ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) এর চেয়ারম্যান ড: মোজাফ্ফর আহমেদ টের পেয়ে গেছেন তাঁর দূর্নীতি-বিরোধী গল্পের ঝোলার ফুটা আর বেশীদিন লুকায়ে রাখা যাবে না। টিভিতে এড, গানের জলসার প্রচারণা চালিয়েও নয়। হাটে হাড়ি ভাঙলো বলে। তাই আগেই পক্ষ ত্যাগ করে জান বাঁচানোই শ্রেয়, বুদ্ধিমান মানুষ যা করে।
রীতিমত সাংবাদিক ডেকে সাক্ষী মেনে নিজের হাত ধুঁয়ে ফেলতে আজ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) এর এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
২৪ডটকম রিপোর্ট করছে, সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "দুই সরকারের আমলে দুর্নীতির যে ব্যাপকতা ছিল এখনো সে ব্যাপকতা অব্যাহত রয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক চিত্র"। এটা হালকা নেহায়েতই কোন ষ্টেটমেন্ট বা মুখের কথা নয়, একটা নিজেদেরই করা গবেষণা জরিপের ফলাফল এর উপর ভিত্তিকরে করা সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য । বাংলাদেশের ৬২টি জেলার ৫০০০ খানার (এর ৩০০০ পরিবার ঢাকার বাইরের আর ২০০০ পরিবার ঢাকার, এদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেয়া তথ্য) উপর পরিচালিত জরিপের তথ্য, উপাত্ত পরিসংখ্যান কমপাইল শেষে সাংবাদিকদের কাছে এর রিপোর্ট প্রকাশ করতে এসেছিলেন টিআইবির সকলে। নিজেরাই একটা তুলনামূলক চিত্র দাঁড় করিয়েছেন এতে; ১/১১ এর আগের ছয়মাসের আর পরের ছয়মাসের মধ্যে তুলনা।
২০০৬ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের সাথে ২০০৭ সালের জানুয়ারি- জুলাই, এই সময়ের ঘুষ-দূর্নীতির একটা তুলনামূলক পরিসংখ্যান। এতে দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে হিসাবে, শিক্ষা, স্বাস্হ্য, ভুমিপ্রশাসন, স্হানীয় সরকার, এনজিও খাতে সবজায়গাই ঘুষের দূর্নীতি ছড়াছড়ি, বলাবাহুল্য তা বেড়েছে।
শিক্ষাখাতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ,
স্বাস্থ্য খাতে ৩২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ,
ভূমি প্রশাসনে খাতে ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার খাতে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ, আর এনজিও খাতে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
এছাড়া, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কাজ থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বলছেন ৯৬.৬% খানাকে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। ১০০ এর মধ্যে ৯৬.৬ - অর্থাৎ প্রায় সবাইকে।
আইজিপি এতদিন আমাদেরকে মেলা ফতোয়া শুনিয়েছেন, পুলিশ আইন সংস্কার করে বলে বেড়িয়েছেন, পুলিশ প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার পুলিশ প্রশাসনে দূর্গতির কারণ।
বিগত আঠারো মাসে দূর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা পাতিনেতারা হয় জেলে অথবা দেশে বিদেশে পালিয়ে লুকিয়ে আছেন। তদবির ব্যবসা দুরে থাক নিজের জান বাঁচানো ফরজ এখন তাঁদের কাছে। তাহলে পুলিশ প্রশাসনকে দূনীতিতে প্রভাবিত বা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করলো কারা? শুধু তাই নয় পুলিশের দুর্নীতি আরও বেরে গেল কেন? যদিও বিগত আঠারো মাসে আমরা দেখেছি, হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েও আসামি জেল গেট থেকে ছাড়া পেয়েই আবার গ্রেফতার হয়েছেন, একই আসামি কয়েকবার। রাজনৈতিক দল অনুমতি সাপেক্ষে ২০০ জনের সমাবেশ করতে পারবে - জরুরী আইনের এই শীথিলতার কথা ঘোষণা দিয়েই পুলিশ নিজেই পাল্টা রাস্তায় হাততালি দিয়ে "রোড শো" রাজপথ দখলে রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে আর সর্বপরি, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের খামোখা হয়রানি করতে ব্যাপক ধরপাকড়ের কাজে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত পুলিশের এই জয়জয়কার পরিস্হিতিতে আইজিপির হাতে কী ঠোটা পড়ছিল, পুলিশ আইনের বই তখন কোথায় ছিল? ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থে আইজিপি ব্যবহৃত হতে চান না কথাটার কোন ভিত্তি নাই। আবার রাজনৈতিক দল কার্যকর না থাকলেও দূর্নীতি কমা বাড়ার সাথে এর সম্পর্ক নাই।
তাহলে সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল তৎপর বা কার্যকর না থাকলেও পুলিশ প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, দূর্নীতির পরিমাণও বাড়ে বৈ কমে না। অতএব, আইজিপির রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কামান দাগানোটা মতলবি কাজ। সত্য হলো, রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক শক্তির কাজে ব্যবহৃত হওয়ার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী পুষে থাকে।
রাজনৈতিক দলের বদলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফকুরুদ্দীন পরাশক্তির শিখন্ডি হয়ে বসে গেলে পুলিশের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া বা দূর্নীতির পরিমাণও কমে যাবার কোন কারণ নাই। তফাৎ শুধু এতটুকুই এতে দেশীয় রাজনৈতিক দল (হতে পারে সে দুর্নীতিবাজ) এর বদলে পরাশক্তির তাঁবেদার যারা ক্ষমতায়, নতুন যে রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ সে ঘটাতে চাচ্ছে তাঁর সংকীর্ণ স্বার্থে পুলিশ প্রশাসন ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয় ঘটনাকে কেবল দূর্নীতির পরিমাণ কমা বাড়ার দিক থেকে দেখলেও আমরা টিআইবির রিপোর্টে দেখছি 'চক্ষুসূল' দূর্নীতিও কমে নাই। তাহলে রাজনীতিক নেতা বা দলকে দূর্নীতির জন্য বলির পাঁঠা বানিয়ে পরাশক্তির তাঁবেদারি আড়ালের কাজটা ক্রমশ বেগানা হতে শুরু করেছে, বলা যায়। আচ্ছা পরাশক্তির ব্যাপারটা যদি বাদও রাখি, গেল আঠারো মাসে দূর্নীতির পরিমাণ যে বাড়লো এর নৈতিক দায়দায়িত্ত্ব নিশ্চয় ফকরুদ্দিনসহ সকলের।
বিশেষত আইজিপির মত কর্মকর্তাদের যারা নিজের পদপদবীর সীমা লঙ্ঘন করেছেন। রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বলে তিনি ফকরুদ্দিনের কাছে রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে হাজির হয়েছেন। অথচ রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে হাজির হওয়া তাঁর কাজ না। তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মাত্র। সরকারের আদেশ নির্বাহ করাটাই তার কাজ, ফকরুদ্দিনের রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে হাজির হওয়া নয়, অন্তত পাবলিক এড্রেসে তো নয়ই ।
ঠিক যেমনি হাসিনা বা খালেদা সরকারের কোন আইজিপি, পুলিশ প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে - বলে পাবলিক এড্রেসে জনগণকে 'দুর্নীতি" বিরুদ্ধে তাতিয়ে বেড়াতে পারেন না, ঠিক তেমনি একই কারণে। তিনি যদি মনে প্রাণে দূর্নীতি বিরোধী হতেন তবে দেখতে পেতেন রাজনৈতিক দল, সামাজিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা এর একমাত্র উপায় ও সমাধান। আমাদের মূলধারার রাজনীতিতে রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ বলে সেই অজুহাতে পরাশক্তির তাঁবেদারির রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে দূর্নীতি কমানো যাবে না। এই কথাগুলো আইজিপির নাম দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের দূর্নীতির বরাতে বললাম বটে, তবে ফকরুদ্দিন, ড: মোজাফ্ফর আহমেদ সংশ্লিষ্ট সকলের বেলায় সত্য।
পরাশক্তির তাঁবেদারির রাজনীতিটা আসলে কী? ১/১১ এর 'বিখ্যাত' দূর্নীতি-বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে ধুনফুন সাংবিধানিক-বুঝ দিয়ে সেনাবাহিনীকে হাতমোচড় দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে বাধ্য করা হয়েছিল সহায়তা করতে আর ক্ষমতা নিয়েছিল পরাশক্তি, সামনে শিখন্ডি খাড়া করেছিল খূঁজে নেওয়া বিস্বস্ত চাকর বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কর্মচারী।
রাজনীতিতে রাজনীতিক ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি নতুন নয়, বরং রাজনীতির অনুসঙ্গ। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ক্ষমতা যে রাজনীতিতে দূর্বল, অবিকশিত। অন্যদিকে এর উপর আবার দেশের অর্থনীতিতে পুঁজি যদি আদিম সঞ্চয়ের স্তরে থাকে তবে দুর্নীতিকেই আদিম সঞ্চয়ের উপায় বানানোর ঝোঁক অর্থনীতিতে থাকবেই। রাজনীতিক ব্যবসায়ীর এই স্বভাবকে কেউ একজন কুকুরের বাকা লেজ সোজা রাখার সমস্যার সাথে তুলনা করেছেন। লেজ সোজা রাখার জন্য রাষ্ট্রকে রাজনীতিক ব্যবসায়ীর উপর খবরদারি করতে পারার মত ক্ষমতা ও রাজনীতি বাংলাদেশে দাঁড় করাতে পারার আগে পর্যন্ত আমাদের রাজনীতি লড়াই সংগ্রামে একরকম হামাগুড়ি দিয়ে, পড়ে ব্যাথা পেয়ে, আবার উঠে বসেই চলতে হবে।
এ'থেকে পরিত্রাণ নাই, শর্টকাট পথও নাই। পরাশক্তির তাঁবেদারির রাজনীতির পথ ধরে ড: মোজাফ্ফর আহমেদ গং, সুশীল সমাজ আমাদেরকে এতদিন আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি আছে এই অজুহাতে দেশের রাজনীতিতে পরাশক্তিকে ডেকে আনার পক্ষে কাজ করেছিলেন। ওদের তিন ডি - গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও "সন্ত্রাসবাদ"কে না বলা (আমেরিকান রাস্ট্রদূত মরিয়র্টির বাংলাদেশে যোগদান উপলক্ষ্যে বক্তৃতা) - এই পরাশক্তির রাজনীতির খপ্পড়ে নেবার কাজ সমাপ্ত করেছেন।
এখন নিজের গবেষণায় ধরা খেয়ে সময় থাকতে পালানোর পথ করার জন্য নতুন করণীয় সুপারিশ করছেন, "জনগণের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য দুনীর্তি বিরোধী প্রচারণা ও আন্দোলন জোরদার" করতে হবে। অথচ "জনগণের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ" - এই রাজনৈতিক কাজটা তিনি কীভাবে করবেন? আলী জাকেরকে দিয়ে বিজ্ঞাপন বানিয়ে, গান শুনিয়ে তো ফলাফল দেখলেন- দূর্নীতি বেড়েছে, কমে নাই।
অতএব এখন অস্পষ্ট কিছু একটা বলে পালানো ছাড়া তাঁর উপায় কী?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।