আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্বীনের আছর, তাবিজ কবজ ও অন্যান্য

আমার ছোট বেলার কিছু অংশ কেটেছে আমার নানার বাড়ি লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার নাগমুদ গ্রামে। রামগঞ্জের পাশে ছিলো লক্ষীপুর জেলার ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র সোনাপুর বাজার। আমার এখনো মনে পড়ে বড় বড় নৌকা আসতো খাল দিয়ে। সেসব নৌকায় চাল ডাল তেল নুন বোঝাই করা থাকতো। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অবাক নয়নে নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

মনে খুব ইচ্ছে হতো এসব নৌকায় করে হারিয়ে যাই কোন এক অজানায়। শৈশবের সে চাওয়া এখনো মনে গেঁথে আছে। কোনদিন হয়তো এই জঞ্জালের শহর ছেড়ে একদিন সত্যিই অজানায় হারিয়ে যাবো। আলোচনা থেকে দূরে সরে এসেছি বসে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমার নানা বাড়ির গ্রামে তখনকার দিনে তাবিজ কবজ আর খনকারদের (যারা তাবিজ দেয়) খুব কদর ছিলো।

পুরো গ্রাম ছিলো কুসংস্কার এর এক আড্ডাখানা। কারো কোন অসুখ হলে সবার আগে ডাক পড়তো খনকারের। মনে করুন কারো পেটে ব্যাথা খনকার এসে বলতো এতো আসরার জ্বিনের কাম অথবা আপনারে তো বান মারছে। এই বান ছুটানোর ব্যবস্থা করতে হইবো। রাত গভীরে কবরখানার মাটি আনতে হইবো তারপর সে মাটি কালা মুরগীর রক্তের সাথে মিশাইয়া অবস্যার রাতে ঘরের কোনায় পুইত্তা দিতে হইবো ইত্যাদি ইত্যাদি।

খনকার যখন এসব কথা বলতো তার মুখ থাকতো গম্ভীর। গ্রামের মুর্খ মানুষগুলা ( আমি সরল সোজা বললাম না কারন শহরের লোক গ্রামের মানুষকে সরল ভাবে তারা মোটেও সরল না,মিছকা শয়তান) বিশ্বাস করে সেই কাজই করতো। পেটের ব্যাথা দুএকদিন পর নিজে নিজে ভালো হয়ে যেতো। তখন খনকার সাহেব বড় কবিরাজ হয়ে যেতেন। আমার নানাদের দুইবাড়ি পর বড়বাড়ি।

সে বাড়ির ছেলে দুলাল ভাই। আমার আজো দুলালের চেহারা ভেসে উঠে চোখে। কারন এই দুলাল আমাকে কাঁধে করে সাকো পার করতেন। আমার সাঁকো ফোবিয়া ছিলো এখনো আছে। আমরা একসাথে ঘুড্ডি ওড়াতাম।

দুলাল ভাই আমাদের ১৪/১৫ বছরের বড় হবেন কিন্তু তার সাথে আমার বন্ধুর মত সখ্যতা ছিলো। আমি পড়তাম ক্লাস ফাইভে আর দুলাল ভাই রামগঞ্জ কলেজে পড়তেন ইন্টার। পড়াশোনার দিকে দুলাল ভাইয়ের কোন আগ্রহ নেই। তার সব পরিকল্পনা ঘুড়ি কেন্দ্রীক। সাকতোলা গ্রামের সাথে ঘুড়ি খেলায় জেতার জন্য নানান কৌশল সারা বছর বের করতে থাকতেন।

প্রতিবছর গ্রামে ঘুড়ী প্রতিযোগিতা হতো এখন হয় কিনা জানা নেই। সারা বছর পরিকল্পনা থাকতো ঘুড়ি আর ফুটবল খেলায় কিভাবে আন্তগ্রাম চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়। বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘুড়ির প্রতিযোগীতা। দুলাল ভাই সহ আমাদের কারো ঘুম নেই দিনরাত সুতায় মাঞ্জা দেয়া নানান ডিজাইনের ঘুড়ি বানানো চলছে। একদিন সকাল বেলা দুলাল ভাই এসে বললেন শরীফ আমার বিয়া ঠিক হইছে।

আম্মারে কইলাম ঘুড়ি খেলার পরে কিন্তু আম্মা রাজি হয়নাই । এক সপ্তাহের মধ্যে পাশের গ্রামের ফুটফুটে এক কিশোরীর সাথে দুলাল ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। ধুম ধাম করে আমরা খানা পিনা করে বিয়ের অনুষ্টান করলাম। বিয়ের পর দুলালভাই একটু ঘরকোনা হয়ে গেলো। আমরা তো ভাবলাম এইবার হারা লাগবো।

কিন্তু আমাদের সব কল্পনাকে মিথ্যা প্রমান করে দুলাল ভাই এবার ভাবী সহ ঝাঁপিয়ে পরলেন ঘুড্ডি তৈরীর কাজে। বিদেশীদের মত ফর্সা টুকটুকে মেয়েটি যে শুধু স্বামীকে খুশি করার জন্য ঘুড্ডী বানাতে আসতো তা আমরা ভালই বুঝতাম। দুলাল ভাইও ঘুড্ডি একটা বানিয়ে বউকে দেখাতো কেমন হইছে কওতো বউ। কিশোরী নববধু শুধু মুচকী হাসতো,আমার চোখে এখনো ভেসে আসে সে মিষ্টি হাসি। ঘুড়ি উৎসবের তিন চার দিন আগে হঠাত দুলাল ভাইয়ের বমি শুরু হলো,প্রচন্ড পেটের ব্যথা।

কোন ভাবেই ব্যথা কমেনা। শেষে ডাকা হলো খনকারকে। খনকার দেখে বললো পাশের গ্রামের লোকজন তাবিজ করছে যাতে এবার আমরা হাইরা যাই। সবাই তো খনকার এর কথায় তৃপ্ত। কি করতে হবে এখন।

খনকার বললো ছাগলের দুধের সাথে সিধুর মিশিয়ে ভোর বেলা খেতে হবে। খনকারের কথামত তাই করা হলো। সকাল বেলা সেই সিধুর মেশানো দুধ খেয়ে দুলাল ভাইয়ের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে গেলো। রাত দুইটার দিকে দুলাল ভাই পেটের ব্যাথা নিয়ে দুনিয়া থেকে চীর বিদায় নিলো। কিশোরী বধুর কান্নায় আকাশ বাতাস সিক্ত হলো।

আজো সে কান্না আমার হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টই করে। সে বছর তাবিজ করার অপরাধে পাশ্ববর্তী গ্রামের সাথে এই গ্রামের সংঘর্ষ হলো। এবং বিষটি শেষ পর্যন্ত থানায় গিয়ে মিমাংসা করতে হলো। মেডিক্যালে ৩য় বর্ষে পড়ার সময় সর্বপ্রথম যখন এপেন্ডিসাইটিস সম্পর্কে জানলাম। তখন আমার চোখে ভেসে আসলো দুলাল ভাইয়ের মুখ।

এতো দুলাল ভাইকে বান মারা সেই অসুখ। স্মৃতির মনিকোঠায় আবারো হানা দিলো দুলাল ভাইয়ের কিশোরী বধুর গগন বিদারী কান্না। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো দুলাল ভাই মাত্র ১০/১৫ মিনিটের একটা অপারেশনেই আপনি সেরে উঠতেন। এখন ২০১৩ সাল। এখনো ঐ গ্রামে কোন পরিবর্তন হয়েছে? উত্তর না।

এখনো সেই গ্রামে খনকার আছে তবে সেই খনকারের নাম ডাক্তার। ফাইভ পাশ করা ঔষধের দোকানদারকে বলা হয় ডাক্তার সাহেব। তিনি হাচি দিলো সিপ্রোফ্লক্সাসিন দেন,কাশি দিতে এজিথ্রোমাইসিন দেন। আর যে কোন ব্যাথা হোক সে গ্যাষ্টিকের ব্যথা কিটোরোল্যাক দেন( উল্লেখ্য গ্যাষ্টিকের রোগীদের এসব ঔষধ সম্পূর্ন নিষিদ্ধ) কিন্তু গ্রামের মানুষ আজো চিকিৎসা বঞ্চিত। আজো অপচিকিতসায় করুন পরিনতি ভোগ করে অন্যকোন দুলাল,অন্যকোন কিশোরি বধু।

আমি জানিনা এ মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারবো কিনা। কিন্তু বিশ্বাস করুন মনে তীব্র ইচ্ছা একদিন এসব মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো। জানিনা জীবনের কঠিন বাস্তবতা আমাকে তা করতে দেবে কিনা? তবুও স্বপ্ন দেখতে তো আর দোষ নেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৮১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.