুল্যমান করে তোলে তার এইসব চেতনা। তাঁর দ্বৈতাদ্বৈতবাদ।
এই জন্যই কি তিনি মৃত্যু নামক এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করলেন যাকে প্রশ্ন করা যায় না। যাকে শুধু পুজা করা যায়। আমি আবারো ভাবি, আচ্ছা, সেলিম আল দীন যদি ঢাকা থিয়েটারের সাথে যুক্ত না হতেন তবে কি ঘটত? এগুলো কি নাটক পদবাচ্য হতো? নাসিরুদ্দিন ইউসুফ যদি তার বন্ধু না হতেন? তবে কি একটা নাট্যসংগঠন ক্রমাগত তাঁরই নাটক নিয়ে পড়ে থাকত? এসব প্রশ্ন আমাকে ভাবায়। আর আমি ভাবি, সংগঠন জিনিসটাই কি ভয়াবহ! যা নিজেই একসময় অস্বীকার করে বসে নিজেকে। আর বন্ধ্যাত্বের কথা নাই বা বললাম।
তবে কি ভেবে সেলিম আল দীন সংগঠনের খপ্পরে পড়তে গেলেন? তখনও আমার মনে হয় তিনি ভীষণ চতুর। তিনি জানতেন যে সংগঠন ছাড়া কোনো আদর্শকে বা চিন্তাকে জনগণের মধ্যে প্রচার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সংগঠনের ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তার লেখনীর শক্তিই একসময় সংগঠনের কুপমন্ডুকতার বাইরে নিয়ে আসবে, তিনি সবার হয়ে উঠবেন। এমন প্রত্যাশা তাঁর ছিল।
তিনি দেখেছিলেন, আরো আরো সব মহারথীদের মৃত্যু। যা কিনা সংবাদের শিরোনাম ভিন্ন কিছু নয়। তাই তিনি আয়োজন করে গিয়েছিলেন এসব অমর হবার উপকরণ। তাই তো দেখি তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষ। শামসুর রাহমান মারা গেলেন, মাহমুদুল হক মারা গেলেন, সমুদ্র গুপ্ত মারা গেলেন, আবদুল্লাহ আল মামুন মারা গেলেন কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাঁদের ঘিরে কোনো উৎসব পালিত হয় না, মনে রাখে না মানুষ, দুএকটা সভা-সেমিনার ভিন্ন।
অথচ সেলিম আল দীনের দিকে তাকান, তিনি কি ভয়াবহরূপে উপস্থিত। আমার মনে হয় যে মৃত্যুসাধনা তিনি করে গিয়েছিলেন জীবদ্দশায় শবসাধকের ন্যায়। এ যেন তারই প্রতিদান। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পুনর্জন্ম ঘটেছে। এইবার তার প্রতিদ্বন্দ্বি শুধু তিনি।
এখানে তাকে হারাবার কেউ নেই। সারা জীবন যে অমূল্য সম্পদ নিয়ে শংকিত ছিলেন হারানোর ভয়ে। তাকে তিনি জয় করলেন। এখানেও তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।
তাঁর নাটক দেখতে দেখতে আরো একটি বিষয় আমাকে ভাবিত করল, কোথায় তাঁর নিজস্বতা বা মৌলিকত্ব? তাঁকে তো ব্লেন্ডার মেশিন ভিন্ন কিছু মনে হয় না! আমাদের প্রাচীন যেসব সাহিত্য, ভাবনা তাকেই তিনি বর্তমানের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছেন, এ আর নতুন কি? নাট্যকার হিসাবে তখন তার দেশজোড়া খ্যাতিকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে করে।
বরং মনে হয় তিনি বড় কবি। কথার যে ইন্দ্রিয়জাল বুনে তিনি একবার আমাদের নিয়ে যান প্রাচীনে আবার বর্তমানে, যে অভাবিত দৃশ্যকল্প তৈরি করেন তা তো এক কবিরই কাজ। অথচ শুনেছি জীবদ্দশাই তিনি নাকি কবি এই ডাকটির জন্য মুখিয়ে থাকতেন। কেউ যদি তাঁকে কবি বলে ডাকত তবে তিনি খুব খুশি হতেন। তিনিও জানতেন, তিনি কবি ভিন্ন কিছু নয়।
একমাত্র কবিরই কল্পনায় থাকে জগতের সমূহ জ্ঞান।
তাই একেকবার মনে হয়, সারাটি জীবন তিনি শুধু দ্বৈতেরই চর্চা করে গেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।