পাখি এক্সপ্রেস
(আমার ছোটবোনের জীবন থেকে নেয়া)
হাসপাতালের বেডে শুয়ে গলায় লাগানো তাবিজগুলো গুনছে সুমি। তার পাশেই শুয়ে আছে আট মাস বয়সী সন্তান অহি। সে ঘুমুচ্ছে। সুমি তাবিজ গুনছে আর সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে আছে। কেন জানি বড্ড বেমানান মনে হচ্ছে এই শিশুটির পাশে শুয়ে থাকা।
এখন বেলা ১২টা, এখনতো কলেজের ক্লাশরুমে অথবা মাঠের এক কোনে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় থাকার কথা। বিয়ে এবং বিয়ের সূত্রে আসা পাশে শুয়ে থাকা পুরুষ লিঙ্গের শিশুটিতো থাকার কথা লংকা দূরত্বে। অথচ কি করে যে, সেই দূরের বাস্তবতা এতো নিকটে চলে এলো ! বিভিন্ন আকারের বড় ছোট ১২টি তাবিজ এখন সুমির গলায় শোভা পাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু তাবিজকে আবার তুমারও বলে।
সুমির স্বামীর বাড়িতে নতুন ঘর দিয়েছে।
দেয়াল গুলো ইটের তৈরি হলেও ছাদ দেয়া হয়নি। ওখানটাতে টিনের ছাউনি দেয়া হয়েছে। অনেক বড় ঘর। ঘরে বসবাস শুরু করার পর ছাউনির কাঠগুলো ধীরে ধীরে গা’র আড়মোড় ভাঙ্গা শুরু করেছে। তাই মাঝে মধ্যে খুব জোরে জোরে আওয়াজ দেয়।
তবে বেশিরভাগ সময়ই সুমির রুম বরাবর আওয়াজটা শুনা যায়। এরই মাঝে একদিন গভীর রাতে সুমির শাশুড়ি টয়লেটে যাওয়ার জন্য উঠলে আওয়াজ শুনে ভয় পান। আর তার সাথে খুজে পেলেন ইয়া লম্বা সদা পোশাকের এক নারীর অস্তিত্ব। বেশিক্ষণ দেরী হলো না, পুরো বাড়ি জুড়ে খবর হয়ে গেল ভুত এসেেছ। জ্ঞান হারালো সুমির শাশুড়ি।
এর সাথে সৃষ্ট লংকাকান্ডের বলি হতে শুরু করলো সুমি। যেহেতু সুমির রুমেই ভুতে চিৎকার করে, সেহেতু ঐ রুমেই ভুতে আছর করছে । সুতরাং ভুত তাড়াতে হবে। এবার আসবে ওঝা, তাড়াবে ভুত। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁছ করতে পেরে সুমি ফোন করেছিলো তার বড় ভাইকে।
বড় ভাই এসে মায়ের অসুস্থতার অযুহাত দেখিয়ে বোনকে নিয়ে গেলো তাদের বাড়ি। সে যাত্রায় সুমি বেঁচে গিয়েছিলো।
কিন্তু এবার আর বাঁচতে পারলো না। সন্তান প্রসব পরবর্তী সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে সুমি ভুগতেছিলো ভীষণ দুর্বলতায়। মুরুব্বীরা খুজে পেল একটি রোগের অস্তিত্ব, যার নাম ‘হরবায়ু’।
এবার ডাহুক পাখির রক্ত দিতে হলো মাথায়, চুলে বাঁধতে হলো কোন এক আগাছার লতা। শারিরিক দুর্বলতার সাথে এবার যুক্ত হলো মানসিক অস্থিরতা। যা সুমির কাছে অসহ্যকর মনে হলো। সুমি আসলে এ ধরণের পরিবেশ বা পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তাই তার কাছে বর্তমান সময়টা বড্ড দু:সময় হয়েই ধরা দিলো।
তার জন্য আয়োজিত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রহসন বা নির্যাতন ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। যদিও তার করার কিছুই নেই। বাপের বাড়ি হলেতো বড় ভাইয়ের সহায়তায় কিছু করা যেত। এখানেতো তাও সম্ভব নয়। অবশ্য বড় ভাইকে খবর দিলে এসে তাকে নিয়ে যেতো, কিন্তু আর কতো? এমনিতেই বোনদের কিছু শুনলে ভাইটির অস্থিরতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
বেচারার মনের অবস্থাও বুঝতে হবে। বোনদের চিন্তায় চিন্তায় হয়তো একসময় সে নিজেই নি:শেষ হয়ে যাবে। এইসব ভেবেই ভাইকে কিছু জানায়নি সুমি। এরই মাঝে একদিন রাতে টয়লেটে থেকে আসার সময় সুমি মাথাঘুরে পড়ে যায়। তখন রাত প্রায় ১১ টা।
সুমির এভাবে ভুমিষ্ঠ হয়ে পড়ে থাকা আবি®কৃত হয় রাত ২টার সময়। সাথে সাথে আবি®কৃত হয় ভুতের অস্তিত্ব। সুমিকে নাকি ভুতে এভাবে ফেলে রেখে চলে গেছে! দু’টো দেবর আর শশুর গেলেন তিন ফকিরের বাড়ি। ভোরে ভুত তাড়ানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফোন করা হলো সুমির বাপের বাড়ি। সুমির বাবা অসুস্থতার বিষয়টি সুমির ভাইকে জানানো নিরাপদ মনে করেনি।
তাই বড় মেয়ের বাড়িতে যাবার কথা বলে সকাল ৯টার দিকে সুমির মা বাবা বের হলেন সুমির স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখলেন সুমির অবস্থা আশংকাজনক। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে এবং পরবর্তীতে ছেলের বকা খাওয়ার ভয়ে একরকম জোর করেই মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়ালেন সুমির মা। পেছনে পড়ে রইলো সুমির শশুর শাশুড়ীর গালের ভেংচি এবং নাক সিটকানো। তবুও মেয়েকে বাঁচানোই তখন ফরজ হয়ে গিয়েছিলো।
হাসপাতালে সুমির অবস্থান দুই দিন ধরে। এখন সে মোটামুটি সুস্থ। বড়ভাই খবর পেয়েছিলো হাসপাতালে ভর্তির দিনের বিকেলে। তাও সুমি নিজেই ফোন করে আনিয়েছিলো। বিনিময়ে মা বাবা শুনলেন মাঝারি কিছু উত্তপ্ত বাক্য।
বড়ভাইকে কাছে পাওয়ার পর সুমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য এখানেও আর রেহাই নেই। তেল পড়া, পানি পড়া পায়ে হেঁটে হাসপাতাল পর্যন্ত চলে এসেছিলো। ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে ওগুলো ফেলে দেয় সুমির ভাই।
ঠিক এই মূহুর্তে সুমি ভাবছে তার নিকটের কিছু অতীতের কথা।
অসহনীয় জীবন যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে দুই সন্তান রেখে অকালেই পরকালে প্রস্থান করেছিলো সুমির বড়বোন। একটি জীবন কতটুকু পুড়তে পারে, কতটা জ্বলতে পারে, তা আঁচ করেছিলো বড়বোনকে দেখে। মা বাবা কি করে একটি সত্যিকারের জীবনকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে তাও সুমি দেখেছিলো। বড়বোন যখন মারা যায় তখন সুমি খুবই ছোট। নবম শ্রেনীর ছাত্রী।
বোন জামাই তখন প্রবাসে ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই ওই চল্লিশোর্ধ বয়সী পাষন্ডটা শালী বিয়ে করার আশা ব্যক্ত করলো এবং মহা উচ্ছাসে ফেটে পড়লো। এদিকে সুমিদের আত্মীয় স্বজনরাও সুমির মা বাবাকে বলতে শুরু করলো সুমিকে বড়বানের স্বামীর কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য। আবার মৃত বোনের শশুরবাড়ির পক্ষ থেকেতো প্রস্তাব বেশ কয়েকবারই আসলো। বিদেশেই বসেই শুয়োরটা গ্রামের পঞ্চায়েতদের নিয়োগ করলো সুমির বাবাকে বুঝানোর জন্য।
তুরুপের তাস ছিলো মৃতের রেখে যাওয়া দুইটা অবুঝ শিশু। সৎমায়ের হাতে তারা নিরাপদ নয় - এ যুক্তি দেখিয়েই খালা কে মা বানানোর বিষয়টি সুপারিশ করতেন। যদিও বিষয়গুলো সুমির বড়ভাইয়ের অগোচরেই ঘটতো। অথচ সুপারিশকারীদের জন্য সুমির ভাইকে দিয়েই তার মা বাবা প্রতিদিন পান সুপারী কেনাতেন। বোনের মৃত্যুর ছয়মাস পরে সুমির বোনজামাই বিদেশ থেকে আসে এবং শশুর শাশুড়ির প্রতি অত্যধিক ভক্তি দেখাতে শুরু করলো।
তখনই সুমির বড়ভাই সুমনের নজরে আসে বিষয়টি। সুমনের সন্দেহগুলো খুব কমই ভুল প্রমানিত হয়। এ সন্দেহটিও অমুলক হয়নি। ঘটনাটি বিস্তারিত জানার পর সুমনের চোখে ভাসতে লাগলো সেই পান খাওয়া মুখ গলো। লাল রঙা সেই ঠোট আর জিহ্বাগুলো তার কাছে তখন রক্তভেজা শকুনের মুখের মতো মনে হলো।
সে শকুন গুলো চল্লিশোর্ধ বোনের জামাই’র সাথে ষোড়শী শ্যালিকার বিয়ে দেয়ার জন্য সুপারিশে মেতে উঠেছিলো। সুমির মা বাবা যখন মেয়ের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য একজন পুরুষের হাতে তুলে দেয়ার ভাবনায় মশগুল, ঠিক তখনই সুমন মাথা শুন্য হয় বোনের জীবন গড়ার জন্য। নিজ মা বাবাই তখন শত্র“ হয়ে যায়, যখন বড় ছেলের কথার বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করতেও রাজি নয়। সুমির অবস্থা তখন কোরবানের জন্য প্রস্তুত রাখা পশুর মতো। আর সুমন যেন সে পশুর আত্মা।
পশুটির দেহ এবং আত্মা দু’টোই তখন দিশেহার ছিলো। তবুও সুমন শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলো। ক’বেলা খাচেছ, ক’ঘন্টা ঘুমাচ্ছে তার কোন ঠিক ছিল না। একদিন বোনজামাইকে পেয়ে যথার্তই সম্মানহানি ঘটিয়ে দিলো সুমন। তবুও বেয়াক্কেলের আক্কেল হলো না।
সকালে অপমানিত হয়ে আবার বিকেলেই শশুর বাড়ি হাজির। কারণ সুমির বাবার বিশাল সম্পত্তির নেশালো হাতছানি তার সামনে।
সুমন যখন কোনভাবেই তার মা বাবাকে বুঝাতে পারছিলো না, তখন পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ভয় দেখালো। বাবাও জানিয়ে দিলো, তাতে তার কোন সমস্যা নেই ! সন্তানের প্রতি পিতার অনাদরের বিষয়টি সুমনের মাথায় একটুও আসেনি, শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোটবোনের অশ্র“সজল দিকভ্রান্ত চেহারাটা। সুমনও বুঝতে পারলো মমত্ববোধকে অস্ত্র বানিয়ে কোনভাবেই বোনকে বাঁচানো যাবে না।
তাই এবার হাত দিলো পিতা মশাইয়ের দুর্বল জায়গাতে। একদিন হুমকি দিলো ঘরে এবং পিতার একমাত্র উপার্জনস্থল বাজারের মুদি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেবে। ঘরের কিছু জিনিস পত্র ভাংচুর করে তার একটা নমুনাও দেখিয়ে দিলো। এবার সুমনের বাবা সওদাগর সাহেবের টনক নড়ে উঠলো। সন্তানদের চাইতেও দামী সম্পদ হানির বিষয়টি ভেবেই আঁৎকে উঠলেন সওদাগর।
বসলেন ছেলেকে নিয়ে। সুমনও সুযোগ পেয়ে অগ্নিমুর্তি ধারণ করে তার অবস্থান পরিষ্কার করে দিলো। অবশেষে একটা দু:সহ নারকীয় পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটলো সুমনের জয়ের মাধ্যমে। এ যাত্রায় বেঁচে গেল সুমি। বড় জামাইকে আশ্বস্ত করে বুঝিয়ে সুজিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হলো।
এবার শুরু হলো সুমিকে রক্ষা করার আরেক হাস্যকর নাটকের। বড়জামাই ওর কোন ক্ষতি করতে পারে, তাই সুমিকে নিরাপদে রাখার জন্য তার গলায় এবং হাতে ঝুলানো হলো কয়েকটা তাবিজ। কিন্তু সুমন আর কিছু বলে না। এখন আবার বাড়াবাড়ি করতে গেলে যদি বাবা মা আবার উল্টে যায়।
নতুন করে আবারও বিপত্তি দেখা দিলো।
সুমিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে না হলে বড় জামাই সমস্য করতে পারে, এ ধুয়া তুলে সুমিকে বিয়ে দেয়ার তোড়জাড় শুরু করলো। সুমন এবার পড়লো আরেক সংকটে। অনেক ভেবে চিন্তে ছোটবোনের সাথে আলাপ করে সুমন বাবা মা’র সাথে আর দ্বিমত করলো না। তবুও সমস্যার শেষ নেই, ক’দিন আগেও সুমির জন্য কেবল বিয়ের প্রস্তাব আসতো অথচ এখন আর আসে না। তার মানে বড় জামাই তাবিজ করে বিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
এন্টি তাবিজেও কাজ করেনি। সুতরাং এটা শক্তিধর কোন তাবিজ। এবার শুরু হলো শক্তিমান ফকিরের খোঁজ। সুমির গলায়, হাতে আর কোমরে তাবিজের সংখ্যা বেড়েই চললো।
অবশেষে সুমির বিয়ে হলো এসএসসি পরীক্ষার ক’দিন আগে।
লাফা খেলার দড়ি, ধাপ্পার পাথরের গুটিগুলো, লুডুর বোর্ড, ব্যাডমিন্টনের ফেদারগুলো সবই ছোটবোন কাকলির হাতে তুলে দিয়ে বিহঙ্গকে ছুটি দিয়ে হাতে পায়ে শিকল বেঁধে চলে এলো স্বামির বাড়ি। স্বামীটা প্রবাসী হলেও ভালোই। বিয়ের রাতেই সব তাবিজ খুলে সুমনের হাতে দিয়ে দেয়। ভেবেছিলো এবার বুঝি তাবিজের অত্যাচার বন্ধ হবে।
কিন্তু নাহ্, হাসপাতলে শুয়ে শুয়ে সুমি ভাবছে - তাবিজের সাথেই বোধ হয় তার বিয়ে হয়েছে।
কারণ স্বামী তার থেকে দূরে থাকলেও (প্রবাসে) তাবিজ কিন্তু তার সাথে সাথেই আছে। গলাজড়িয়ে, হাতে ধরে, কোমর পেঁছিয়ে তাবিজগুলো খুব আদরেই আছে !
(মূল গল্পটি আরো বড়, এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া হলো)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।