http://mdtarik.blogspot.com/ আমি বাংলায় ভালবাসি, আমি বাংলাকে ভালবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি...
এই পর্বটি পড়ার আগে প্রথম পর্ব থেকে শুরু করতে পারেন ... ...
পর্ব ০: প্রারম্ভিকা: আমার লেখার কারন ও আপনার অংশগ্রহণ
পর্ব-০১
-------------------------পর্ব ০২-------------------------------------
ছোট্ট সরু একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি আমরা... হাতের বাম পাশে খুব সুন্দর একটা মসজিদ, ডানপাশে একটা দোতলা লম্বা বিল্ডিং। আমরা গিয়ে পৌছলাম রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের সামনে, সেখানে লাগানো বিশাল তিনটি ফলক:
শরীয়তউল্লাহ হাউজ, শেরেবাংলা হাউজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাউজ।
বরিশাল ক্যাডেট কলেজের খ্যাতনামা শিক্ষক মোল্লা স্যারের ছেলে ইমন ভাই ছিলেন আমার গাইড। তিনি নিয়ে গেলেন আমার নতুন ঠিকানায়: রুম নং ১২৭, শরীয়তউল্লাহ হাউজ... গিয়ে দেখি আমার রুমমেট আমার অতি পরিচিত বন্ধু রাজিব, দুজন একত্রে কোচিং করতাম জিলা স্কুলের এনামুল হক স্যারের কাছে । দুই গ্রুপের বাবা-মাই বেশ খুশি, মিলেমিশে থাকবা তোমরা, ভালই হইছে দুজন একই রুমে পরেছ।
ভর্তি পরীক্ষায় আমার ইনডেক্স নম্বর ছিলো ১২০৮৫, রাজিবের ১২০৮৪। এখানে এসে আমার ক্যাডেট নম্বর হল ১১৮২, ওর ১১৮১। ইমন ভাই আমার বিভিন্ন জিনিসপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, তারপর আমার সাদা শার্টটার ডানপাশে লাগিয়ে দিলেন কালো একটা নেমপ্লেট, যেখানে লেখা রয়েছে "তারিক"; আমার অতি প্রিয় "মিঠু" নামটা যে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে সেটা তখনো বুঝতে পারিনি, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আরও প্রায় ১৫/২০ দিন পরে। এরপর নাস্তা, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব ইত্যাদির পরে বাবা মায়ের বিদায়ের পালা।
আমার কেন যেন সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি, কিন্তু শুধু ছোটবোনটার জন্যে... আম্মুর জন্যে একটু কষ্ট লাগছিল, কারন আম্মু অনেক সখ করে নিয়ে আসা কাঁথাটা আমাকে দিয়ে যেতে পারেননি, তবে কষ্টটা আম্মুর জন্যে লেগেছিল নাকি কাঁথাটার জন্যে- সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কারন আমি আবার কাথা ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না।
তবে আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে যখন হাউজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম, সে এক করুন দৃশ্য... আমার অধিকাংশ হবু বন্ধুই কাঁদছে, কাঁদছেন স্নেহময়ী মায়েরা... আড়ালে চোখের পানি মুছছেন বাবারা... সৌরভের ছয় বোনের সে কি কান্না... কারন ও ছিল ছয় বোনের আদরের ছোট ভাই...
সবার কান্নাকাটি দেখে আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম আমার বাবা-মায়ের অবস্থা দেখার জন্যে। মায়ের মুখটা মলিন, চোখে পানি আছে কিনা সেটা দূর থেকে বুঝতে পারিনি... তবে বাবা যে হাত দিয়ে চোখের কোণাটা মুছছেন- সেটা দেখতে পেলাম স্পষ্ট। বাবার সেই কান্নার অর্থ সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারি... ওটা কষ্টের কান্না ছিলো না, ওটা ছিলো আনন্দের... কিসের আনন্দ? চলুন ঘুরে আসি ১৯৭১... যখন বাবা ছিলেন সদ্য ক্লাস সেভেন...
আমার বাবার বয়স মাত্র ১২/১৩, সবে ক্লাস সিক্সে পড়েন। যতটুকু জানি, বেশ ভাল ছাত্র ছিলেন আমার বাবা। দাদার স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় অফিসার হবে।
কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, ৭১-এর শুরুতেই পাক দস্যুদের হাতে নিহত হলেন আমার দাদা... এরপর শুরু হল আমার বাবার জীবন যুদ্ধ... সৎ মায়ের সংসার, আমার দাদু একটু বোকাসোকা ছিলেন, তাই সংসার চালাতেন আমার ছোট দাদু। চাচা- চাচীদের অবহেলা, অত্যাচার এসবের মাঝে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সহযোগীতায় কোন রকমে HSC পাস করেন তিনি... দিনের বেলা চাকরি করেছেন, রাতে পড়েছেন নাইট কলেজে- এমনই কেটেছে সময়... দাদার সহায়সম্পত্তির মোটেই কমতি ছিল না, কিন্তু শুধুমাত্র একজন বুদ্ধিমতি মায়ের অভাবে সেগুলো সেসময় ভোগ করার সুযোগ হয়নি আমার বাবার ... অনেকদিনই পেটপুড়ে খেতে পারেননি... পড়াশুনাতো অনেক পরের কথা... সেই বাবার ছেলে আজ ক্যাডেট কলেজের মত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাচ্ছে এটা ছিল তাঁর কাছে স্বপ্নের মত... কল্পনারও অতীত... তাই হয়ত বাবা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি...
আসলে "সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত" - এই বাক্যটির এক স্বার্থক প্রমাণ আমার বাবা, ক্লাসের বই কিনে পড়তে পারতেন না... নতুন জামা-কাপড় হয়ত ছিল না, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন জ্ঞান রাজ্যের এক নীরব প্রজা... বরিশাল পুরাতন পাবলিক লাইব্রেরি ছিল জ্ঞানের সেই রাজদরবার... বাবার অনেক লেখাও তখন প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়...
সেই বাবার ছেলে আমি যাচ্ছি এক নতুন জগতে... পিছনে বাবা-মা, আদরের ছোটবোন... সামনে ক্যাডেট কলেজ... মাঝখানে হাটছি আমি এক কিশোর... কি ছিলো আমার সেদিনের অনুভূতি- সেটা সঠিক করে বলতে পারব না... তবে এতটুকু জানি, সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি যতটা লেগেছিল পরবর্তী ক্যাডেট লাইফে, যতটা লাগে এখন... [চলবে]
------পরের পর্বগুলি------
পর্ব -০৩
পর্ব -০৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।