এডগার অ্যালান পো (Edgar Allan Poe, জানুয়ারি ১৯, ১৮০৯ - অক্টোবর ৭, ১৮৪৯) একজন মার্কিন কবি, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সমালোচক এবং যুক্তরাষ্ট্রের রোমান্স আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের সারা জীবন কাটে নানা রকম যন্ত্রণা, আর্থিক দৈন্যদশা ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। বিশ বছর বয়স হবার আগেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং তখনই তাঁর কিছু কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ সালে পো রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কয়েকটি গভীর আবেদনময় কবিতা ও ব্যতিক্রমধর্মী ছোটগল্প রচনা করে শুধু মার্কিন সাহিত্যভুবনে নয়, বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজের জন্য একটি গৌরবমন্ডিত স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘হেলেনের প্রতি’, ‘স্বপ্ন’, ‘ইস্রাফিল’, ‘দাঁড়কাক’, ‘অ্যানাবেল লী’ প্রভৃতি। ‘দ্য রেভেন’ বা ‘দাঁড়কাক’ কবিতাটি রোম্যান্টিকতা, মোহন সুরেলা ছন্দোময়তা ও তার রহস্যময় পরিমণ্ডলের জন্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
পো তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে উল্লেখযোগ্য নৈপুণ্যের সঙ্গে রহস্যময়, ভুতুড়ে, মৃত্যুর গন্ধমাখা, খুনখারাবি ভরা, আতঙ্কতাড়িত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। গোয়েন্দা-গল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান স্মরণীয়।
দাঁড়কাক
মূল: এডগার অ্যালান পো
অনুবাদ: শাবা আবদুল্লাহ
একদা এক বিবর্ণ মধ্যরাতে, ভাবছি বসে তণুমন কান্ত তাতে
পড়ছিলাম কোন এক পুরোনো দিনের লোক-গাঁথা --
চোখে ঢুলুনী, ঘুম তাড়াতে নাড়ছিলাম মাথা,
হঠাৎ কোথায় যেন ঠক ঠক শব্দ শুনি, কেউ একজন নাড়ছে কড়া দরজায় বুঝি।
"সে এক অতিথি হবে," বলছি মনে, "কড়া নাড়ছে যে দরজায় আমার,
ব্যাপারটা এই, নয় কিছু আর। "
ওহ! কী শীতল ছিল সেই ডিসেম্বর, সব কিছু ঠিক মনে আছে আমার
অগ্নিপাত্রে হচ্ছিল শেষ জ্বলন্ত অঙ্গার, যেন ফ্লোরে নাচছে কোন ভূতুরে কঙ্কাল
খুব আগ্রহে আমি পড়ছি বই, হয়তো শেষ হবে আগামী কাল,
যার বেদনা ভুলতে কেবলি পড়ছি, সে তো লেনোর
প্রিয়তমা, বধু আমার -- বিরল সুন্দরী স্বর্গীয় লেনোর
নামহীন এখানে এখন, হায়! ফিরবে না কখনো আর।
হীম বাতাস বইছিল, রেশমি পরদাগুলো খসখস করছিল
আমি শিহরিত, অদ্ভুত এক আতঙ্কে গা ছমছম করছিল,
ভয়ে অন্তরাত্মায় পেটুনি দিচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করছি
“এ এক আগন্তুক মাত্র, অনুমতি চাচ্ছে কামরায় ঢোকার
একজন নিশুতি পরিদর্শক মাত্র, যে অনুমতি চাচ্ছে ঢোকার,
এ ছাড়া নয় কিছু আর। ”
তৎক্ষণাৎ সাহসী হয়ে ওঠলাম, মূহুর্তে ভয়-দ্বিধা চলে গেল আমার,
“ স্যার”, বললাম, “অথবা ম্যাডাম, দয়া করে আমায় ক্ষমা করবেন,
সত্যি বলতে কি, আমি ঘুমাচ্ছিলাম আর আপনি কড়া নাড়ছিলেন
নিতান্ত ভদ্রভাবে আর ধীরে ধীরে আমার দরজায় কড়া নাড়ছিলেন
যা খুব আস্তেই শুনছিলাম। ” তারপর খুললাম পুরো দরজা আমার;--
হায়! সেখানে শুধু অন্ধকার, কিছুই নয় আর।
দেখলাম আঁধার কেবলি আঁধার, কাউকে খুঁজছি ভয়ে দাঁড়িয়ে আবার
সন্দেহ মনে বড় আশা নিয়ে খুঁজছি, আর তাকে পাব বলে স্বপ্ন বুনছি;
কিন্তু সেথায় শুধু নীরবতা আর বিরাজ করছিল স্তব্ধতা
শুধু একটি শব্দই সেখানে ফিস ফিস করলো, “লেনোর?”
অন্ধকারে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলো, “লেনোর!”--
নিছক এই, নয় কিছু আর।
হৃদয়ে আমার করছিল জ্বালাতন, হা-হুতাশ মনে ফিরলাম কামরায়,
সহসা ঠক ঠক শব্দ মোর জানালায়, তার চেয়ে জোরে শুনলাম পুনরায়
“নিশ্চয়”, বললাম আমি, “জানালার জাফরিতে কিছু আছে জানি,
দেখি আমি কি আছে সেথায়, খুলে যাবে সব রহস্য জাল--
আমার অন্তরকে ভাবতে দাও, মূহুর্তেই খুলবে রহস্য জাল;--
‘আরে, এ বাতাস ছাড়া নয় কিছু আর। ”
বাতায়নের কপাট খুলে দিলাম, অসংখ্য ঝাপটানির আওয়াজ পাচ্ছিলাম,
দেখলাম, প্রাচীনকালের পবিত্র দিনগুলোর এক মহান দাঁড়কাক আসছে :
সে কোন সম্মান দেখালো না, এক মূহুর্তের তরেও থামলো না;
সে এক অভিজাত ব্যক্তির মত উড়ে করে দরজায় এসে বসলো--
সে দরজার উপরে ঝুলানো বিদ্যাদেবী প্যাল্যাসের মূর্তিতে বসলো--
স্থির হলো, বসলো এবং নয় কিছু আর।
কালো-আবলুস পাখিটা বাঁকা চোখে, তারপর তাকাল আমার দু:খিত মুখে
ফুটে উঠলো মুখায়বে তার, কঠিন গহীন কবর-অন্ধকার।
‘‘যদিও তোমার ঝুঁটি কামানো”, বললাম, “তা শিল্প হলেও তুমি ভীরু নও,
তুমি হিংস্র-ভয়ংকর নও, তুমি রাতে বিচরণরত প্রাচীন দাঁড়কাক
বল আমায়, কোন শুভ নাম নিয়ে তুমি পাতাল রাজ প্লুটোর কাছে যাও?”
দাঁড়কাক বলল, কখনো নয় আর।
কদাকার পাখির এমন সরল কথা, শুনে আমি অবাক হলাম খুবই
ওর উত্তরের অর্থ ছিল অল্পই, প্রাসঙ্গিকতাও ছিল স্বল্পই,
বলছিল যেন, আমরা তো কোন জীবিত মানুষকে সাহায্য করতে পারি না।
আমি পাখিকে দেখে খুশি হতে পারে নি যে বসেছিল আমার দরজার উপর--
পাখি বা পশু যাই হোক, বসেছিল আমার দরজায় খোদাই করা মূর্তির উপর,
যে শুধু বলেছিল, কখনো নয় আর।
কিন্তু দাঁড়কাক, যে শান্ত মূর্তির উপর বসেছিল একাকী, বলেছিল শুধু
ওই একটি কথাই, যেন তার আত্মা গড়া ওই একটি কথা দিয়েই।
এছাড়া কিছুই বলবে না আর, উড়বে যখন একটি পলকও পরবে না তার--
তখনো আমি বিড় বিড় করছিলাম, “অন্য বন্ধুরা আগেই উড়ে গিয়েছে তার--
প্রভাতে হয়তো আমায় সে ছেড়ে যাবে, অথবা আগেই উড়ে যাবে আবার। ”
পাখিটি বলল তখন, কখনো নয় আর।
আমি চমকিয়ে গেলাম তথা, যথাযথ উত্তরে ভাঙলো নীরবতা
বললাম, “এ কেমন অবস্থারে! মাত্র একটি কথাই আছে তার ভাণ্ডারে!!
নিশ্চয় নির্মম দুর্যোগে পতিত কোন অসুখী মনিবের কাছে শিখেছে সে
খুব দ্রুতই সে ধরতে পেরেছে একটি গান, আশা-নিরাশার একটি গান
সে তার সব দু:খ-বেদনা লুকিয়ে বলছে শুধু একটি গান
যা ‘কখনো নয়-- কখনো নয় আর। ”
কিন্তু দাঁড়কাক এখনো বাঁকা চোখে, তাকাচ্ছে আমার দু:খিত মুখে,
চেয়ার টেনে বসলাম, সম্মুখে আমার-- পাখি, মূর্তি আর খোলা দুয়ার,
মখমল কুশনের উপর বসে তারপর, আমি মিলাচ্ছি জীবনকে আমার
কত অভিনব এ জীবন, ভাবছি : এ অশুভ পাখির মতই কি জীবন আমার--
এই ভয়ানক, বীভৎস, কুশ্রী, কৃশ, অশুভ পাখির মতই কি জীবন আমার ?
এটাই কি কর্কশ “কখনো নয় আর” শব্দের অভিপ্রায়।
আমি বসে বসে অনুমান করছি, কিন্তু এ পাখির ব্যাপারে
খুঁজে পাচ্ছি না কোন ভাষা, যার আগুন-দৃষ্টি আমার অন্ত:স্থল পুড়িয়ে মারছে;
এমন অনেক কিছুই কল্পনা করছি আর হালকাভাবে মাথা নাড়ছি
মখমল কুশনের উপর বসে আছি, চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে প্রদীপ আলো,
কী সুন্দর মখমলের বেগুনি আবরণ আর চারদিক ঝলমল করা প্রদীপ আলো,
যা লেনোরকে ভীষণ নাড়া দিবে, আহ্, তা কখনো হবে না আর!
এরপর ঘন বাতাস বইছিল, আমার মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য ধূপাধার থেকে সুগন্ধি আসছে
যেন স্বর্গীয় দূত ধূপাধারের চারদিকে ঘুরছে, ঐতো যার পদ-ধ্বনি শুনা যাচ্ছে
নিজেকে বললাম, “হে নরাধম, ফেরেশতা তোমার জন্য নিয়ে এসেছে ঈশ্বরের সুগন্ধি
আর যতনা-নাশক সিরাপ, এখন তবে লেনোর-স্মৃতি থেকে অবকাশ নাও
বড় বড় চুমুকে এ সিরাপ পান কর, আর লেনোরের বেদনা ভুলে যাও!”
দাঁড়কাক বলল, কখনো নয় আর।
“অশুভ বার্তাবাহক!” বললাম, “পাখি বা শয়তান যাই হও, তুমি অশুভ বার্তাবাহক!
তোমাকে কোন শয়তান প্রেরণ করেছে নাকি তুমি ডাঙায় ক্ষতি করার জন্য কোন প্রকাণ্ড ঝড়
নাকি কোন জনশূন্য মরুভূমির মত নির্ভীক নাকি মায়াময় কোন জমিন
আমি অনুরোধ করছি, সত্যি করে বলো তুমি কি কোন ভূতো বাড়িতে আছো
সেখানে কি আছে গিলিয়দ পাহাড়ের সুগন্ধি, আমাকে বলো, আমাকে বলো!”
দাঁড়কাকের একই কথা, কখনো নয় আর।
“অশুভ বার্তাবাহক!” বললাম, “পাখি বা শয়তান যাই হও, তুমি অশুভ বার্তাবাহক!
যে স্বর্গে আমরা যেতে চাই, যে ঈশ্বরের আমরা উভয় উপসনা করি, তার দোহাই--
বল আমায়, এই দু:খ ভারাক্রান্ত আত্মা যদি সেই দূরবর্তী স্বর্গে
আলিঙ্গন করতে পারতো সতি-স্বাধ্বি কুমারীর সাথে, যার নিষ্কলুস নাম লেনোর--
আহ, যদি আলিঙ্গন করতে পারতো সেই বিরল সুন্দরীর সাথে, যার নাম লেনোর।
”
দাঁড়কাকের একই কথা, কখনো নয় আর।
“হে পাখি বা দানব! এটাই আমাদের বিদায়কালীন বার্তা”, আমি চিৎকার করছিলাম--
“চলে যাও তুমি ঝড়ের বেগে পাতাল দেশে!
তোমার আত্মার মিথ্যা কথকতার জন্য আমায় ছেড়ে যাও, হে কালো পাখি!
একাকী থাকতে দাও আমায়, দরজায় রক্ষিত মূর্তি ত্যাগ কর তুমি
আমার অন্তর থেকে বিদায় নাও, আমার দুয়ার ছেড়ে দাও!”
দাঁড় কাক বলল, কখনো নয় আর।
এবং দাঁড়কাক, আর কখনো উড়লো না, বসে ছিল, বসেই ছিল
আমার দরজায় রক্ষিত দেবী প্যালাসের শান্ত মূর্তির উপর বসে ছিল;
মনে হচ্ছিল তার চক্ষুদ্বয়ে আছে কোন এক দানবের স্বপ্নরেখা,
প্রদীপ আলো তার ছায়াকে মেঝের মধ্যে প্রলম্বিত করছিল;
মেঝে প্রলম্বিত এ ছায়া ও মিথ্যা প্রহেলিকা থেকে আমার আত্মা বেরিয়ে আসবেই,
ত্যাগ করবে সব -- কখনো নয় আর!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।