তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
'কি ব্যাপার রোমেল? জরুরি তলব?'
'সাব্বির। আহ! সাব্বির। ইয়ার মেরা। এসেছিস দোস্ত? বস একটু, আমি চেঞ্জ হয়ে আসি। '
বলেই অন্দর রুমে ছুট লাগালো রোমেল।
আমি বিস্ময় নিয়ে বসে থাকলাম। ব্যাপারটা কি? হারামজাদা আমাকে দেখে এমন ভাব করলো যেন হাতে আকাশে চাঁন্দা পেয়ে গেছে। কেস তো খুব একটা সুবিধার লাগছে না। টাকা ধার চাইবে নাকি?
'চল দোস্ত। '
আমি রোমেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
গায়ে হাতা কাটা গেঞ্জি, পায়ে রানিং শু আর কোমড়ে বাঁধা ছোট্ট একটা প্যান্ট। ব্যাটা এতো ছোট হাফপ্যান্ট কোথা থেকে সংগ্রহ করলো খোদাই জানেন। লেডিস প্যান্ট নাকি? প্যান্টে যে রকম ময়ূরপঙ্খি রঙের সমাহার লেডিস বলেই তো মনে হচ্ছে! তবে এই মাইক্রোস্কোপিক হাফপ্যান্টটা পরার কি দরকার ছিলো বুঝতে পারছি না। এর চেয়ে কিছু না পরাটাই তো মনে হয় শোভন ছিলো।
'এসব কি রোমেল?'
'জগিং! জগিং হবে ইয়ার মেরা।
তুই হবি আমার কোচ। টাইম দেখবি, রেকর্ড রাখবি, উৎসাহ দিবি। এই আরকি। ' সবগুলো দাঁত বের করে বললো রোমেল।
'তোরও অলিম্পিকের হাওয়া লাগলো নাকি রে?' অবাক হলাম আমি।
রোমেলের মতো অলস ছেলেও কি-না অলিম্পিক ফিভারে আক্রান্ত! বিস্ময় ভাঙলো শীঘ্রই। ঘটনা প্যাঁচ খেয়েছে সেই আদি ও চিরন্তন কারণে। নারী!
রুমা আমাদের কলেজেই পড়ে। ফটকা টাইপ মেয়ে হলেও চেহারা খাপখোলা। এ মেয়ে কাউকেই খুব একটা পাত্তা দেয় না একমাত্র আসমতকে ছাড়া।
আসমত আমাদের কলেজের সেরা অ্যাথলেট। হান্ড্রেড মিটার দৌড়ে ঢাকা ইন্টার কলেজ রানার্স আপ। সোজা কথায় আমাদের কলেজের অন্য অনেক ইভেন্টের সাথেই হান্ড্রেড মিটার দৌড়ের চ্যাম্পিয়নের পদকটা মোটামুটি আসমতের জন্য পূর্ণনির্ধারিত। আমার গর্দভ বেস্ট ফ্রেন্ড রোমেল সিদ্ধান্ত নিয়েছে রুমাকে ইমপ্রেস করতে সে এবার কলেজ স্পোর্টসের দৌড়ে অংশ নেবে এবং আসমতকে হারিয়ে রুমার মন জয় করে নেবে।
শুনে রাগে গা-টা জ্বালা করে উঠলো আমার, 'আসমতকে? আসমতকে হারাবি তুই? মুখের কথা না? শালার মাইক্রোস্কোপিক হাফপ্যান্ট পরলেই দৌড়বিদ হওয়া যায় না বুঝলি?'
আমার কথা কানেই নিলো না রোমেল।
নির্লিপ্ত মুখে হাতে একটা ফ্লাস্ক ধরিয়ে দিলো।
'এটা কি?' মেজাজ গরম করে বললাম আমি।
'ফ্লাস্ক দোস্ত। থার্মোফ্লাস্ক। '
'কি নিয়েছিস ফ্লাস্কে? চা নাকি?'
রহস্যময় হাসি হাসে রোমেল।
বলে, 'চা না দোস্ত। এটা হলো গিয়ে যাকে বলে জিংসেং টি। '
'তুই কি ৮০ বছরের বৃদ্ধা নাকি ব্যাটা? ফেল ওইটা ফেল। ওই সব ফেংমেং বাদ দিয়ে কোকাকোলা নেই। ' বলে ফ্লাস্কটা খোলার চেষ্টা করলাম আমি।
ঝট করে ফ্লাস্কটা কেড়ে নিলো রোমেল। ভাব-ভঙ্গি মরিয়া। ভাংবো তবু ফ্লাস্ক দেবো না। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
পার্কে ঢুকতেই বোঝা গেল কতো বড় ভুল করে ফেলেছি।
ঢুকতে না ঢুকতেই আমাদের চারপাশে প্রায় মেলা জমে গেলো। পানিওয়ালা, পানওয়ালা, বিড়িওয়ালা, বাদামওয়ালা, শসাওয়ালা সবাই সবগুলো দাঁত বের করে রেখেছে। ওদের আনন্দ-উৎসাহের মূল উৎস রোমেলের হাফপ্যান্ট। আগে বুঝিনি, পার্কে খেয়াল করলাম শালার প্যান্টটা চকচকে কি কাপড় দিয়ে যেন তৈরি। আলো রিফ্লেক্ট করছে।
অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ালো যখন পিচ্চি বাদামওয়ালা তার ঝাঁকার গোপন জায়গা থেকে একটা ছবি বের করে প্রমান করে দিলো 'আমার কইলজা' ছায়াছবিতে চাকভুম নৃত্যরত বিখ্যাত চিত্রনায়িকা মিস কপির পরিধান করা হাফপ্যান্ট আর রোমেলের হাফপ্যান্ট হুবহু এক!
সবার হাস্যরসের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও দেখলাম রোমেলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আমার হাতে স্টপওয়াচ ধরিয়ে দিয়ে পার্ক রাউন্ড দেয়া শুরু করলো। উপস্থিত জনতা রোমেলের দৌড়ও ভীষণ ভাবে গ্রহণ করলেন। নিতম্ব দুলিয়ে রোমেলের দৌড়ানোর স্টাইলটা অনেকটা পাকি ইঞ্জামামের মতো।
দৌড় শেষে পার্কের বেঞ্চে বসা হলো।
রোমেল দেখি দু'টো কাপে জিংসেং ঢালছে।
'দু'টো কাপে ঢালছিস কেনো?'
'তুইও একটু খা না দোস্ত!' অনুরোধের সুরে মরিয়া হয়ে বলে রোমেল। বুঝতে পারি জিনিসটা একা খেতে ঠিক ভরসা পাচ্ছে না ব্যাটা।
চা মুখে দিতেই মুখ কুঁচকে গেল আমার, 'ওই! কি দিলি এটা?' ঝাঁঝালো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কোনো জবাব দিলো না রোমেল।
লাল চোখে আমার দিকে তাকালো শুধু একবার।
এভাবে প্রায় এক মাস অনুশীলন চললো আমাদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো দু'টো। এক, নিয়মিত জিংসেং টি খাবার ফলে রোমেলের পেট নেমে গেল। এবং দুই, একদিন পার্কে, প্রকাশ্য দিবালোকে, জগিংরত অবস্থায় রোমেলের হাফপ্যান্ট ফেটে গেল!
চলে এলো আমাদের বার্ষিক ক্রীড়া দিবস।
খুব ঘটা করে নতুন ট্র্যাকস্যুট পরে মাঠে নামলো রোমেল। সাথে কোচ হিসেবে আমি। আমাদের ধারণা ছিলো অন্তত্য আমাদের বন্ধুরা আমাদের ঘিরে থাকবে। উৎসাহ দেবে। কিন্তু যা বুঝলাম আমাদের চেয়ে ওদের আসমতের দিকেই আগ্রহটা বেশি।
আসমতকে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে থেকে রুমাকেও দেখা গেল আমাদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসতে। যদিও রোমেলের ধারণা সেটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ছিলো। শেষ-মেষ আমাদের দলে জুটে গেল বখা জগলু। ব্যাটা মনে হয় সস্তা বিড়ি ফুঁকে এসেছে। কাছে আসতেই ধক করে গন্ধ নাকে আসলো।
'কি-রে জগা? বিড়ি ফুকে এলি নাকি?' তরল গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কথাটা বোধহয় লাগলো জগলুর। মুখ কালো করে ফেলল। বললো, 'বিড়ি খাই না আমি। এটা গাঁজার গন্ধ।
পিওর গ্রীন গ্রাস। '
'গাঁজা ধরেছিস নাকি আজকাল? ঘটনা কি?'
'ঘটনা কিছুই না। গাঁজা খাইলে শরীরে আলাদা বল আসে। মনটা ফুরফুরা হয়। এইজন্য ম্যারাডোনাও খেলার আগে গাঁজা টানতো।
'
কথাটা খট করে মাথায় বাঁধলো যেন রোমেলের, 'সত্যি? সত্যি ম্যারাডোনা খেলার আগে গাঁজা টানতো?'
'ইয়ে... মানে... ঠিক গাঁজা হয়তো না... একই জিনিস... মানে...' আমতা আমতা করে বললো জগলু।
'ব্যাস!' ট্রাফিক পুলিশের মতো এক হাত তুলে জগলুকে থামিয়ে দিলো রোমেল, 'পকেটে আছে দু'এক স্টিক?'
'তা আছে!' বিভ্রান্ত স্বরে বললো জগা।
বিভ্রান্ত হয়েছি আমিও। রোমেল ব্যাটার ঘটনা কি।
'সাব্বির ইয়ার মেরা।
আড়ালে আয়...' ডাকলো রোমেল।
আমরা একটু সাইডে সরে এলাম। শুরু করলো রোমেল, 'তুই তো জানিস অলিম্পিকে খেলোয়াড়দের ডোপ টেস্ট করা হয়। কেননা ডোপ নিলে শক্তি-স্ট্যামিনা বেড়ে যায় হঠাৎ করে। ফলে জেতাটা হয়ে যায় সহজ।
কিন্তু এখানে তো ডোপ টেস্টের বালাই নেই। তাহলে ডোপ নিতে বাধা কোথায়?'
'ডোপ নিবি! পাবি কোথায়?' বিভ্রান্ত আমি জিজ্ঞেস করলাম।
'আছে দোস্ত, এখানেই আছে...' চোখ মটকে বললো রোমেল, 'জগলুর পকেটে। '
'কি!' আকাশ থেকে পড়লাম আমি, 'এক্ষুনি খেলা শুরু হবে আর তুই গাঁজা টানবি?'
জবাব দিলো না রোমেল। ফুরফুরা গলায় জগাকে বললো, 'চলরে দোস্ত চিপায় চল।
ডোপ নিয়ে আসি। '
উপসংহার
ওই দিনের রেসে রোমেলের পারফরম্যান্সটা মনে রাখার মতো ছিলো। আজ পর্যন্ত মনে হয় কোনো দৌড়বিদ এভাবে দু'কদম এগুনোর পর সংজ্ঞা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় নি।
তবে রোমেলের প্রচেষ্টা যে পুরোটা বিফলে গেল তা বলা যাবে না। কেননা এ ঘটনার পর রোমেল কলেজে, যাকে বলে, সেলিব্রিটি হয়ে গেল।
সবার মুখে মুখে (বিশেষ করে মেয়ে মহলে) রোমেলকে নিয়ে ছড়া-কবিতা-গান। সেসব সাহিত্যকর্মের দু'একটা এখানে তুলে দেবার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বিভাগীয় সম্পাদক পড়ে এক কথায় বললেন, 'অশ্রাব্য!'
© অমিত আহমেদ
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক ভোরের কাগজ, অক্টোবর ২০০০। তৎকালীন অলিম্পিকের ডামাডোলে গল্পটি লিখেছিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।