মানুষ স্বচ্ছলতা চায়। এই সচ্ছলতার কারণে মানুষ প্রয়োজনে অধিক শ্রমঘন কাজ করতেও আগ্রহী। আমাদের অধিকতর বাণিজ্যিক প্রচারণা আমাদের বিলাস দ্রব্যের চাহিদাও আকাশ ছোঁয়া। হয়তো বিলাস দ্রব্যের প্রাপ্তিতা নিশ্চিত করতেও অনেকে বাড়তি শ্রম প্রদানে আগ্রহী।
আমাদের অভাববোধ চাহিদা পুরণের অসমর্থতা।
আমাদের যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের চাহিদা রয়েছে তেমন ভাবেই বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অন্ধ হয়ে আমাদের অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিষের কৃত্রিম চাহিদাও তৈরি হয়েছে। এইসব চাহিদা পুরণ না হওয়াও এক ধরণের দারিদ্রতা বোধের জন্ম দেয়।
অতিরিক্ত সচ্ছলতার প্রয়োজনে মানুষ তার বিশ্রমকালীন সময়টাকেও অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত করতে চায়। এ কারণেই গ্রামে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংকুচিত বলে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসে মানুষ। ছোটো শহর থেকে বড় শহরে মানুষ নিজের নতুন আবাস গড়ে তোলে।
মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া সব সময়ই চলমান।
দরিদ্র দেশের অধিবাসীরা অধিকতর স্বচ্ছলতার খোঁজে অপেক্ষাকৃত উন্নত রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, নিরাপদ ভবিষ্যত এবং নানাবিধ কারণে অভিবাসী হতে চায়। এই অভিবাসন প্রক্রিয়া চলমান একটা প্রক্রিয়া।
হয়তো দেশের আভ্যন্তরীণ যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অভাব এবং সামাজিক নিষ্পেশনের প্রতিক্রিয়ায় একজন মানুষ নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে অন্য কোনো স্থানে কিংবা নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্য কোনো দেশে জীবিকা ও নিরাপদ জীবনের খোঁজে যেতেই পারে।
এই স্বাভাবিক প্রবণতার সাথে হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের তফাত কি?
মানুষের প্রাথমিক ধারণা হিউম্যান ট্রাফিকিং একটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়। এখানে একজন মানুষকে তার অসম্মতিতে কিংবা তার অগোচরে, তাকে ফুঁসলিয়ে কিংবা জোচ্চুরি করে দেশের সীমান্ত পার করে পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে পাচার করে দেওয়া। এবং মানুষের আরও একটা ধারণা , সাধারণত নারী এবং শিশুরাও পাচার হয়।
অর্থ্যাৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠিত ধারণাটা ব্যবচ্ছেদ করে হিউম্যান ট্রাফিকিং সম্পর্কে একটা বদ্ধমূল ধারণা কিংবা এমন কাছাকাছি একটা ধারণা পাওয়া যাবে-
হিউম্যান ট্রাফিকিং এমন একটা বিষয়
মূলত নারী এবং শিশুরা এর শিকার
শিশুরা মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয় উট রেসের জকি হওয়ার জন্য
নারীরা পাচার হয় এবং তাদের পাচার করবার মূল কারণ পতিতালয়ে নারী এবং নারী শিশুর চাহিদা রয়েছে।
তবে জাতিসংঘ হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের যে সংজ্ঞাটা দিয়েছে তা চমৎকার-
হিউম্যান ট্রাফিকিং এমন একটা বিষয়, যেখানে একজন মানুষকে মূলত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়, কিংবা স্থানান্তরিত করবার জন্য অর্থ সংগ্রহ, কর্মী নিয়োগ করা হয়।
এবং এখানে যে মানুষটাকে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে তাকে মূলত শোষণ করবার জন্যই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার মানবিক অধিকার এবং তার মানবিক অনুভুতিকে হত্যা করে তাকে অন্য কোনো কিংবা কতিপয় মানুষের চাহিদা পুরণে জোরপূর্বক বাধ্য করা হচ্ছে।
এই মানুষটাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে, কিংবা অন্য যেকোনো প্রকারের ছলচাতুরির সাহায্যে, জোরপুর্বক, ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে যেকোনো স্থানে স্থানান্তর করাটাই হিউম্যান ট্রাফিকিং।
এই মানুষটা বঞ্চিত এবং শোষিত হচ্ছে এবং তার নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা নেই। একজন মানুষকে অনৈতিক কিংবা মানবেতর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা কিংবা ব্যবহার করবার নিমিত্তে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন হিউম্যান ট্রাফিকিং।
এখানে বঞ্চনা হলো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রমপ্রদান, কিংবা জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হওয়া, স্বাধীন অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে, যেখানে তার বিশ্রামের সুযোগ নেই, তাকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা কিংবা তার অসম্মতিতে যৌনহয়রানি করা কিংবা যৌনলাঞ্ছিত করা যেখানে তার নিজের স্বাধীন সত্ত্বা থাকে না। সে অন্যের হাতে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পশুবত জীবন যাপনে বাধ্য হয়- কিংবা জোরপুর্বক তাদের বিকলাঙ্গ করে দেওয়া এবং তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিনতাই করার নিমিত্তে যখন কাউকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে সেটাই হিউম্যান ট্রাফিকিং এর আওতায় পড়বে।
সুতরাং হিউম্যান ট্রাফিকিং যদিও সাধারণ ভাবে বললে বুঝায় কোনো ব্যক্তিকে তার অসম্মতিতে দেশের সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া তবে হিউম্যান ট্রাফিকিং আসলে মানুষকে ছলনা কিংবা ভয়ভীতি কিংবা শক্তি প্রদর্শন করে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তাকে পশুর মতো ব্যবহার করা। এখানে যে মানুষটি তার মনুষ্যোচিত প্রাপ্ত সম্মান পাচ্ছে না এবং তার শরীর এবং তার শ্রমের উপরে তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রন নেই - এই পরিস্থিতি তৈরিতে যেসকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান দায়ি তারা সবাই হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের সাথে যুক্ত।
সেই বিবেচনায় গ্রাম থেকে শহরে কাজের প্রলোভন দিয়ে নিয়ে আসা মানুষের সর্বস্ব হরণ এবং গ্রাম থেকে কোনো মহিলা বা মেয়েকে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শহরে এনে তাকে দাসত্ববৃত্তি কিংবা পতিতা বৃত্তিতে ব্যবহার করাও হিউম্যান ট্রাফিকিং।
একই ভাবে যেইসব প্রতিষ্ঠান দেশের জনগণকে মিথ্যা তথ্য আর কাজের আশ্বাস দিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে এবং তারা প্রতারিত হচ্ছে এই প্রক্রিয়াটাও হিউম্যান ট্রাফিকিং।
প্রথমটা অন্তঃদেশীয় মানবপাচার আর দ্বীতিয়টা আন্তঃদেশীয় মানবপাচার।
অন্তঃদেশীয় হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের শিকার হয় মূলত মেয়েরা এবং শিশুরা। গ্রাম থেকে কিংবা আদিবাসী এলাকা থেকে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষমতাবান চক্র মানুষকে প্রথমত প্রতারিত করে শহরে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়, কিংবা কোনো শিশুকে ধরে এনে বিকলাঙ্গ করে তাকে ভিক্ষার কাজে নিয়োজিত করে।
এইসব বিকলাঙ্গ শিশুদের অনেককে দেখা যাবে হাইকোর্টের পাশের ফুটপাতে, ফার্মগেটের কাছাকাছি কোনো এলাকায়।
আর গ্রাম থেকে শহরে আসা প্রতারিত মেয়েদের খোঁজ পাওয়া যাবে শহরের পতিতালয়ে, তাদের অনেকেই নিশ্চিত চাকুরির প্রলোভনে গ্রাম ছেড়েছিলো, এবং তারা শহরে এসে মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে গণধর্ষিত হয় এবং এই ধর্ষণে মৃত্যু বরণ করলে তাদের নাম পরিচয়বিহীন লাশ খুঁজে পাওয়া যায় শহরের নিরব জনবিরল অঞ্চলে বস্তা কিংবা বাক্সে পুরে তাদের ফেলে রাখা হয়।
এবং যারা এই অমানবিকতা সহ্য করে বেঁচে যায়, তাদের বেচে দেওয়া হয় অন্য কোনো পতিতালয়ের মালিকের কাছে। এইসব মেয়েদের মূল্য মূলত বয়েস ভেদে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
তবে আন্তঃদেশীয় পাচারচক্রের শিকার হয় অনেকেই।
বাংলাদেশে প্রচুর আদম ব্যবসায়ী আছে যারা চাকুরির নিশ্চয়তা দিয়ে মালোয়শিয়ায় মানুষকে পাঠাচ্ছে, এবং এর জন্য ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা নিচ্ছে, এবং এরপর সেই সব শ্রমিকের মালোয়শিয়ায় গিয়ে দেখছে তাদের কোনো বৈধ কাগজ নেই, তাদের অনেককেই ভ্রমন ভিসায় মালোয়শিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এবং তারা সর্বস্ব হারিয়ে সেখানে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। এই ধরণের সকল প্রতারণাই মূলত হিউম্যান ট্রাফিকিং। যারা স্পেন কিংবা ইতালি যাচ্ছে এবং যারা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে তারা সবাই পাচার হয়েই যাচ্ছে/
ক'দিন আগেই সৈদি আরবে পাচার হওয়া এক বাঙালী মহিলার অমানবিক কাহিনী পেপারে এসেছিলো। একই সাথে আজকে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক নিয়োগের নামে যেসব অরাজকতা চলছে তার রিপোর্ট।
এই হিউম্যান রাইট এজেন্সির রিপোর্টে যেসব ভয়াবহ তথ্য উপাত্ত উপাস্থাপিত হয়েছে এর সবগুলোই জাতিসংঘ বর্ণিত হিউম্যান ট্রাফিকিং সংজ্ঞার সাথে যায়।
তাদের বিশ্রামের সুযোগ নেই, তারা কর্মক্ষেত্রে ধর্ষিত হচ্ছে, তারা নিয়মিত বেতন ভাতা পাচ্ছে না, মূলত শ্রমিক হিসেবে তাদের যে অধিকার প্রাপ্য সেই অধিকার তারা পাচ্ছে না। এমন কি তারা দেশে ফিরবার অধিকারও কিংবা সুযোগও পাচ্ছে না।
নারী পাচার হচ্ছে গেরোস্থালী শ্রম এবং মূলত অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবানদের যৌনযথেচ্ছাচার পুরণের নিমিত্তে, তারা পাচার হচ্ছে যৌনসেবাদাসী হিসেবে, পাচার হওয়া বাঙালী এবং বাংলাদেশী মেয়েদের পাওয়া যাচ্ছে থাইল্যান্ডের পতিতালয়ে, পাওয়া যাচ্ছে মালোয়শিয়ায়, পাওয়া যাচ্ছে আরব আমিরাতে , পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপ মহাদেশে, এবং ভারত এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন পতিতালয়েও পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশী মেয়েদের।
মূলত এরা পাচর হয়ে যায় কোলকাতায়। এখানে তাদের দ্বীতিয় কোনো মালিকের কাছে বেচে দেওয়া হয়।
এদের মূল্য মাথাপিছু ২০ হাজার টাকা, এই বিক্রী হওয়া মেয়েরা যায় কোলকাতার স্থানীয় পতিতালয়ে, কিংবা এদের কেউ কেউ আবার চলে যায় বোম্বেতে, সেখানে গিয়ে তারা বিক্রী হয় পুনরায়। কিংবা তারা পাচার হয়ে যায় দিল্লীতে, সেখান থেকে কারাচী।
যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে নিষিদ্ধ দাস ব্যবসা তবে বাংলাদেশের মেয়েরা দাসী হিসেবে বিক্রী হয় অন্য কোনো দেশের বাজারে। কয়েক বার হাত বদল হয়ে এইসব মেয়েরা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ছড়িয়ে পড়ে।
কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করে, তারা হয়তো ভাগ্যবতী, কিংবা এমনও হতে পারে তারাই দুর্ভাগা, মানুষের নির্মমতার সবগুলো রুপ না দেখেই তারা মৃত্যু বরণ করলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।