কর্মময় জীবনের ক্লান্ত মন নিয়ে বারান্দায় বসেছিল জহির। কি এক মৌন নিথর নিস্তব্ধ স্বপ্নলোকে মন তার ভেসে বেড়াচ্ছিল যেন রক্ত ফানুস। মরা বিকেল, সূর্যের পা সবে দিনান্তের দারে। বারান্দা ঘেষে কামরাঙ্গা গাছের ছায়া দীর্ঘ সীমানার চৌহাদ্দী ছাড়িয়ে শুকনো খালে গিয়ে পড়েছে, ঠিক কোন বরাবর সীমায়িত করা যাচ্ছেনা। বিদায়ী সূর্যের ব্যথিত চুম্বনে হৃদয় কাঁপছিল থর থর হৃৎপিন্ডের ওলট পালট মোচড়ে।
জীবনের পরিসংখ্যানে জহির আজ নিজেকে দেখে বড় বিরক্ত, অসহায় যেন এতিম কাঙাল। হ্যাঁ, সত্যিই তার কেউ নেই। রোকেয়া, বাবা মা, সন্তান কেউ না। পাকি নরখাদকদের বিষাক্ত থাবায় আজ তারা খুন রন্জিত মাটি। সে নিজে খোড়া জহির।
ক্ষণিকের জন্য জহির পিছন ফিরে তাকায়। ম্লান পৃথিবীর দিকে চেয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আমাদের দাবী..আমাদের দাবী... মানতে হবে...মানতে হবে....'
নরেন, নরেন?
জি স্যার?
আমার ক্রেসটা?
পড়ে যাবেন তো স্যার, আহ- কোথাও লাগেনি তো....স্যার?
না। নরেন, বাবা, রাস্তার জানালাটা খুলে দেতো। বড় ভাল লেগে যায় জহিরের।
দেয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে তাকায়। বাঁধান আল্ট্রাসনো ইমেজ। লোয়ার এবডমিন। এম্বায়োর ফটোগ্রাফিক কাল ইমেজ। বোঝা যাচ্ছে না ছেলে না মেয়ের অবয়ব।
বুকফাঁটা কান্না আসে জহিরের। ১০ মার্চের (১৯৭১) সপ্তাখানেক আগের ছবি। তার পর অদ্যাবধি গল্পই বটে।
রোকেয় মেডিসিন কর্ণার। বেচা কেনা মোটামুটি।
ড্রাগিষ্ট হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা জহির ওয়েল-নোন। একার সংসার। চলে... চলে যায়। সরকারী লোকজন তার যুদ্ধের কাগজপত্র নিয়ে গেছে সেই কবে। ভাতাও একদিন পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
তখন বেঁচে থাকলে সংসার আরও ভালভাবে চলবে। একটু পিছনে ফিরে যাই... রোকেয় তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিলসফির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। জহিরও একই ফ্যাকাল্টির পাবলিক এইডের শেষ বর্ষের ছাত্র। রাজনৈতিক সূত্রে ওদের পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা।
প্রেম, প্রণয় এবং বিয়ের রাখি। রাজনীতিতে ওরা স্বেচ্ছায় আসেনি। অধিকার আর নীতির প্রশ্নে রাজনীতি ওদের আবিষ্ট করেছে।
আর একটু পিছন ফিরে তাকাই। যদ্দুর মনে পড়ে ১০ মার্চ, (১৯৭১)।
৬ নং সেক্টরের ডইং কমান্ডার আবুল বাসারের নেতৃত্বে জহির সম্মুখ যুদ্ধে পা হারায়। ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির কথা শুনে জহির নিজভুমে ফিরে আসে। মুক্তিসেনার পিতা মাতা এই অপরাধে আব্বা আম্মা খানসেনা কর্তৃক নিজভূমে নৃশংসভাবে হত্যা হয়। অন্তঃসত্বা রোকেয়া নরপিশাচ কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে । বাড়ীতে এসে এসব কথা শুনে পাথর হয়ে গিয়েছিল জহির।
এই নরেনের বাবা নবীন কৃষক, লাঙল ধরা শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে জহির কে বলেছিল স্বাভাবিক হতে.....
খোড়া জহির তখন কাঁদেনি। মুক্তিযোদ্ধা জহির তখন দুহাতে বাংলার ধুলা নিয়েছিল মাথায় তুলে- মাতৃভূমিকে সমুন্নত করেছিল পরম শ্রদ্ধা ভরে। আজ নীতি, রিতি, যুদ্ধ, যুক্তি, রাজনীতি জহিরের কাছে মিথ্যা, তুচ্ছ একতরফা মনে হয়। বুক ফাঁটে কান্না আসে......
কখন যেন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাত নেমে গেল। অষ্টাদশীর পূর্ণ চাঁদ আলো ছড়াল, তার চোখ দেয়ালের ছবি থেকে পাশের জানালার কক্তজবা'র উপর নিবদ্ধ হল ।
রোকেয়া সমাধিতে খুনরাঙা রক্তজবা হয়ে কাঁদছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।