অ্যালান হিলস । পূর্ব অ্যান্টার্ক্টিকার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ট্রান্সঅ্যান্টার্ক্টিক পর্বতমালা । এই পর্বতমালা কেপ অ্যাডার থেকে শুরু হয়ে কোটসল্যন্ড পর্যন্ত গিয়েছে । এই পর্বতমালার শেষ প্রান্তের একটি অত্যন্ত নির্জন ও ভীতিকর পর্বতাংশ হচ্ছে ‘অ্যালান হিলস’। এর চতুর্দিকের ঘোড়ার ক্ষুরের মতন দেখতে বেষ্টনি লোমকুপের মধ্যে একরকম ঠান্ডা ভয়ের শ্রোত ঢেলে দেয়।
চারিদিকে ধবধবে দুধসাদা বরফের আচ্ছাদন আর দুর্দমনিয় বরফ প্রবাহ খোলা জায়গাটাকে আরো বেশি রহস্যময় করে তুলেছে । এখানে পৃথিবীর সর্বাধিক বরফ প্রবাহ দেখা যায় বছরের বেশিরভাগ সময় । এই পুরো অঞ্চলকে ভিক্টোরিয়াল্যান্ড নাম দেয়া হয়েছে ইংল্যান্ডের রানীর নামে।
কিন্তু মানুষ এক অদ্ভুত সৃষ্টি । সাহস, আগ্রহ আর অজানাকে জানার নেশায় পৃথিবীর মানুষ এখানে বার বার হানা দিয়েছে এই ভয়ঙ্কর দুর্গম পর্বতাংশে সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে।
কার্স্টেন বরগ্রেভীক । নরওয়েজিয়ান বংশদ্ভুত একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী যার রক্তে মিশে আছে অভিযানের নেশা। নরওয়ের বাসিন্দা হলেও তিনি পরবর্তিতে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন গ্রহন করেন এবং সিডনি বিশ্যবিদ্বালয়ের ভুগোল ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন।
১৮৯৫ সাল। অ্যান্টার্ক্টিক অভিযান কমিটি (Antarctic Exploration Committee - AEC) বানিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যে একটি যুক্ত অভিযান এর আয়োজন করে যার পরিচালক হেনরিক বুল (Henrik Johan Bull) ।
এই অভিযানের সাথে একজন বিজ্ঞানী থাকার কথা থাকলেও তার পরিবর্তে এই দলের সাথে ভিড়ে যান কার্স্টেন বরগ্রেভীক এবং অ্যান্টার্ক্টিকার বিভিন্ন দ্বীপে ঘুরে বেড়ান।
নরওয়ের এই দুজন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী – হেনরিক বুল ও কার্স্টেন বরগ্রেভীক (Carsten Egeberg Borchgrevink) প্রথম কেপ অ্যাডার এ নামেন আর ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন অ্যান্টার্কটিকার মুল ভূখন্ডে পৃথিবীর মানুষের প্রথম পদচারনার কৃতিত্তটা।
এর চার বছর পর বরগ্রেভীক আবারও আসে এই দুর্গম ও ভয়ংকর অঞ্চলে এবং কেপ অ্যাডার এ একটি কুড়ে ঘর নির্মান করে । এটি অ্যান্টার্ক্টিকায় পৃথিবীর মানুষের প্রথম ঘর এবং বর্তমানে এটি পেঙ্গুইনদের দখলে । এই সময় কেপ অ্যাডারে বরগ্রেভীক কিছু অদ্ভুত নমুনা সংগ্রহ করে যার উৎস এই পৃথিবী নয়।
অ্যালান হিলস এর পশ্চিম প্রান্তে বরগ্রেভীক খুজে পায় অসংখ্য উল্কাপিন্ডের খন্ডাংশ যাদের উৎস অন্য কোনো গ্রহ কিংবা উপগ্রহ কিংবা ছায়াপথে, অথবা অন্যকোনো অজানা মহাবিশ্ব । এরপর প্রায় নব্বুই বছর অ্যালান হিলস সম্পর্কে কারো তেমন কোনও মাথাব্যাথা ছিল না।
ALH 84001, ডিসেম্বর ১৯৮৪ । ANSMET – Antarctic Search for Meteorites, আমেরিকার উল্কাপিন্ড অনুসন্ধানীদের একটি প্রকল্প। এরা পৃথিবীর মানুষকে আপাদমস্তক প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দেবার মতন খবর দিল ।
অ্যালান হিলস এর বরফাচ্ছাদিত ভুমিতে তারা খুজে পেল ‘ALH 84001’। এটি এমন একটি উল্কাপিন্ড যার বৈশিষ্ট খুজে পাওয়া যায় SNC (Shergottite, Nakhlite, Chassignite) গ্রুপের উল্কাপিন্ডের সাথে । ধাক্কাটা তখনই লাগে যখন জানা যায় SNC গ্রুপের উল্কাপিন্ডের উৎপত্তি মঙ্গলগ্রহ ।
২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩৪টি উল্কাপিন্ড পৃথিবীতে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একটা ধারনা পেয়েছে। এর মধ্যে ALH 84001 অন্যতম, কারন এর উৎপত্তি মঙ্গলগ্রহের এমন এক অংশ থেকে হয়েছে যেখানে প্রানের অস্তিত্ত পাওয়া গেছে।
এখন প্রস্ন হচ্ছে ‘এই উল্কাপিন্ড যে মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে তার প্রমান কি?’।
NAA (Neutron Activation Analysis) একটি নিউক্লিয়ার পদ্বতি এবং এই বিশেষ পদ্বতির সাহায্যে একটি বড় পদার্থের মধ্যের উপাদানসমুহের ঘনত্ব মাপা হয়। মঙ্গলগ্রহ থেকে নভোচারীরা যেসব নমুনা সংগ্রহ করেছে তার সাথে অ্যালান হিলস এর ALH 84001 উল্কাপিন্ডের আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় NAA পদ্বতির সাহায্যে।
ALH 84001 খুজে পাবার পর থেকে NASA-র গবেষনার কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে চলে। প্রায় ২ কেজি ওজনের এই উল্কাপিন্ড অন্য যে কোনোটা থেকে একটু বিশেষ হবার জন্যই পৃথিবীতে এত হইচই।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষায় দেখা গেছে এই উল্কাপিন্ডে রয়েছে প্রানের ছাপ । এটি পৃথিবী বাইরে প্রানের অস্তিত্তের প্রথম নিরেট প্রমান।
১৯৯৬ । নাসার একজন উর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ‘ডঃ ডেভিড ম্যাক-কে’ মঙ্গলগ্রহে প্রানের অস্তিত্ত নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপেন সায়েন্স নামের একটি বিখ্যাত জার্নালে। বেশ বড় আকারের একটি ঝাকি খায় পৃথিবীর মানুষ।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সাদাকালো ধোয়া যেন ছেয়ে যায় সমগ্র পৃথিবীকে। সমস্ত দন্দ আর প্রশ্নের মাঝে সত্য জায়গা করে নিতে চায়। উত্তেজনার হাওয়া বয়ে যায় চারিদিকে। শুরু হয় সত্যমিথ্যা মিলিয়ে নানান ধরনের গল্প, জল্পনা, কল্পনা। প্রতিবেদনটির সত্যতার এর প্রস্নে একপর্যায়ে নাসার উপর চাপ সৃষ্টি হয় ।
৬ই অগাষ্ট ১৯৯৬ । প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অবশেষে সরাসরি টিভির পর্দায় সমগ্র বিশ্ববাসিকে চমকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেন মঙ্গলগ্রহে প্রানের অস্তিত্ত খুজে পাওয়ার কথা।
এই ঘটনার পর আরও অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হয় যার কোনওটা এই সত্যকে স্বীকার করে নেয় আবার কোনওটা এই সত্যকে আরও বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষনের জন্য ছেড়ে দেয়। সবমিলিয়ে মানুষের মনে সত্য-মিথ্যার সহাবস্থান শুরু হয়।
ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭।
সত্যের ভিতকে আরও একটু শক্ত করতে গ্যালিলিও স্পেস্ক্রাফট থেকে বলা হল যে তারা বৃহস্পতির বরফাচ্ছাদিত পৃষ্টের নিচে একটি লাল রঙের সাগর পেয়েছে।
যুগে যুগে মানুষ ভেবে এসেছে এই পৃথিবীতে কি আমরা একা? এই মহাবিশ্বে কি আর কোনও প্রান আছে? তারা কি আমাদের চেয়েও বুদ্দ্বিমান? তারা কি অশরিরী নাকি ভিন্ন কোনও মাত্রায় তাদের অবস্থান? পঞ্চম কিংবা দশম মাত্রা? কিংবা মাত্রাবিহীন কোনো অস্তিত্ত? এমন কোনও অস্তিত্ত যা খালি চোখ কিংবা পৃথিবীর আবিস্কৃত কোনও যন্ত্রে ধরা পড়ে না?
এসমস্ত প্রস্নের প্রমানিত উত্তর পৃথিবীর মানুষ হয়ত একসময় খুজে পাবে। হয়ত এই শতাব্দিতে কিংবা অনেক পরবর্তি কোনও শতাব্দিতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।