আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেখানে সাগর মহাসাগরের মেলা


আড়াইশো কিলোমিটার বাস যাত্রা শুরু হলো। সুন্দর রাস্তা। কিছু পাহাড়ি এলাকা সেজন্য রাস্তাও বেশ আঁকাবাঁকা। সামনে বিশাল বিশাল গাছের জংগল। জানতে পারলাম, এগুলি কাউরি গাছ।

খুবই দামি এবং বিরল প্রজাতির গাছ। কাউরি ফার্ণিচারের অনেক দাম!পনের মিনিটের জন্য গাড়ি থামলো। সবাই নেমে গাছ দেখতে শুরু করলো। আমি গাছ পালা কিছু বুঝি না। সব গাছই একইরকম লাগে আমার কাছে।

লোকজনের কি উৎসাহ এসব ব্যাপারে। তবে বিরাট বিরাট উঁচু উঁচু গাছ দেখতে ভালই লাগছিল। এই গাছগুলো নাকি হাজার বছরের হয়! দুনিয়ার অন্য কোথাও নাই। হতেও পারে। সূর্য দেখা যায় না, এত অন্ধকার ভিতরে।

গাছপালার ভিতর দিয়ে খুব সুন্দর পথ করা যাতে মানুষজন কাছে গিয়ে দেখতে পারে। পন্চাশের দশকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন এসেছিলেন তখন এই পথটা করা হয়েছিল। কাউরি গাছ দেখা শেষ হলে বাসে উঠলাম। উঠানামা করে খিদা লেগে যাচ্ছে। কখন বাস থামবে খাওয়ার জন্য, সকালে কেউ খাইনি।

এদিকে গাইড বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে কিভাবে এখানে জনবসতি গড়ে উঠলো, কারা প্রথম এখানে এসেছিলো। অবশ্যই মাউরিরা আগে এসেছিলো। ধারণা করা হয় যে জায়গায় প্রথম মাউরি অষ্টম শতাব্দীতে নৌকা নিয়ে এসেছিল সে জায়গার নাম হলো টে পাই। সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য বাস থামলো সেখানে। আমরা কফি আর সান্ডুয়িচ কিনলাম।

সমুদ্রের পারে খোলা জায়গায় টেবিল চেয়ার রাখা। আমরা অনেক ভিডিও করলাম। কিন্তু বাতাস বেশী লাগছিলো। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো আগের দিনের মানুষের কত কষ্ট করে যাওয়া আসা করতে হত। নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় ছিল না, তাও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি নৌকা দিয়ে।

চিন্তা করলেই কেমন অস্হির লাগে। মনে হয় এখনই পানিতে ডুবে যাব! আমরা পাহিয়াতে মাউরিদের পুরোন আমলের নৌকা দেখেছি। অনেকটা আমাদের নৌকা বাইচের নৌকার মত লম্বা ধরণের! কিছু ছবিও তুলেছিলাম, যথারীতি পাচ্ছিনা। এই ছবিগুলো মোবাইল ফোনে তোলা। ডিজিটাল ক্যামেরার ছবি আপলোড হচ্ছে না।

চল্লিশ মিনিট পরে বাস আবার চলতে শুরু করলো। গাইড অনেক মজার মজার কথা বলছিলো। রাস্তার পাশে ঘর বাড়ি খুব একটা নাই। এমনিতে সারা দেশে লোক সংখ্যা চার মিলিয়ন। তার মধ্যে উত্তরে খুব কম লোকই থাকে।

দুই তিন জেলা মিলিয়ে পন্চাশ হাজার হবে কিনা সন্দেহ! যাইহোক সাদারা অনেক বড় বড় ফার্ম/অরচার্ডের মালিক। বিভিন্ন মৌসুমি/সব্জি ফলের বাগান। আর আছে আংগুর বাগান। যা দিয়ে অত্যন্ত দামি ওয়াইন বানানো হয়। যেগুলি আবার বিদেশে বিক্রি করা হয়।

রাস্তা থেকে বুঝা যায় না ভিতরে ভিতরে এত কিছু হচ্ছে। কোন দোকান পাট নাই। কাছের দোকান বা মার্কেটে যেতে হলে তিন ঘন্টার ড্রাইভ। এখানকার বড়লোকেরা সাধারণত ছোট ছোট প্লেনে করে যাওয়া আসা করে। ওদের নিজেদেরই এয়ারস্ট্রিপ আছে।

কি দারুণ, আমার শুনেই কি ভাল লাগছিলো, দুনিয়া কোথায় আর আমরা কোথায়! মনে মনে ভাবলাম যদি কখনও এমন অরচার্ডের মালিক হতে পারতাম। দিবাস্বপ্নেরও একটা সীমা থাকা উচিৎ! আস্তে আস্তে কেপ রিয়াংগার কাছে চলে আসলাম। জায়গাটা অনেক আগে মাউরিদের কবরস্হান হিসেবে ব্যবহৃত হত। সেই পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য এখনও ওখানে কোন খাওয়া দাওয়া করা নিষেধ। শুধু পানির বোতল সাথে নেওয়া যাবে।

বাস থামলো প্রায় এক কিলোমিটার দুরে, বাকিটা হেঁতে যেতে হবে। সমুদ্র থেকে অনেক উঁচুতে। রাস্তা পাকা করা হচ্ছে, কাজ চলছে। লম্বা মত জায়গা, সরু হয়ে গেছে। শেষ মাথায় বাতিঘর, ওখানে দেয়াল ঘেরা আছে, যাতে লোকজন উপর থেকে নিচে দুই সাগরের পানিতে পরে না যায়! মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায়।

খালি পানি আর পানি। প্রশান্ত মহাসাগরের পানি কি শান্ত, কোন উঁচু ঢেউ নাই, ছোট ছোট তরংগ। আর তারপাশে টাসমান সাগর, কি উত্তাল ঢেউ মনে হয় আগ বাড়িয়ে ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত!তার পানি হালকা সবুজ, আর প্রশান্তের পানি কালচে নীল। যেখানে দুই সাগর মিলে গেছে স্পষ্ট বুঝা যায়, একটা দাগের মত দেখা যায় সত্যি! কি যে অদ্ভুত লাগছিলো, জীবনে এরকম কখনো দেখিনি। অকল্যান্ডের বীচে অনেক বার গেছি, মানে প্রশান্ত মহাসাগর আমাদের পরিচিত, কিন্তু এখানে এসে তার প্রশান্তিটা নতুন করে অনুভব করলাম।

এই দেশটা প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্হিত, কোন জলোচ্ছাস হতে দেখিনি, কোন শহর তলিয়ে যায় না। খালি জোয়ার ভাঁটার সময় নিয়মিত পানির উঠা নামা! কত যে লোকজনের আনাগোনা। সবাই হাসিখুশি, ছবি, ভিডিও তোলা হচ্ছে। আমরাও কয়জনকে বলে আমাদের একসাথের কিছু ছবি, ভিডিও তুললাম। সাধারণত বাবু আমার আর মেয়েরটা তুলে আর আমি ওদের, মেয়ে আবার আমাদের দুজনকে তুলে।

তিনজনের একসাথে তুলতে হলে বাইরের লোককে বলতে হয়! অনেক সময় লোকজনকে বলতে লজ্জা লাগে। যাইহোক ঘন্টাখানেক পরে ফেরার পালা। এবার বাস অন্যরাস্তা দিয়ে ফিরবে। নাইটি মাইল বীচ দিয়ে ফিরবে। মানে হলো পুরোটা বীচই রাস্তা! আমরা শুনেই খুব খুশি।

বাস চলা শুরু করল। ভাঁটার সময় সে জন্য বালির উপর দিয়ে বাস যাচ্ছে, আমরা চাচ্ছিলাম পানি দিয়ে যাক। সেটা হলো না। ডেভিড (গাইড/ড্রাইভার) ভয় পেল যদি পানিতে কুইক স্যান্ড থাকে তবে বাস আটকে যাবে আমাদের আর পাহিয়া ফেরা হবে না! কিছুক্ষণ পরে বাস থামলো একটা চিপা জায়গায়। বীচের একধারে বালির উঁচু ঢিবি।

ঢিবি বলছি আসলে বালির পাহাড়! আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, এখানে মরুভূমির মত বালির পাহাড় কিভাবে হলো! সবাই বাস থেকে নেমে পড়লাম। ডেভিড বাসের ভিতর থেকে বেশ কিছু স্যান্ড বোর্ড বেড় করলো। যারা যারা বোর্ডিং করতে চায়, সেগুলো নিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আমার মেয়েটাও সব কিছুতে আগে আগে। উফ্‌ কি যে রোদ, মাথা ধরে যাচ্ছিল আমার, আমি গিয়ে বাসে বসলাম।

শুধু মেয়ের ছবি উঠানোর জন্য বাইরে গেলাম কয়েকবার। অপেক্ষা করছিলাম কখন বাস ছাড়বে, সারাদিন ধরে ঘুরে আর ভাল লাগছে না। খালি মনে হচ্ছে কখন লজে পৌছাব। আমাদের অস্হায়ী আবাস। প্রায় এক ঘন্টা পরে আবার বাস চলতে শুরু করলো।

বীচটাই রাস্তা হয়ে গেছে। কেউ কোথাও নাই, খালি আমাদের বাস চলছে। সাড়ে ছয়টার দিকে পাহিয়া পৌছে গেলাম। তাড়াতাড়ি লজে ঢুকে গোসল সেরে খেতে চলে গেলাম। আবার সেই গতরাতের মত বারবিকিউ, কিন্তু আজ আর ওত মজা লাগলো না।

খালি মনে হচ্ছে একটু ভাত তরকারি থাকলে ভাল হত। বাইরে খেতে যেতে পারতাম,ইচ্ছে হলো না, ভীষণ টায়ার্ড। গপ গপ করে খেয়ে, ঘরে এসে শুয়ে পরলাম। মাঝরাতে বাবু এসে ঘুম ভাঙালো। কি ব্যাপার, দূর বেড়াতে এসে এত ঘুমালে চলে, চল বীচের ধারে হেঁটে আসি।

বাবা মেয়ে দুজনেই রেডি, আমি আর বাকি থাকি কেন! পাহিয়াতে আমাদের শেষ রাত, সকালে উঠে বাসায় রওনা দিতে হবে। সবাই মিলে পাহিয়ার বীচে হাঁটলাম। ঠান্ডা বাতাসে শরীর মন জুড়িয়ে গেল। কি পরিষ্কার আকাশ, সব তারা দেখা যাচ্ছে। কোন মেঘ নাই।

আবার কবে আসব, কে জানে, আদৌ এখানে আসা হবে কিনা! মন চাইছে আবার আসতে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.