রিজওয়ানুল ইসলাম রুদ্র
আমাদের সবার জীবনেই কিছু বিষাদময় অভিজ্ঞতা থাকে, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে। এ সময়টা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমন আনন্দের। ছেলে-মেয়ে সবার ক্ষেত্রেই। এ সময় হাইস্কুলের বন্ধু-বান্ধব, স্যার-ম্যাডামদের আচার-আচরণ, বিরূপাচরণ নিয়েই আলোচনা-সমালোচনা হয় বেশি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছেন : তের-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো বালাই পৃথিবীতে আর নেই !
১.
তখন ক্লাস এইটে পড়ি।
দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা চলাকালীন সময় 'সিগনেচার শিট' বা 'হাজিরা কাগজে' সই করতে হয়। যেহেতু আমার রোল নং এক, তাই শুরুতেই কাজটা সারতে হয়। আমি স্বাক্ষর করলাম শুধু 'রুদ্র' দিয়ে, এ নামেই পরিচিত। সিগনেচার শিট পেছনের জনের কাছে পাস করলাম... মনোযোগ দিয়ে লিখছি, এমন সময় ডিউটিরত স্যার ( মুখে দাঁড়ি এবং পাঞ্জাবি পরা, হালকা-পাতলা চেহারা) আমাকে ডাকলেন।
চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। গায়ের পাঞ্জাবিও সম্ভবত ভিজে গেছে।
- তোমার নাম রুদ্র ?
- জ্বি স্যার আমিই রুদ্র।
-সিগনেচার শিটে 'রুদ্র' লিখলে ক্যানো ?
- তো কী লিখবো ? আমার নাম তো রুদ্র !
- 'রিজওয়ানুল ইসলাম' লিখলে সমস্যা কী ? হ্যাঁ ?
( পাশের স্যার কে লক্ষ্য করে) দেখছেন ! কী যে এক স্টাইল বের হইছে... মুসলমান নামের সাথে হিন্দু নামের মিকচার !
আমি দ্রুত ঘামছি। এই প্রচন্ড অপমান সহ্য করতে না পেরে বললাম -
- রুদ্র কোনো হিন্দু নাম না।
এটা বাঙালি নাম।
- ঐ বেশি বুঝো ! রুদ্র নামের মানে কী বলো দেখি...
- রুদ্র নামের অর্থ ঝঞ্ঝা, প্রচন্ড, তীব্র...
-রুদ্র নামের অনেক অর্থ আছে, এর আরেক অর্থ 'শিব'... ক্লিয়ার ?
- আমি পরীক্ষায় টাইম মেনটেইন করতে শুধু রুদ্র লিখেছি ! এটা তো দোষের কিছু না !
- কথা না বাড়িয়ে তোমার সিটে যাও। এইখানে রুদ্র কাটা দিয়ে 'রিজওয়ানুল ইসলাম' লিখো !
আমি স্যারের আদেশ পালন করলাম। পরীক্ষা বলে কথা ! শুধু সিগনেচার শিট পুনরায় জমা দেবার আগে তাকে একটা কথা বললাম -
আমি হেডস্যারের রুমে গিয়ে দেখে আসবো কোন স্যারের কোন দিন ডিউটি এই হলে। শুধু আপনার ডিউটির দিন আমি 'রিজওয়ানুল ইসলাম' আর বাকি দিনগুলোতে 'রুদ্র' লিখবো... ঠিক আছে ?
হুজুর স্যার আর কথা বাড়ালেন না।
কিছুক্ষণ লাল চোখে তাকিয়ে থেকে অন্য কাজে মন দিলেন !
২.
'শাপলাকুঁড়ি' প্রতিযোগিতায় গেছি। সেবার চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছি। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পর আবৃত্তি শুরু হলো। আমার ডাক পড়াতে উঠে দাঁড়ালাম। বিচারকদের আসনের সামনে আসলাম।
তিনজন বিচারক। তিনজনের মধ্যে একজনের মুখে গোঁফ আছে। কেমন যেন নিষ্ঠুর একটা ভাব। তিনি বললেন - নাম কী ?
- রুদ্র !
- শুধু রুদ্র ? এখানে তো রিজওয়ানুল ইসলাম লেখা আছে সাথে ! ( প্রতিযোগিদের লিস্ট বের করে )
- জ্বি। রুদ্র আমার ডাকনাম।
- শুধু ডাকনাম বললে ক্যানো ? বাপ-মা কষ্ট করে নাম রেখেছেন... আকিকা হয়েছিলো, নাকি তাও হয়নি !
- অবশ্যই হয়েছিলো !
- আকিকাতে গরু না খাসি জবাই হয়েছিলো !
আমি মনে মনে ভাবলাম, খাইছে রে ! ব্যাটা কয় কী !
- গরু।
-কয়টা গরু দুইটা না তিনটা ?
আবারো বললাম, ব্যাটা ফাজলামি করার জায়গা পাও নাই তুমি !
- দুইটা গরু !
- বাবাদু ইটা গরু ! বলো কী !
আমি বললাম, আপনিই তো জিজ্ঞাসা করলেন দুইটা না তিনটা !
যাই হোক, এরপর আবৃত্তি করতে লাগলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাসা' কবিতাটি। পাশের দুজন মনোযোগ দিয়ে আবৃত্তি শুনলেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধালেন সেই অতি বিজ্ঞ ( ! ) মহান বিচারক! বলে উঠলেন ( টেবিলে থাবড়া দিয়ে) স্টপ স্টপ ! যাও এখন !
আমি তারপরও আবৃত্তি পুরোটা শেষ করলাম।
গোঁফওয়ালা বললেন, তুমি কী করো ?
- জ্বি আমি একজন কবি। কবিতা লিখি।
- সেটা তো জিজ্ঞাসা করি নাই ! কোন ক্লাসে পড়ো ?
- নাইনে !
- ওকে। তুমি যাও।
আমি চলে আসলাম।
তারপর সেই বিচারক এক মেয়ে প্রতিযোগির ভয়াবহ কণ্ঠের আবৃত্তি শ্রবণ করলেন প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে !
কত বিচিত্র মানুষ-ই যে আছে এই পৃথিবীতে !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।