'চাবি' শিরোনামে একটি চমৎকার গল্প লিখেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। তাঁর গল্পের অধিকাংশ চরিত্রের মতো এই গল্পের প্রধান চরিত্রও-চিত্রকলার তরুণ অধ্যাপক-বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত, নিঃসঙ্গ ও বিষণ্ন। কিন্তু একটি অদ্ভুত ঘটনা তাঁকে প্রতিবেশীদের কাছে যেতে বাধ্য করে এবং নানারকম অভিজ্ঞতা উপহার দেয়। একদিন তিনি বাইরে থেকে ফিরে নিজের দরজায় দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, চাবি নেই। কোথায় রেখেছেন সেটা কোনোভাবেই মনে করতে না পেরে একে একে প্রতিবেশীদের দরজায় হানা দেন।
পাশের ফ্ল্যাটে তিনি পান সৌজন্যবোধজনিত আতিথেয়তা, কিন্তু চাবি সেখানে নেই। এরপর নিচতলার প্রথম ফ্ল্যাটে পান শীতল উপেক্ষা, তারপরের ফ্ল্যাটে এরচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা- চাবির কথা বলতেই গৃহকত্রীর রুদ্ররূপ, তারপরের ফ্ল্যাটে উঁকি দিতেই গৃহকর্তার সন্দেহ ইত্যাদি। আর এভাবেই এক চমকপ্রদ বর্ণনায় লেখক নাগরিক জীবনকে তুলির এক আঁচড়ে এঁকে ফেলেন। নাগরিক জীবনের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কহীনতা, অন্যের প্রতি মনোযোগহীনতা, নিস্পৃহতা, জটিল মনোবৃত্তি, নিষ্ঠুরতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস সবই উঠে আসে তাঁর এই চাবি খোঁজার উছিলায়।
কিন্তু যে ঘরে ঢোকার জন্য এত চেষ্টা ও আয়োজন, কী এমন আছে ওই ঘরে, কী এমন গুরুত্ব তার?
কী আছে ঐ ঘরে? আছে আমার সর্বস্ব, আমার সারা জীবনের সাধনা; কতো সমাপ্ত অসমাপ্ত ছবি, কতো ভাবনা আর স্মৃতি, কতো গুঞ্জরণ।
ছেলেবেলা থেকে আমার সাধ ছিলো, আমার নিজের একটি ঘর হবে, সেখানে আমি আমার ভাবনা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে, অসম্ভব নিয়ে কাটাতে পারবো। আর বড়ো হয়ে যখন দেখলাম; আমরা কেউই ঠিক পরস্পরের নই, যখন আরো-একলা গহন-একলা হয়ে উঠলাম, তখন তো ওই ঘরই হয়ে উঠলো প্রিয়তম। তাইতো ঐ ঘরকে ফিরে পেতে চাই।
বলাবাহুল্য ওই স্বপ্ন-ঘরের চাবিটি এই বর্ণনার পর আর আক্ষরিক চাবি হয়ে থাকে না, পরিণত হয় মোহন প্রতীকে। আর ওই ঘরের প্রবেশের চেষ্টাটিও আর আক্ষরিক অর্থে ঘরে ঢোকার ব্যাপার হয়ে থাকে না।
বরং তার চিরকালীন স্বপ্নের কাছে, প্রত্যাশার কাছে, আশ্রয়-ভালোবাসা ও নির্ভরতার কাছে, প্রবল নিঃসঙ্গতায় একটুখানি স্বস্তি পাবার মতো বিষয়ের কাছে পৌঁছবার চেষ্টায় পরিণত হয়।
অধ্যাপক সাহেব কারো কাছেই চাবিটি খুঁজে পান না, বরং মুখোমুখি হন নানাবিধ বিরূপ অভিজ্ঞতার-তবে কি কেউ-ই সন্ধান দিতে পারে না সেই মোহন চাবির যা দিয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নলোকে প্রবেশ করতে পারবো? তবে কি এই খুঁজে বেড়াবার বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকবে কেবলই সন্দেহ অবিশ্বাস, জটিলতা, কূটিলতা?
গল্পের শেষে আমরা দেখি অধ্যাপক অবশেষে এসে পৌঁছেছেন পতিতাদের ঘরে। বলাবাহুল্য যে, চাবি এখানেও নেই। তবে এই মেয়েরা গল্পটিকে একটি নতুন মাত্রা এনে দেয়। তারা তার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তার আগ্রহ ছিলো না বলে তিনি যখন ফেরার পথ ধরলেন, তখন-
মেয়েরা বললো, যাচ্ছেন তাহলে? আমি উত্তর দেবার আগেই আরেকটি মেয়ে বললো, উনি তো চাবি খুঁজতে এসেছিলেন, যান, আপনার যখন চাবি নেই, তখন এখানে থেকে কি করবেন? চাবি পেলে আসবেন, এখানে কয়েকটি দরজা-বন্ধ-করা ঘর আছে।
আমরাও যে চাবি খুঁজছি গো...ওরা হাসছিলো, আমি ওদের জন্য মনে মনে কাঁদছিলাম। ওরা খিলখিল করে হাসছিলো, চাবি খুঁজছিগো মহারাজ। আমি মনে মনে হু হু করে কাঁদছিলাম চাবি খুঁজছি গো মহারাজ।
সারা গল্প জুড়ে কোনো চরিত্রই অধ্যাপকের চাবি খোঁজার মর্মার্থ ধরতে পারেনি, পেরেছে এই মেয়েগুলো, এবং বিষয়টিকে তারা আরো তীব্রভাবে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে, কারণ কারণ তাদেরও আছে 'কয়েকটি দরোজা-বন্ধ-করা ঘর' এবং তারাও খুঁজছে সেই মোহন চাবি। যেন আমাদের, এই সুবেশী নাগরিকদের চেয়ে তাদের বোধ অনেক তীব্র কারণ তারা অন্তত জানে, স্বপ্নলোকের সন্ধান তারা পায়নি, আর আমরা-তীব্র গতানুগতিকতায় আচ্ছন্ন, এই নাগরিক মানুষরা-তাও জানিনা।
'চাবি খুঁজছি গো মহারাজ' এই তীব্র আকুলতা ও হাহাকার তাই মানুষের সমস্ত না পাওয়াকে মূর্ত করে তোলে। গল্পের সেই অধ্যাপক শেষ পর্যন্ত চাবি খুঁজে পাননি-'আমি নিজের ঘরের বাইরে নির্বাসিত ও প্রবাসী থেকে এখনো দিনরাত সেই পুরনো ঘরের চাবি সন্ধান করে যাবো-এই আমার নিয়তি। ' -এবং আর কোনোদিনই তাঁর ফেরা হয়নি কাঙ্খিত স্বপ্নলোক।
জীবন হয়তো এমনই। স্বপ্নের পৃথিবী থেকে, প্রত্যাশা ও স্বপ্নপূরণ থেকে আমাদের অবস্থান বহুদূরে রয়ে যায় আজীবন।
তবু কী এক ঘোরে আমাদের দিন কেটে যায়। আমরা বেঁচে থাকি; কারণ আমরা বেঁচে থাকতে চাই। জীবনের চারপাশে এতসব নেতিবাচকতা, এতসব যুদ্ধ-দ্বেষ-হিংসা ও হানাহানি, এতসব সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা, এতসব মৃতু্য ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, তবু সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে আমাদের বেঁচে থাকার আয়োজন। আমাদের সবারই আছে একটি করে স্বপ্ন-ঘর, কিন্তু তালাবদ্ধ। আমরা তাই চাবি খুঁজে বেড়াই, আর মনে মনে কেঁদে উঠি- চাবি খুঁজছি গো মহারাজ, চাবি খুঁজছি গো মহারাজ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।