আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যক্তিত্ব সরদার ফজলুল করিম -এঁর একটি সাক্ষাৎকার



সরদার ফজলুল করিম আমাদের সময়ের এক অসীম সাহসের নাম। বিশিষ্ট চিন্তক , দার্শনিক এই ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার টি নিয়েছেন প্রাবন্ধিক রতনতনু ঘোষ। সবার সাথে শেয়ার করতে এখানে পোষ্ট করলাম। --------------------------------------------------------------------------------- জীবিত মানুষের চেতনায় নবজন্ম ঘটে মৃত মানুষের - সরদার ফজলুল করিম রতনতনু ঘোষ : আপনি কেমন আছেন? সরদার ফজলুল করিম : আমাকে কেউ যখন প্রশ্ন করেন : ‘আপনি কেমন আছেন?’ তখন আমি প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা বলি : ‘কেমন’ শব্দের মধ্যকার ‘ম’ বাদ দিয়ে বলুন ‘আপনি কেন আছেন?’ প্রশ্ন করি আমার পরিবার ও শুভাকাংখীদের : আমি যখন অচেতন হয়ে মরে যাচ্ছিলাম তখন আমাকে কেন বাঁচালে? আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নেই। বাঁচলে জীবনের কঠিন বোঝা বহন করতে হয়।

এ বৃদ্ধ বয়সে আমি চোখে দেখি কম, দাঁত নেই, হাঁটা-চলা তেমন করতে পারি না, বেশিক্ষণ বলতেও পারি না, মাথা ধরে। আমি তো কারো জন্য কিছু করতেও পারি না। অনেক চেষ্টা করে, অর্থ ব্যয় করে আমাকে কেন অনর্থক বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন কত মানুষ মরে অনাহারে, অর্ধাহারে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটছে মানুষের।

আমি বেঁচে আছি বার্ধক্যের জর্জরিত অবস্খা নিয়েও। সে জন্যই আমার প্রশ্ন : আমি বেঁচে আছি কেন? আমাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কেন! এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি শেষ বয়সে। রতনতনু : বাঁচা-মরা নিয়ে এতো সিরিয়াসলি ভাবছেন কেন? সরদার : ওপার থেকে আমার ডাক এসেছে। সে ডাক আমি শুনতে পেলেও তোমরা তা শুনতে পাচ্ছ না। কারণ ওপারের ডাক শোনার চ্যানেল তোমরা ধরতে পারছো না।

প্লেটোর রিপাবলিকে আছে সক্রেটিসের প্রশ্ন : তোমরা আমাকে যেতে বলছো, আমি কোথায় যাব? মৃত্যুর মাধ্যমে আমি সেখানে যাব সেখানেও কেউ না কেউ থাকবে। আমি তো একা সেখানে থাকবো না। মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের রূপান্তর ঘটে। কেউ থাকেনি। ‘জন্মিলে মরিতে হয়’­ সবার ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।

যারা জন্মেছিল তারা কেউ নেই। যেতে হবে আমাকেও। এ জীবন যাপনীয়, আবার তা মরণীয়। মৃত্যু নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। তা আসবেই।

রতনতনু : আপনি অনেক বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। প্রচুর বই সংগ্রহ করেছেন, পড়েছেন। এসব বই নিয়ে কী ভাবছেন? সরদার : আমি বইয়ের বলদ। জীবন ভরে বইয়ের শরীর স্পর্শ করে আনন্দ পেয়েছি। বইকে ভালবেসে বইয়ের বনে রয়ে গেলাম।

আমার আর আছে কী। বইতো আমার সম্পদ। কোনো কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমার গড়া গ্রন্থাগারটি না হয় পাঠকদের জন্য দান করে দিতাম। যে বাসায় ভাড়া থাকি সেখানে তো পাবলিক এসে পড়তে পারছে না। তেমন পরিসর নেই, সুযোগও নেই।

অনেক ডায়েরি লিখেছি। ভাল প্রকাশক পেলে সেগুলো প্রকাশের জন্য দিতে চাই। গুপ্তধনের মতো এগুলো আর পাহারা দিয়ে রাখতে চাই না। এ ডায়েরিতে আছে বাংলাদেশের তথ্যপঞ্জি, ঘটনার পটভূমি, কালের চিত্র। রতনতনু : শেষ জীবনে এসে আপনার কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি? আপনি মরণোত্তর দেহ ও চক্ষু দানের জন্য উইল করেছেন? সরদার : শেষ জীবনে আমার আর কিছুই চাওয়া-পাওয়ার নেই।

আগে জন্মেছি বলে পরের প্রজন্মের মতো বৈজ্ঞানিক সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারি না। আমি তোমাদের মতো ইন্টারনেট, কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি না। ইলেক্ট্রিক্যাল জগতের সুবিধা থেকে আমি পিছিয়ে আছি। তোমরা আমার পিছু নিয়েছ বলে আমি মরতে পারি না। তোমাদের টানে-আকর্ষণে আমি বেঁচে আছি।

আমাকে মরতে দিতে চায় না স্ত্রী, পুত্র, মেয়ে, মেয়েজামাই আর শুভাকাáক্ষীরা। তাদের ভালবাসার আকর্ষণে, পরিচর্যায় বেঁচে আছি আজো। আমি মরণোত্তর চোখ ও দেহদান করে যেতে চাই। তুমি আমার উইলটি ড্রাফট করে নিয়ে এসো। যদি কোনো হাসপাতালে কাজে লাগে তো লাগবে।

রতনতনু : একদিন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন­ এটা ভাবতে আপনার কেমন লাগে? সরদার : অনেক আগে আমার এক বু হাত দেখে বলেছিল; তোমার মৃত্যুতে দুর্ভোগ আছে। মানে সহজে আমার মরণ হবে না। সেই বু আমার আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ভাবছি এতো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল আর আমি বার্ধক্যের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আমি নিজে এখন একটি প্রশ্নে পরিণত হয়েছি।

নিজের প্রতি বিস্ময় আমার বেড়েছে। কী থেকে কী হচ্ছে আজো বুঝতে পারছি না, মেলাতে পারছি না। কীভাবে আজো বেঁচে আছি, তা আমারও প্রশ্ন। মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল আমার কয়েকবার। একবার পাকহানাদারদের হাতে, আরেকবার বন্দি অবস্খায় কারাগারে।

বার্ধক্যে এসে আমার পা ভেঙেছে, দীর্ঘদিন ঘরে ছিলাম। আমার হাত ভেঙেছিল, অনেকদিন ঘর থেকে বের হইনি। কিছুদিন আগে আমার অপারেশন হলো। হাসপাতালে থাকলাম অনেকদিন। এখন ঘরবন্দি হয়ে বেঁচে আছি।

চিকিৎসক মেয়ে, মেয়ের জামাইর চেষ্টা আর তোমাদের ভালবাসা আমাকে সহজে মরতে দিচ্ছে না। যতোই চেষ্টা করো তোমরা, মৃত্যু একদিন আমাকে নিতে আসবেই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, কবি শামসুর রাহমান আমাকে ভালবাসতেন। তারা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। আমি কোন ঘোড়ার ডিম! আমাকেও যেতে হবে।

আমি মৃত্যু নিয়ে দু:শ্চিন্তিত নই। মরার সাহস আমার আছে। মরবো তোমাদের ভালবাসা নিয়েই। আমি আমৃত্যু ভালবাসার ভৃত্য। রতনতনু : মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের সবকিছু কী শেষ হয়ে যায়? মৃত্যু সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী রকম? সরদার : মৃত্যুতে মানুষের শেষ হয় না।

মৃত্যুর পর মানুষের জীবন ও কর্মের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব হয়। ব্যক্তির জীবনের স্বরূপ তাতে উপলব্ধি করা যায়। আমার প্রথম মৃত্যু ঘটেছিল যখন সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অচেতন অবস্খায় ছিলাম। আর অচেতন অবস্খায় আমার বুকে মালিশ করার পর চেতনা ফিরে আমার মাধ্যমে আমার পুনর্জন্ম অথবা দ্বিতীয় জন্ম ঘটেছিল। এ দুটো ঘটনা মিলিয়ে আমি অনুভব করি আমার প্রথম মৃত্যু ও দ্বিতীয় জন্ম।

মানুষ বাঁচে তার কাজের মাধ্যমে, স্মৃতির ভেতর। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ একেবারে হারিয়ে যায় না। মানুষের প্রকৃত জন্ম ঘটে মৃত্যুর পর। জীবনের বৃত্ত সমাপ্ত না হলে কাউকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। জীবিত মানুষের চেতনায় নবজন্ম ঘটে মৃত মানুষের।

আমি মনে করি, মৃত্যুর দিনই ব্যক্তির আসল জন্মদিন। জীবিত অবস্খায় ব্যক্তির মূল্যায়ন মূল্যবান হয় না। রতনতনু : এ মুহূর্তে আপনার জীবনের স্মরণীয় কোনো ঘটনা মনে পড়ছে? সরদার : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গেলে সেখানকার একজন কর্মচারী বলেছিলেন : স্যার, আপনি তো ড্যাঞ্জারাস লোক! বলেছিলেন, পাকিস্তান না ভেঙে আপনি আর ফিরবেন না। পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ হলো, তারপরই আপনি আসলেন। লাইব্রেরির এ কর্মচারীর মন্তব্য আমি এড়াতে পারিনি।

মিথ্যা বলে তা নাকচ করতে পারিনি। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে বাংলা একাডেমীতে গিয়েছিলাম। সেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন : তুমি তোমার জীবনী লিখতে শুরু কর। আমাকে তিনি বাংলা একাডেমীতে চাকরি দিয়ে রক্ষা করেছিলেন দু:সময়ে। ‘দর্শনকোষ’ প্রকাশিত হওয়ার পর জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক অভিভূত হয়ে আমাকে গ্রহণ করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে বলেন।

একবার বিল দিতে ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। ব্যাংকের কর্মচারী চিৎকার করে বলেছিলেন : ‘সরদার ফজলুল করিম কে? কে সরদার ফজলুল করিম?’ আমি ভেবেছিলাম একটা কিছু ভুল হয়েছে হয়তো-বা। আমি এগিয়ে যাওয়ার পর ওই কর্মচারী জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনি কি প্লেটোর সংলাপ লিখেছেন?’ জবাবে আমি বললাম, আমি সেটি অনুবাদ করেছি। একজন ব্যাংক কর্মচারীর এ জিজ্ঞাসায় আমি সেদিন খুব বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলাম। জীবনে এসবই আমার বড় প্রাপ্তি মনে করি।

------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ/ সাহিত্য সাময়িকী/ ১২ জুন ২০০৮ বৃহস্পতিবার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.