অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
শৈশবে সংখ্যা যোগ করে ছবি তৈরির একটা বিষয় ছিলো, কখনও আঁকতে শেখার বইয়ে, কখনও কোনো পত্রিকায়, এমন কি উন্মাদেও একটা সময় ফোল্ডিং করে ছবির গুঢ় তত্ত্ব উদ্ধারের ব্যবস্থা ছিলো। ১ ২ ৩ ৪ করে সংখ্যাগুলো যোগ করতে করতে একটা ছবির আদল তৈরি হতো। এলোমেলো সংখ্যাগুলোর আড়ালের ছবিটা সব সময় যে প্রকাশ্য ছিলো এমনও না।
তবে এখন মনে হয় আমাদের সমস্ত জীবনটাই এমন সংখ্যা আর চিহ্ন যোগ করে যাওয়া। আমাদের সমস্ত শিক্ষাই আসলে কোনো না কোনো ভাবে বিচ্ছিন্ন চিহ্নগুলোকে সংযুক্ত করে যাওয়া।
কানেক্ট দ্যা ডটস এর গ্যাঁড়াকলে ভীষণ ভাবে আটকে আছি।
আমাদের ভাষা শিক্ষার জায়গাটাতেও এই এসোশিয়েশন এবং এসেসমেন্ট পাশাপাশি চলতে থাকে। আমরা যা কিছু সংজ্ঞায়িত করে ফেলি তারও একটা ছবি আমাদের ভেতরে আঁকা থাকে।
আমাদের ভাষার শব্দগুলো এমনই, প্রতিটা শব্দই কোনো না কোনো ভাবে একটা ছবি তুলে ধরে। ছবিগুলো আমরা নিজেদের মতো সংজ্ঞায়িত করে ফেলি।
আমার কানের কাছে অবিরাম বলা হয় এই একটা মুখ, এটা মা,
আমি এই ছবিটাকে আমার স্মৃতিতে সংরক্ষণ করি, যতবার উল্টে পাল্টে দেখি এই ছবিটার সাথে মা নামক উচ্চারণটা সংযুক্ত হয়ে যায়। আমি আমার স্মৃতির এই ছবিটাকে মা বলে মেনে নি। এমন ভাবে প্রতিটা মুখ আমার কাছে এক একটা উচ্চারণ। প্রতিটা ছবি এক একটা উচ্চারণ।
তেমন ভাবেই , এখনও আশ্চর্য হই এই প্রক্রিয়াটার কথা চিন্তা করলে, অ নেহায়েত একটা চিহ্ন- অ তে অজগর পড়বার সময় কখনও মনে প্রশ্নটা জাগে নি যে অ আসলে অজগর তৈরি করে না, এই শব্দটার সূচনায় আমরা অ ব্যবহার করি।
তেমনভাবেই ঙ তে ব্যঙ হয়। ব্যঙয়ের ছবিটা মাথায় ঘুরতে থাকে।
আমার শিশুশিক্ষা পাঠের সময় আমার বয়েস ছিলো ৩ থেকে সাড়ে ৩, তখন থেকেই এই এক যন্ত্রনা বহন করছি, পড়া এবং চিহ্ন যাচাই করে কোনো সিদ্ধান্তে আসবার ঝামেলা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারলাম না।
আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি আসলে এইসব স্কুল কলেজে যত দেরীতে যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল। অন্তত বাড়তি অনেক এসোশিয়েশনের ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখা যায় নিজেকে।
মাঝে মাঝে কাজে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার ব্যাগের মধ্যে তার কয়েকটা খেলনা ঢুকিয়ে রেখেছে। ভীষণ রকম মায়ার টানে জড়িয়ে যাই, সারা দিন আনমনা হয়ে ভাবি এখন ও কি করতেছে ঘরে। চারপাশে এত সাংঘাতিক জিনিষ ছড়ানো, এই জানালায় উঠে ঝুলবে তো টেবিলের উপরে গিয়ে বসে থাকবে, খাটের কিনার থেকে মাটিতে লাফ দিবে কি না, নানাবিধ শঙ্কা জাগতেই থাকে।
প্রতিদিন বাসায় ফিরবার সময় একটা অজানা আশংকায় টানটান হয়ে থাকি, নিশ্চিত ঘরে পৌঁছে দেখবো কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে কিছু একটা করে বসেছে ও।
অঘটন ঘটলোই শেষ পর্যন্ত- অব্যহত কার্টুন এবং এর এনিমেটেড লাফানোর প্রতিক্রিয়ায় সেও বিছানায় লাফায় প্রতিদিন, একদিন পিছলে বিছানার কোনায় পড়লো, ভ্রু আর চোখের কাছাকাছি একটা জায়গায় কেটেছে।
মাত্র ২ ঘন্টার জন্য বাইরে ছিলাম সেদিন, এড়াতে পারি নি। এড়ালেও ভালো হতো এখন মনে হচ্ছে। ছেলের চোখের কোনে একটা কাটা দাগ এখনও রয়ে গেছে। অবিকল আমার মতোই, আমারও ঠিক সে জায়গাটাতে একটা কাটা দাগ আছে।
পরপর দুই দিন বিমর্ষ ছিলাম, আক্ষেপ করেছি, তার কাটা দাগের ব্যথা নেই, তবে সেই স্মৃতি রয়ে গেছে। আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত এমন স্মৃতি সঞ্চয়। আমরা স্মৃতি ধারণ করতে থাকি, আমাদের ভাড়ারে স্মৃতি জমাই, স্মৃতির চর্চা করি, নবআহরিত স্মৃতিকে স্থান দিতে পুরোনো স্মৃতিকে পেছনের কাতারে রাখি, আমাদের প্রথাগত শিক্ষা আমাদের কিছু নিশ্চিত বিষয়ের ধারণা দেয়, সেসবকে প্রামাণ্য ভাবতে শেখায়। অন্তত আমরা যে অবস্থানে বসবাস করি সেখানে এইসব গুরুত্বহীন, ব্যবহারিক দিক থেকে এইসব শিক্ষার প্রয়োজনের জায়গাটাতে এইসবের নিশ্চিত অবস্থান তেমন বড় মাপের অঘটন জন্ম দেয় না।
সমস্যা হয় এর পরের সময়ে যখন আমি আরও সহজতর কোনো ব্যবহারিক উপকরণ নির্মানের চেষ্টা করবো , তখন আমাকে এই নিশ্চিতির ধারণা থেকে সরে আসতে হবে।
তখন পুরোনো নিশ্চয়তার পাঠ ভুলতে হবে, মূলত শিক্ষা এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে সময়ের সাথে অবিরাম শিখতে হয় আমাদের কি কি ভুলে যেতে হবে অবশেষে।
আমাদের এই অবিরাম কানেক্ট দ্যা ডটস এবং ইরেজ দ্যা ডটস প্রক্রিয়া আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোতেও প্রভাব ফেলে নিয়মিত। আমরা একটা বিন্দু মুছে ফেলে নতুন একটা বিন্দুতে মিলিত হই, সেখান থেকে নবতর কোনো বিন্দুতে পুনরায় মিলিত হই। এই সংযুক্তি থেকে মুক্তি নেই। ইমেজ আর ইমাজিনেশন সম্পূর্ণ আলাদা হলেও আমাদের ইমাজিনেশন ইমেজ দিয়েই গড়ে উঠে।
আমরা কতিপয় ইমেজকে নানাভাবে সাজিয়ে একটা ইমাজিনেশন তৈরি করি, আমি নিজে এই প্রক্রিয়াকে উপভোগ করি, অনেক আগে কিছু ছবি দেখেছিলাম, ভদ্রলোকের নাম সম্ভবত বাস্ক- গভীর ভাবে বাইবেলবিশ্বাসী একজন মানুষ। রেনেসার সমসাময়িক শিল্পী, মাইকেল এঞ্জেলো কিংবা লিওনার্ডো দ্যা ভিঞ্চি প্রচলিত সামাজিক ধর্মবোধকে মুছে ফেলতে পারেন নি, তাদের ছবিতে এইসব ভাষ্য ও অনুভব উঠে এসেছে।
তাদের ইমাজিনেশনের ইমেজারি রিপ্রেজেন্টেশন আমাকে আপ্লুত করে। তেমন ভাবেই মিল্টনের পয়ারাডাইস লস্টের ইমেজারি আমাকে ভাবায়। এই কল্পনার জগত থেকে আমরা কখনই বের হয়ে আসতে পারি না।
পারাটা সম্ভবও না। আমাদের শিক্ষার মূল ভিত্তি কিছু কিছু ছবিকে ক্রমাগত ব্যবহার করে যাওয়া। ছবি ব্যবহারের দক্ষতা আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তফাত তৈরি করে।
যে মানুষটা ছবিগুলো আমাদের পরিচিত আঙ্গিকে সাজাতে ব্যর্থ তাকে আমরা উন্মাদ বলে ফেলি, তাদের এই সজ্জা আমাদের প্রচলিত ধারণাকে আহত করে কোনো না কোনো ভাবে। তবে তাদের এই ছবি আর কল্পনার সাথে বাস্তবতার তফাত কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র আশ্চর্য করে না।
বরং তারা আশ্চর্য হয় এই সহজ কল্পনার সম্মিলন কিংবা সংযুক্তিকরণে আমরা কেনো ব্যর্থ হচ্ছি।
দেয়ালের এপাশ থেকে অপাশে দেখা যায় না কোনো ভাবেই। আমরা কোনো সুরঙ্গ খুড়তে পারি না ।
আমার নিজের কিছু সমস্যা আছে। কেউ যদি আচমকা পিঠে হাত দেয় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে, এটা পরিচিত - অপরিচিতের বিষয়টা, পিঠের এমন একটা স্পর্শ্বকাতর অংশ আছে আমার, কিন্তু কোনো কোনো স্পর্শ্বের অভ্যস্ততা আমাকে তেমনভাবে সহিংস করে তুলে না।
এক দিন দুপুরে কোনোমতে পিচ্চির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিকেলে সামনের দোকানে যাওয়ার সুযোগ পেলাম, শনি বার বন্ধ থাকে, উপলক্ষ্য সিগারেট কিনবো। সিগারেট খুচরা কিনলেও তেমন সমস্যা নেই, তবে একসাথে ৫টা কিনলে অনেকটা সময় অন্তত ঘর থেকে সিঁড়ি ঘরে গিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায়, সেই রাস্তায় নেমে দোকান পর্যন্ত যাওয়ার ঝক্কি সহ্য করতে হয় না।
সিগারেট কিনে আস্তে আস্তে হাঁটছি। সিগারেটের ৫টা টান দিলে সোজা ঘরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়, এমন দুরত্বে দোকান, তাই একই রাস্তায় কয়েকবার ঘুরপাক খাই, সিগারেট মোটামুটি শেষের দিকে গেলে ফেলে দিয়ে বাসায় ঢুকে যাই।
হঠাৎ একজন পিঠে হাত দিলো।
মেজাজটা খারাপ হলো চরম ভাবে।
কষে একটা গালি দিবো ভাবতেই দেখি লম্বা সালাম।
ক্যামোন আছেন ভাই? আপনার পরিচয়?
মাঝবয়েসী একজন, মাথার চুলে পাক ধরেছে। তাকে দেখে জিহ্বার ডগা থেকে গালি মুছে থুতুর সাথে বাইরে ফেলে দেই।
ভালো আছি।
এরপর তার দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ, ঠিক কোন প্রয়োজনে আপনি আমাকে স্মরণ করেছেন জনাব।
আপনার পরিচয়?
আমি এরপরও কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকি।
আমি মোহাম্মদ আহসান রফিক, আমার নামতো বললাম, আপনার নাম বলেন।
আমিও আমার নাম বললাম।
কি করেন? পড়েন?
হুমম।
কি পড়েন?
এইতো পড়ি আর কি
আরে বাবা বলতে তো হবে কি পড়েন? মাস্টার্স করতেছেন?
হুমম।
কোথায়?
ঢাকা ভার্সিটি।
আমি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর। হাত মিলান।
আমি স্থবির দাঁড়িয়ে থাকি, হাত মেলানো হয় না।
একটা সিগারেট দেন।
ও আইচ্ছা এই কেস তাইলে। সিগারেট চায়। আমি চুপচাপ সিগারেট দিয়ে কেটে পড়বার চেষ্টা করি, তবে তার আন্তরিকতার টান ছিড়তে পারি না।
আপনি মানুষটা ভালো।
আমার ভালো লাগে নিজের প্রসংসা শুনতে, তবে এইসব প্রসংশার কোনো পাল্টা জবাব হয় না।
বুঝলেন না, আপনি কি করেন?
মানে কি করেন?
আসিফকে চিনেন?
আমি মাথা নাড়ি।
সৈকত? আমি আবারও নাবোধক মাথা নাড়াই।
আমি সৈকতের মামা।
ও আচ্ছা।
এই উক্তির পর আসলে এরবেশী কিছু বলার থাকে না। আপনি কোন বাসায় থাকেন?
বাসাটা দেখিয়ে দেই।
আমি সামনের বিল্ডিংয়ের ৩ তলায় থাকি। আমি সৈকতের মামা
আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।
আমার সিগারেট দিলেন না?
আমি আস্তে করে বললাম না দিছি তো, আপনার পকেটে আছে।
ধন্যবাদ, আপনি মানুষটা ভালো, আপনাকে স্যালুট করি।
আমি ততক্ষণে নিশ্চিত বেচারার মানসিক গড়ন ঠিক স্বাভাবিক না। সে আমাকে অন্য কেউ ধরে নিয়েছে, যে তাদের বাসার দোতালায় থাকে। আমি সেই ব্যক্তি নই, এবং েই ধন্ধ সে কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
আই এম দ্যা চ্যান্সেলর অফ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
এখন অবশ্য যাই না। বাসায় থাকি। আমি সৈকত আর আসিফের মামা। আপনি টুটুলের কে হন?
সাইদ আপনার কে হয়।
আমি আমার অপরাগতা জানাই, এইসব নামের কাউকেই আমি এখানে চিনি না।
আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। সবাই তো আর আপনার মতো না।
আমি সিগারেট হাতে চুপচাপ গুটিয়ে থাকি। আমার সাথে আপনি হ্যান্ড শেক করবেন না?
আমি স্যালুট দিচ্ছি। আই স্যালুট ইউ? আবারও পা ঠুকে মিলিটারি কায়দায় একটা স্যালুট।
আমার সময় হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো উপায়েই এর কাছ থেকে মুক্ত হয়ে ছলের কাছে যেতে হবে।
আমি হাত মিলাই তার সাথে, সে আমার ধরে আন্তরিক ভাবে ঝাঁকায়। অনেকক্ষণ ধরে থাকে। আমি বিস্ফোরিত চোখে তার হাতের ক্ষত দেখি।
চামড়া উঠে দগদগে ক্ষতের প্রলেপ দেখা যাচ্ছে। আমার গা গুলায়। বমি লাগে। আমি সেইসব বোধকে উপেক্ষা করে তার হাত নাড়ানোর যন্ত্রনা সহ্য করি
এইসব মানুষেরা অসহায়, তাদের মানসিক সহায়তা প্রয়োজন, এইসব বড় বড় কথা মুখে বললেও বাস্তবিক বিচারে আমি এইসব ধারণাকে নৈতিকভাবেই সমর্থন করতে পারি। বাস্তবে এইসব মানুষের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী কোনো সংযোগে আমি অসস্তি বোধ করবো ভীষণ রকম।
আমার ক্ষুদ্রতা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি লজ্জিত হই। তবে সান্তনাও পাই এটা ভেবে যে সামাজিক মানুষ হিসেবে এই ক্ষুদ্রতাটুকু আমার ভেতরে থাকবেই। মিশনারি উদারতা এবং মানবপ্রেম আমার নেই। মানবতাবাদী হওয়া এবং সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করার ভেতরে অনেক তফাত।
আমি তাকে সালাম জানিয়ে বাড়ীর পথ ধরি।
বাসায় ফিরে অনেকক্ষণ ধরে হাত ধুই। সাবানের পরতের উপরে সাবানের পরত চড়াই। আমার ছেলেকে খাওয়াতে হবে। এই ঘিনঘিনে বোধটা না যাওয়া পর্যন্ত তাকে খাইয়ে মানসিক শান্তি পাবো না।
অনেকক্ষণ পর মনটা আশস্ত হয়, তবে সেই ক্ষতের প্রলেপের দগদগে দাগটার ছবি মুছে যায় না।
আমি স্মৃতিতে একটা দগদগে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত নিয়ে ঘুরতে থাকি শহরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।