মনির সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছে পাবলিক লাইব্রেরীতে একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে। চমৎকার আবৃত্তি করে সে। একই অনুষ্ঠানে আমিও আবৃত্তি করেছিলাম। জামদানী শাড়ীতে চুলে পরেছিলো বেলীফুলের মালা। পরীর মতো লাগছিলো ওকে।
তবে লাল পরী, নীল পরী, সাদা পরীর কথা শুনেছি কিন্তু শ্যামলা পরীর কথা শুনিনি। যদি শ্যামলা পরী নামে কিছু থাকতো, তবে মনিকে শ্যামলা পরী অথবা শ্যামা পরী ডাকা যেতো। কারণ ওর গায়ের রঙ শ্যামলা। মনি যখন আবৃত্তি করছে, অডিয়েন্সে তখন পিন পতন নীরবতা। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সবাই।
পরপর দুটো কবিতা আবৃত্তি করলো সে। সুবোধ সরকারের 'শাড়ি' এবং জয় গোস্বামীর 'বেনী মাধব'। দুটো কবিতায়ই গভীরে ঢুকতে পেরেছিলো সে। ঊনিষ বছরের একটি মেয়ের বিধবা হয়ে ওঠার গল্প ছিলো 'শাড়ি' কবিতাটিতে। 'শাড়ি' কবিতাটি শুনে আমার মতো অনেকেরই চোখই ঝাপসা হয়ে এসেছিলো।
বিরতির সময় বাইরে সবাই ঘোরাঘুরি করছিলো আর যার যার পরিচিত জনদের সাথে গল্প করছিলো। মনিই প্রথম এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে বললো, 'আমার নাম মনি ইসলাম। তুমি রাজা রহমান, রাইট? তোমার কবিতা শুনলাম। খুউবই ভালো লেগেছে আমার।
বিশেষ করে নির্মলেন্দু গুণের 'ক্ষেত মজুরের কাব্য' ভালো করেছো।
প্রথম পরিচয়ে কেউ কাউকে তুমি বলে সম্মোধন করে এই প্রথম শুনলাম। তাও মেয়েদের পক্ষ থেকে! তবুও আমি এমন ভাবে হাত বাড়ালাম, যাতে ও মনে করে যে, আমি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। আমরা ঘাসের পাশে মুখোমুখি বসলাম।
-হ্যা, আমি রাজা রহমান।
তোমার কবিতাও আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। তুমি আমার মনটাকে ছুঁতে পেরেছো। দুটো কবিতাই তুমি ভালো করেছো। কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কি করে?
-এটাকি খুউব কঠিন কাজ?
- নাহ। তবুও এইমাত্র তোমার সাথে পরিচয় হলো তো!
- আরে বুদ্দু, ঘোষক সবারই নাম ঘোষণা করেছেন।
যারা যারা আবৃত্তি করেছে তাদের সবার নামই আমরা শুনতে পেয়েছি। তুমি হয়তো আমারটা খেয়াল করোনি। এনিওয়ে, তুমি কোনো গ্রুপে প্র্যাকটিজ করো? নাকি নিজে নিজেই।
- হ্যা, 'রূপান্তর' নামে আমার একটা আবৃত্তি গ্রুপ আছে। আমি ওখানে প্র্যাকটিজ করি এবং করাই।
-আমিও 'রূপান্তর' এর নাম শুনেছি। ওখানে সম্ভবত বনানী, বর্ষা, মেহেদী এবং আমানতও প্র্যাকটিজ করে, রাইট?
- তুমি ঠিকই বলেছো। ওরা খুউব ভালো আবৃত্তি করে। আমি তেমন ভালো আবৃত্তি করিনা, এই ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে কি আর আবৃত্তি হয়? বলতে পারো পাঠ করে যাই আর ওদের দেখিয়ে দেই। কিন্তু তোমার একটা ব্যাপার আমার কাছে ভালো লাগেনি মনি।
তুমি আমাকে বুদ্দু বলে গাল দিয়েছো, এটা আমার খুউব খারাপ লেগেছে।
- স্যরি রাজা। আমি আসলে একটু বেশী মুখপোড়া। যা বলতে ইচ্ছে করে তা বলে ফেলি। বুঝতে পারছি তা মোটেই ঠিক হয়নি।
আই বেগ অ্যাপোলজি ফর দিস, রাজা। প্লিজ!
- ইটস ওকে, মনি। তোমাকে দেখতে দারুন লাগছে। একদম পরীর মতো। লাইক এ্যা প্যারাগন অব বিউটি।
শ্যামা পরী।
- শ্যামা পরী? এমন পরীর অস্তিত্ব আছে নাকি? পরী কখনো দেখেছো?
- হ্যা দেখেছি। আমার সামনেই বসে আছে একজন।
- হি হি হি। তুমি এমন অদ্ভুত কথা বলোনা রাজা, হাসতে হাসতে... ওহ্ মাই গড।
- কিন্তু হাসলেও তোমাকে অনেক বেশী সুন্দর মনে হয়। অসহ্য সুন্দর। তুমি সুন্দর বলে আমিতো চেয়ে থাকবোই, প্রিয়তমা, তোমার চোখে চোখ পড়লে আমিতো হারাবোই খেই! কী দোষে আমায় দুষবে বলো শ্যামা পরী।
- তুমি কি কবিতা লিখো নাকি?
- নাতো! কবিতা আর এখন লেখা হয়না। আগে লিখতাম।
এখন কবিতা টাইপ করি।
- মানে?
- মানে শুধু আমি নই, এখনতো বেশীরভাগ কবি সাহিত্যিকরা আর লেখেন না, কম্পিউটারে টাইপ করেন।
- তুমি আসলেই বুদ্দু নও। ইনটেলিজেন্ট।
- পরী নেমে এলো মর্তের মাটিতে, ধুলায় পড়লো পা, অমনি সব স্বর্গ হয়ে গেলো, চারপাশে শুধু বাগিচা।
- থামো! থামো! তুমিতো প্রেমে পড়ে গ্যাছো আমার। আমিও তো দেখছি ক্রমেই গলে যেতে শুরু করেছি। কিন্তু বাছা, বড় বেশী দেরী করে ফেলেছো। আমাকে ফেলেছো দ্বিধায়। রাজা আমারতো এখনি ওঠতে হবে।
হল গেইটে আমার একজন গেস্ট অপেক্ষা করছে।
- অনুষ্ঠানতো শেষ হয়নি মনি। অন্যদের কবিতা শুনবেনা?
- উমহু। আজ না। হল আবার বন্ধ হয়ে যাবে।
বাই।
বাই বলে চলে গেল মনি। যাওয়ার আগে ওর মোবাইল নম্বর আমাকে দিয়ে আমার একটা ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নিয়েছে। যশোরের মেয়ে মনি থাকে শামসুন্নাহার হলে। ওর হলের গেইটে নাকি কে একজন অপেক্ষা করছে।
কে সেই জন? আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ওর আবার বিশেষ কেউ নয়তো? কিসব আজেবাজে চিন্তা করছি আমি মনিকে নিয়ে। কেউ থাকলেই বা কি? আমার সাথেতো আজই ওর পরিচয় হলো। ওরতো বিশেষ কেউ থাকতেই পারে। বুকটা কেমন ধুকধুক করে ওঠছে।
কেন যেন আমি মানতে পারছিনা। ওর বিশেষ কেউ থাকতে পারেনা। হোকনা দেরীতে পরিচয়। তবুও মনি আমার শ্যামা পরী। এটুকু ভাবতেই কেমন পুলকিত বোধ করছি।
ও চলে যাওয়ার পর কেমন যেন অসহায়বোধ করছি। অন্য আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি আর শুনতে ইচ্ছে করছেনা। হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের দিকে চলে এসেছি। চারদিকে এত মানুষ. তবুও কেন যেন সব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরটা আর চলছেনা।
ধানমন্ডিতে দু'রুম বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকি আমি। বাসায় এসে দেখি রাবুরমা তখনো চলে যায়নি। রান্নাঘরে কি যেন করছে। আমাকে দেখে লম্বা একটা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিলো। গত দু'সপ্তাহ আমার সাথে রাবুরমার দেখা না হওয়ায় ফর্দটা এতো লম্বা হয়েছে।
পাশের দোকান থেকে টুকটাক এনে রান্না-বান্না চালিয়ে নিয়েছে। রাবুরমা আমাকে অভিযোগের সুরে বললো, 'মামা, আপনেরতো কিছুই মনে থাকেনা। দুই সপ্তাহ আগে বলছিলাম, ত্যাল নাই। ত্যাল ছাড়া কোনো কিছু করন যায়? দ্যান মামা ট্যাকা দ্যান। অখনই কিছু আনতে অইবো।
' আমি রাবুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কতো লাগবে?
- হাজার দুয়েকতো লাগবোই। জিনিসপত্রের যা দাম! সবকিছুতে আগুন লাগছে।
- ঠিক আছে। এই নাও টাকা। যা দরকার কাল সকালে আনিয়ে নিয়ো।
এখন তুমি যাও। খুউব টায়ার্ড লাগছে। আমি রেস্ট নেব।
- আইচ্ছা, কালকেই আনুমনে। আপনে খাইয়া লইয়েন।
টেবিলে সবই রাখা আছে।
রাবুরমা চলে যাওয়ায় একটু স্বস্তিবোধ করছি। ফ্রেস হয়ে মনিকে ফোন করলাম। ফোন ধরছেনা। অনেক্ষণ ধরে ওয়েলকাম টিউনে গান শোনালো।
আমারো শুনতে ভালো লাগছে। ’আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ প্রথম দু’লাইন শুনিয়ে শুনিয়ে ‘নো রেসপন্স’ দেখিয়ে কেটে যাচ্ছে। প্রায় ১৩/১৪ বার চেষ্টার পর ফোন রিসিভ করলো মনি।
- হ্যালো, কে বলছেন?
- তোমার ওয়েলকাম টিউনটা ভালো লেগেছে। কেমন আছো?
- কে বলছেন, প্লিজ?
- শ্যামা পরী বলছো তো?
- ওহ্ রাজা।
আমার বুদ্দু রাজা! তুমি কখন ফিরেছো?
ওর মুখে ’আমার বুদ্দু রাজা’ শুনে বুকটা কেমন ধুকধুক করে ওঠলো। আশ্চর্য ব্যাপার! ওর গাল শুনে খারাপ লাগার পরিবর্তে কেমন যেন একটু ভালো লাগতে শুরু করলো।
- এতোক্ষণ ফোন ধরছিলেনা কেন? আর আমার নাম্বারটাও সেভ করোনি।
- স্যরি রাজা, আমি ফ্রেস রুমে ছিলাম। আর তোমার কার্ডটা শুধু একবার দেখেছি।
কি যেন একটা কোম্পানীর 'ম্যানেজার, এডমিন এন্ড ফাইন্যান্স'। অনেক লম্বা ডেজিগনেশন। বাকীটুকু এখনো দেখার সময় পাইনি। তবে ফ্রেস হয়ে তোমার নাম্বারটা সেভ করে তোমাকে ফোন করতাম।
- আমার কথা মনে ছিলো তাহলে?
- মানে? আমার বুদ্দু রাজাকে এতো সহজে ভুলে যাবো? তোমার মধ্যে যে সরলতা দেখেছি রাজা, তা সচারচর চোখে পড়েনা।
আমাদের বন্ধুত্ব সহজেই নষ্ট হতে দেবনা।
- তা তোমার গেস্ট এর কি খবর? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার তোমার উপর বিরক্ত হয়ে চলে যায়নিতো?
- নারে ভাই, আমার গেস্ট হলো সুপার গ্লু। সহজে কেটে পড়ার কোন সম্ভাবনা দেখছিনা।
- কে সেই জন?
- আরে আমার বয়ফ্রেন্ড ইমরান। আমি ওকে ইমি বলে ডাকি।
ওর বয়ফ্রেন্ড ইমরানের কথা শুনে বুকে একটা ধাক্কা খেলাম কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না। শুধু দশ সেকেন্ড নিরবতা এপাশ থেকে। ওপাশ থেকে গলায় একটু খাকানি শুনলাম।
- হ্যালো, কি হলো রাজা? চুপ হয়ে গেলে কেন? হ্যালো.. লাইনটা কেটে গেলো নাকি? হ্যালো.. মিস্টার বেলা বোস তুমি শুনছো?
- হ্যা শুনছি, বলো। ইমরানের কথা বলো।
- ইমির কথা তোমাকে সব বলবো। এখন শুধু এটুকু জেনে রাখো, ইমি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।
- আর তুমি?
- আমিও মনে হয় কিছুটা ভালোবাসি।
- মনে হয় কেন? ডিটামাইন্ড নও? কতোদিন হলো?
- বুঝতে পারছিনা। বছর তিনেক হলেও ওকে এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।
খালি মাইন্ড করে। কথায় কথায় সন্দেহ করে। এই ধরো আজকে যে আবৃত্তি অনুষ্ঠানে দেরী হলো, তোমার সাথে পরিচয় হলো, গল্প হলো। সব শুনে ইমিতো পটকা মাছ হয়ে গেছে।
- মানে?
- তোমার কথা বললাম।
প্রথমে তেমন রিএ্যাক্ট করেনি। যেই তোমার একটু প্রসংশা করলাম, তখনি মুড অফ করে পটকা মাছ। ভালো লাগে বলো?
- ইমরান তোমাকে আসলেই খুউব ভালোবাসে। সে কারণে অন্য কারো উপস্থিতি ও মানতে পারেনা।
- তা না হয় বুঝলাম, ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
তাই বলে কি তোমার মতো বন্ধু থাকবেনা আমার?
- ওকে ম্যানেজ করলে কি করে? নাকি এখনো গাল ফুলিয়েই আছে?
- আরে নাহ। সব ঠিক হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষ পটানো কোনো ব্যাপার! ইটস এ ম্যাটার অব টু মিনিটস, বুঝলে আমার বুদ্দু? হি হি হি।
- মানে? কতো পুরুষ পটিয়েছো এ পর্যন্ত।
- তা হাজের খানেক হবে।
বুদ্দু। হি হি হি। শোন এখন কাজের কথা। আমি তোমার গ্রুপে কাজ করতে চাই। তোমার কোনো সমস্যা?
- আমার সমস্যা হবে কেন? আমার তো দল ভারী হবে।
কিন্তু তোমার ইমরানের আপত্তি আছে কিনা দেখ।
- সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন রাখতে হবে রাজা।
- ওকে। ভালো থেকো, গুড নাইট।
- গুডনাইট, ডিয়ার।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।