একটু আগে বাড়ি ফিরলাম। সব ঝামেলা চুকে। দরোজায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দ্যাখি, এ-কী! আমার সমস্ত শরীর যেনো পুড়ে যাচ্ছে শারদীয় জোছনায়, তীব্র আলোয়।
আমি কি এখন সত্যি বেঁচে আছি? নাকি জীবন্মৃত/ পড়ে আছি বিলম্বিত মাস্তুলের মতো? Ñ চাঁদ সদাগর কবিতায় এভাবেই লিখেছিলেন শামসুর রাহমান।
সাতচল্লিশের ভারত-পাকিস্তান ভাগের প'রে পূর্ববঙ্গ ভুখন্ড বাঙলা সাহিত্যেও একটি স্বতন্ত্র সৌধ-ভিত্ নির্মাণে আর্বিভূত হয়, একদিন সেই ভূ-খন্ডের নয়া সাহিত্য প্রবহমানতায় পঙ্খিরাজ নাও ভাসে, তিনি নৌকোয় চেপে সাহিত্যের খেরোখাতা হাতে নিয়ে বললেন, আমি কবিতার বৈঠায় হাত রাখলাম।
তিনি বাঙলাদেশের কবিতার প্রাণপুরুষ। কবি প্রাণ শামসুর রাহমান। তিনি আমাদের স্বপ্নের রূপকথার দরোজা খুলে দিয়ে জাতিকে দিয়েছিলেন আত্মআবিস্কারের গৌরব।
বহুল সমারোহে কবিতার স্বর্ণডালিকে যে কবি সাজিয়েছেন তিনি শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রোত্তরকালে তিরিশের কবিকূলে সফল উত্তরসূরী এবঙ তাঁর নিজের কালের সার্থক রূপকারদের পুরোধা হিসেবে এ কীর্তিত কবিকে নিয়ে গর্ব আর অহঙকারে সীমা নেই আমাদের।
তিনি এমন একটি স্থানে নিজেকে উদ্ভাসিত করেছেন যেখানে তার সমকালে তার প্রতিদ্বন্ধী বা তার সমশ্রেণীর কবি আর কাউকে দ্যাখা যায় না। এটা আমাদের বাঙলাদেশ এবঙ পশ্চিমবাঙলার সকল কবিই মাএ এ বিবেচনায় স্বীকার করবেন নিশ্চয়।
বাঙলা কবিতা কত বিচিত্র ও পাশ্চাত্যের কবিদেরও কোনো কোনো েেত্র ছাড়িয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ মেলে শামসুর রাহমানের বিভিন্ন কবিতা। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবরে ঢাকার মাহুতটুলিকে জন্ম নেয়া শামসুর রাহমান তার যাত্রা শুরু করেছেন বাঙলা সাহিত্যের প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে। ১৯৪৯ সাল, পুরান ঢাকার মাহুতটুলি লেনের এক সদ্য যুবার মন ডানা মেলেছিল কল্পনায়, ভাবাবেগ প্রকাশিত হয়েছিলো ছন্দবন্ধনে।
ভয়ে ভয়ে সেই রচনাকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি, সোনার বাংলা নামের সাপ্তাহিকে। সম্পাদক নলিনী কিশোর গুহ বেশিদিন অপোয় রাখেন নি। অজ্ঞাত পরিচয়ে কবির লেখা ছাপিয়ে দিলেন পরের সংখ্যাতেই। প্রসঙ্গক্রমে শিাবিদ, প্রাবন্ধিক মুস্তফা নুরউল ইসলাম জনকন্ঠে ‘প্রথম দেখার দিনগুলি’ স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “... আমাদের চাপাচাপিতে লাজুক গলায় কবি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেনÑ‘দান্তের নরক তুমি দেখেছে কখনো’। তারপর আউয়ে গেলেন সবটা।
পর পরই তাঁর অপর কবিতা কলকাতার নতুন সাহিত্যে মাসিক পত্রিকায় ‘কয়েকটি দিন ওয়াগনে’। ’’ তাঁর কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছে পূর্ব্বাশা, সেই ১৯৫১ সালেই। পূর্ব্বাশার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে তখন খ্যাত। শামসুর রাহমানের বয়স তখন বাইশ বছর। আর ১৯৫৩ সালে কবি বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকা শুরু করেন শামসুর রাহমানের মনে মনে ও তার শয্যার পাশে কবিতা দিয়ে।
এভাবেই তিনি ছয় দশকের অধিক কালব্যাপি কাব্যচর্চায় নিজেকে সুসংহত করে রেখেছিলেন।
আধুনিক বাঙলা কবিতার অপরিহার্য-অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব শামসুর রাহমান। ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বাঙলা কবিতার ধারাকে তিনি অত্যন্ত সৌন্দর্যমন্ডিত করে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। এই ধারাটি প্রগতিশীল অসা¤প্রদায়িক ধারা। বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রবহমান এই ধারাটিকে রূদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলো।
কিন্তু শামসুর রাহমানের মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কবির দৃঢ়তার মুখে তা পন্ড হয়ে যায়। এটি সত্য, বাঙলা ভাষাভাষি মানুষ তারা যেখানেই থাকুক না কেনো এই মহান কবিব্যক্তিত্বকে হৃদয়ে লালন করেন, করবেনও নিশ্চিত। তিনি দীর্ঘদিন তার হৃদয়, মনন ও মেধা দিয়ে নিরলস চর্চা করে আধুনিক কবিতা ও বাঙলা ভাষাকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে দিয়েছেন।
তিনি আমাদের কবিতাকে দিয়েছেন যৌবনের সৌন্দর্য, প্রজ্ঞার সৌরভ। সেই সঙ্গে বিশ্বকবিতার মানচিত্রে দিয়েছেন একটি সুনির্দিষ্ট স্থান।
তার কবিতার পাঠক একই সঙ্গে পাবেন বাঙালি সত্তার গভীর অনুভব ও আন্তর্জাতিক মনন। পাঠকের কাছে তাই তার কবিতা প্রেম যন্ত্রণা ও জীবনানুভবের আধুনিকতার উদ্ভাস। কখনো কখনো মনে হবে বাস্তব ও কল্পনার সমাহারে নির্মিত এক অলৌকিক ভূবন পরিভ্রমণ করে চলেছি। ৩১ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, তাতে তিনি লিখেছিলেন গ্রীক পুরাণকথিত ল্যাজারাস পুর্নজন্ম পেয়ে এসেছে এই পৃথিবীতে। তাকিয়ে দেখছে ‘এই সেই পৃথিবী সাবেকী’।
অনুমান করা চলে এই কবিতার জন্মসময়ই বাঙলা কবিতার আধুনিকতার জন্মসময়। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী যুগান্তরে ‘নিজস্ব উচ্চতায়’ লিখেছেন. “ তিনি তার কবিতায় গ্রিক পুরাণের অনুষঙ্গ অসাধারণ দতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। অ্যাগামেমনন, ইলেকট্রা এরকম গ্রিক পুরাণের নানা কাাহিনী তিনি আশ্চর্য কুশলতার সঙ্গে, আমাদের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে একটি সমান্তরলতা নির্মাণ করেছেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রাচীন ধ্র“পদী গ্রিক নাটক পড়াইÑতখন আমি শামসুর রাহমানের এসব কবিতা উল্লেখ করেছি। মাঝে মাঝে তার কবিতার চরণ পর্যন্ত পড়ে শুনেছি।
’’
পাশ্চাত্য ঢঙ্গে মিথভিত্তিক কবিতার বই লিখেছিলেন শামসুর রাহমান, ইকারুসের আকাশ, যার নাম। সেই বইয়ে শামসুর রাহমানের হস্তার দিয়ে প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করীম। মলাটের পেছনে বইয়ের বিষয়ে নামহীন জ্ঞাপন লেখাটিতে তিনি লিখেছেন ‘শামসুর রাহমান সম্ভবত আমাদের শেষ ইয়োরোপমনস্ক কবি। ’
তাঁর কবিতা এসে মিশেছে নানা রঙ, নানা স্রোত; কবিতার স্টাইল, ধরণ, সংজ্ঞা বদলে গেছে তার প্রতি কবিতায়। তিনি তার কবিতায় আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গণতন্ত্রের সংগ্রাম, ধর্মের সাথে অধর্ম তথা হিংস্র উগ্র সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে-কোথায় ছিলো না তার বলিষ্ট উচ্চারণ? বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালায় যেমন মায়ের মর্যাদা দিয়েছেন মাতৃভাষাকে, তেমনি ষাটের দশকের প্রতিটি গণআন্দোলনে তাঁর কবিতা ধারণ করেছে বাঙালির প্রাণের আবেগ-অনুভূতি।
আসাদের শার্টর মতো রক্তে ঝাঁকুনি-তোলা কবিতা যেমন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাঙলার গণজাগরণে মন্ত্রের মতো কাজ করেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠনে। বন্দি শিবির থেকে, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা এই দুটি কাব্যগ্রন্থ পুরোটা মুক্তিযুদ্ধেরই রক্তাত্ব দিনগুলোর দর্পণ। এখানে এমন কিছু কিছু কবিতা রয়েছে, যা মুখে মুখে ফিরেছে বাঙালির। তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা ইত্যাদি বহু কবিতা কন্ঠস্থ হয়ে গেছে সংস্কৃতিবান বাঙালির। স্বাধীন দেশে প্রতিক্রিয়াশীলদের পুনবার্সনকালে তাঁর কবিতা একটি মোনাজাতের খসড়া চাবুকের মতো নেমে এলো।
ধর্মীয় উগ্রতার সংক্রমনে ছড়াতে থাকলে তিনি লিখলেনÑ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। এরশাদের স্বৈরচারী সরকারের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যু হলে লিখলেন তিনি বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। তাঁর অসঙখ্য কবিতা লিফলেট হয়ে মানুষের হাতে হাতে গিয়েছে, উঠে এসেছে পোষ্টার, দেয়াললিখনে। স্লোগানে পরিণত হয়েছে মিছিলে।
উল্লেখ করতেই হয়, শহীদ নূর হোসেন নিহত হলে শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি মিশে যান মানুষের সাহসি মিছিলে।
তখন দেশের সকল কবিদের নিয়ে তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের শুভ সূচনা করেন।
দুই.
শামসুর রাহমান ছিলেন একজন সাংবাদিক। যদিও তিনি পরিপূর্ণভাবে কবিতায় সমর্পিত। তবু জীবনের তাগিদে একটু ভিন্ন পেশায় কাটিয়েছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। বেতাওে কিছুদিন কাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সংবাদপত্রের দফতরে।
কনিষ্ঠ সহ-সম্পাদক থেকে নিজেকে উন্নীত করেছিলেন এক সময়ের শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের আসন।
সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও শামসুর রাহমানের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের আগ্রহী ছিলেন না। উচ্চপদের মোহ থাকলে স্বাধীনতার পর দৈনিক পাকিস্তান যখন দৈনিক বাংলা হয় তখন তিনিই হতেন এর প্রধান সম্পাদক। শামসুর রাহমানের অনীহার কারণে কবি হাসান হাফিজুর রহমান দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক হন। পওে শামসুর রাহমান অনেকটাই পরিস্থিতি আর সহকর্মীদের চাপে সম্পাদকের দাযিত্ব নেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সম্পাদকের ভূমিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। শুধু সম্পাদনাই নয়, সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও সম্পাদকের কাঁধে আসে পড়ে। শামসুর রাহমান এ জটিল দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন। দৈনিক বাংলার সম্পাদক শামসুর রাহমান এশিয়ার অন্যতম সেরা সম্পাদকের হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক মিৎসুবিসি পুরস্কাওে ভূষিত হয়েছিলেন।
তিন.
তাঁর কবিতা নিয়ে বলবার এবঙ আলোচনা করবার মত সস্থির মনস্বিতা ও যোগ্যতা আমার অমতাই থাকবে সবসময়।
আমি বরঙ সেই মানুষ, লিখতে গিয়ে কবির মুখটি আজ ঘুরে ফিরে দ্যাখি। সেই তাঁর মুখ। য্যানো এখনো কী জীবন্ত! ঠোঁট য্যানো উচ্চারণের জন্যে প্রতিটি মুহূর্তে ...
শামসুর রাহমান আমার, আমাদের প্রিয় কবি। প্রিয় কবিকে দেখার ইচ্ছে বহুদিন ছিলো।
দুই হাজার ছয় সালের ১ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় অনুষ্টিত হয়ে জাতীয় কবিতা উৎসব।
উদ্বোধন করতে আসেন কবি শামসুর রাহমান। তখনো তিনি অসুস্থ। কবি শামসুর রাহমান এসেছেন, সকলে ঘিরে আছে। দূর থেকে তাঁকে দ্যাখছি। কাছে যেতে পারছি না।
শেষ পর্যন্ত কবির সাথে সাাত আমার মিললো। কথা হয় সংপ্তিই। সৌজন্য কুশল বিনিময় বলতে যা বোঝায়। কথাবার্তায় তাঁর সেদিন অস্পষ্টই ছিলো। সেই দিনের সেইরাত্রটি আর ঘুমাতে পারিনি।
প্রিয় কবির সাথে কথা বলার বিহ্বল আনন্দে।
একদিন শ্যামলি, কবির বাসায় গেলাম। ভয়ে ভয়ে গুটিয়ে ছিলাম আমি। কিছুণের মধ্যে সেই ভয় উপচে ফেলে দিলেন কবি স্বয়ং।
যখন শুনলেন কবি ও কবিতার প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগের কথা।
তিনি পরম øেহে কাছে টেনে নিলেন। আন্তরিকতায় আলিঙ্গন করলেন। একটি কবিতা দিলেন। সাতটি কবরে নুয়ে চুমো খায়। আমার সম্পাদিত দ্রোহকালের কবিতা কাগজ স্পর্ধা সবসময়ে’র জন্য।
প্রকাশিত হলোও। কবি দ্যাখলেন না!
কবির সাথে কথা ছিলো কবির একটি সাাৎকার আমি নিবো। সেটি আর হলো না !
প্রিয় কবি’র কাছে যাওয়ার যৎসামান্য বিচ্ছিন্ন স্মৃতিগুলো আজ উজ্জ্বল, আঁকড়ে ধরে রাখলাম এণ।
শামসুর রাহমান অনন্য। চিরঞ্জীব।
জয় হোক আগামি সকালে।
সহযোগী সূত্র : সমকাল, যুগান্তর, জনকণ্ঠ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।