কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাসে দ্বারে করে কশাঘাত
কতই না বৈচিত্রে ভরা এ পৃথিবী! একদিকে মানুষ বসতবাড়ীর জন্য ঊর্ধ্বালোকে নতুন পৃথিবীর সন্ধানে ব্যস্ত, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শীর্ষে উন্নত জাতির একাংশ আধুনিক ছোঁয়া থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে অবস্থিত। কানাডার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩.৩ ভাগ জনগোষ্ঠী আজও আদিবাসী বা ফার্স্ট নেশন (First Nation) নামে পরিচিত। নানান অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও মাদকাসক্তে জর্জরিত এ মানবগোষ্ঠীর জীবন যাত্রা কতই না রহস্যে ভরা! মুক্ত দেশের এই জনগোষ্ঠীর নিত্য দিনকার আচার-অর্চনা কতগুলো পৌরাণিক কাহিনীর বন্ধনে আবদ্ধ । হাজার হাজার বছর আগের আটটি বৈসাদৃশ্য গল্পের উপর আটটি গ্রুপের উৎপত্তির কল্প-কথা আজ পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। সেগুলো ডুবুরী পৃথিবী, বিশ্বের মাতা-পিতা, নির্গমন, দ্বন্দ্ব, ডাকাতি, পু্নর্জন্ম, দুই স্রস্টা ও তাঁদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবং ভ্রাতা নামে পরিচিত।
‘ডুবুরী পৃথিবী’ বা ‘আর্থ ডাইভার (Earth Diver)’ এর পৃথিবী সৃষ্টি সংক্রান্ত বিশ্বাসটি এরকম, অনেক আগে এ জমিন পানি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। সৃষ্টিকর্তা ‘নাপি (Napi)’ একদিন জানতে চাইলেন কি ঘটে চলছে পানির নিচে। প্রথমে তিনি একটি হাঁস, পরে একটি উদ্বিড়াল আরো পরে একটি বেজী পাঠালেন, কিন্তু সবাই শুন্য হাতে ফিরে এল। সবশেষে তাঁর আদেশে একটি মুশিক ডুব দিয়ে পানির গভীরে গিয়ে অনেকক্ষণ পর থাবায় করে কিছু কাদামাটি নিয়ে ফিরে এল। স্রষ্টা ‘নাপি’ লণ্ঠন হাতে নিলেন, ফুঁ দিতে থাকলেন যতক্ষন না কাদামাটিটুকু শুষ্ক হয়।
পরে শুকনো এই এক টুকরো কাদামাটিকেই নাপি পৃথিবীতে রূপান্তরিত করলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি পাহাড় বানালেন, আকৃতি দিলেন নদ-নদী, খাল-বিল আরও কত কিসের! মাটি থেকে পয়দা করলেন মানব-মানবী, শেখালেন বেঁচে থাকা ও শিকার করার কায়দা কানুন। একদিন নাপি ভাবলেন, তাঁর কাজ বুঝি শেষ। তাই তিনি পাহাড়ের উঁচু চুঁড়ায় উঠলেন এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে বারোটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফার্স্ট নেশন, ইনোয় (Inuit) ও মেটিই (Metis) প্রায় পঞ্চাশটি দূর্বোধ্য ভাষা বহন করে চলেছে।
সাগর ও নদীতে মাছ এবং বনাঞ্চলে প্রাণী শিকার এদের প্রিয় নেশা। হিমাংকের চল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও বরফের উপর পুরোটা দিন দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারে একটি মাত্র স্যামন মাছ শিকারের আশায়।
গুচ্ছ গুচ্ছভাবে বিভক্ত হয়ে এসব আদি বাসীরা নদী বা সাগরের উপকূলে বসবাস করতে পছন্দ করে। জীবনের সমস্ত ঘটনা প্রবাহ এরা প্রকৃতির গাছ-পালা, জীবজন্তু ও শক্তির সাথে একীভূত করে ফেলে। কাক, পেঁচা, গরু, বাছুর, রক্ত, লতা-গুল্ম, গাছ পালা ইত্যাদি নিয়ে পৌরোনিক কাহিনীই তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি।
আর এটি চলে আসছে বংশ পরম্পরায় মৌখিক গল্পের মাধ্যমে হাজার বছর ধরে। এদেশের প্রতিটি সরকারই এই জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় আনতে চেষ্টা ও প্রচুর অর্থকড়ি ব্যয় করলেও ফলাফল খুব বেশী যে সন্তোষজনক তা কিন্ত নয়।
কানাডার নতুন প্রদেশ পৃথিবীর উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত নুনাভাত (Nunavut) এর পঁচাশি শতাংশেরও বেশী মানুষ ফার্স্ট নেশন বা আদি মানুষ। সরকার এদের আহার, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সিংহভাগ বহন করলেও এরা হীম-শীতল ওই প্রদেশে শিকার ও নেশা নিয়েই ব্যস্ত। মিশে যেতে চায় না সভ্য মানুষ বা তাদের ভাষায় ‘দখলকারীদের’ সাথে।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা এদের সাথে তাদের রক্তের সম্পর্ক দাবী করে। আফ্রো-এশীয় ইতিহাসবিদরাও বলে থাকেন পৃথিবীর বর্তমান ভৌগোলিক বিবর্তনের আগে আমেরিকার সাথে জলাশয়ের উপর ছোট্ট একটি সেতু দ্বারা আফ্রিকীয় ও এশীয়দের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ ছিল। ফার্স্ট নেশন বা জনপ্রিয় অথচ বিতর্কিত শব্দ ‘রেড ইন্ডিয়ান’ কিন্তু তাদের সব দাবীই অস্বীকার করে বলে, ঈশ্বরের এই ‘পবিত্র’ ভূমিতেই তাদের উৎপত্তি। আর এটিই আজ দখলীকৃত হয়েছে ইউরোপীয় অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা।
পৃথিবী এ জাতি সমন্ধে প্রথমে কবে জানতে পেরেছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ।
আমেরিকা ও কানাডার টেক্সট বইয়ে কলম্বাস পূর্ব যুগ নিয়ে ছাত্রদের মোটেই পড়ানো হয় না। কলম্বাসের কথিত আমেরিকা আবিস্কারের বছর ১৪৯২ সালের পূর্বের সত্যিকার ইতিহাস ধামাচাপা দিতেই পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের এই অপকৌশল। কলম্বাসের দল কর্তৃক নেটিভদের পাইকারী গণহত্যা ও ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের দ্বারা নির্বিচারে মুসলিম নিধনযজ্ঞের নির্মম সত্য ইতিহাস থেকে ছাত্রদের ভুলিয়ে রাখতেই ইতিহাসবিদরা এসময়কে আখ্যায়িত করেছেন প্রি-কলম্বিয়ান যুগ হিসেবে। ঐতিহাসিকদের এই চৌর্যবৃত্তির গোড়া পত্তন হয় মূলত রাজা ফার্দিনান্ড এবং রানী ইসাবেলার নেতৃত্বে পনের শতকে মুসলিম ধ্বংসযজ্ঞের অব্যবহিত পরই।
কলম্বাসের পাঁচশ বছর আগে নবম শতাব্দীতে এ অঞ্চলের সন্ধানে প্রথম একদল ভ্রমণ বিলাসী মানুষ আসেন স্পেনের তৎকালীন খলিফা আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (৮৮৮ - ৯১২) এর শাসনামলে।
‘দি মেডোস অব গোল্ড এন্ড কোয়ারিস অব জুয়েল্স (The Meadows of Gold and Queries of Jewels)’ গ্রন্থের লেখক আল মাসুদি (৮৭১ - ৯৫৭) লিখেছেন, কর্ডোভার মুসলিম নাবিক খাস্খাস্ ইবনে সাঈদ ইবনে আসওয়াদ ৮৮৯ সালে স্পেনের ডেলবা (Delba) বা বর্তমানের প্যালস (Palos) থেকে জাহাজে পাল তুলে আটলান্টিক পার হয়ে ‘আরদ্ মাজহুলা’ (Ard Majhoola) বা ‘অজানা দুনিয়া’ (অর্থাৎ বর্তমানের আমেরিকা)-য় এসে পৌঁছেন এবং ফিরে যান ‘চমকপ্রদ ধনরত্নরাজি (Fabulous Treasures)’ নিয়ে। দশম শতাব্দীতে আব্দুর রহমান দ্বিতীয় (৯২৯- ৯৬১) এর শাসনামলে দ্বিতীয়বারের মত একদল আফ্রিকীয় মুসলিম আবারও ‘কুয়াশায়ভরা অন্ধকার মহাসাগর’ এ পাল তোলেন স্পেনের এই ডেল্বা বন্দর থেকেই। দীর্ঘ সময় অবস্থান করে তারা স্পেনে ফিরে যান ‘অদ্ভুত ও রহস্যময় দুনিয়া’ আবিস্কারের অজানা কাহিনী নিয়ে।
আমেরিকা আবিস্কারের কথিত জনক কলম্বাস ১৪৯২ সালের ৩রা আগষ্ট মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সদ্য বিজিত ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সহযোগীতায় সারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ব্বব্যপ্তির অংশ হিসেবে জাহাজে পাল তোলেন কিন্তু দুর্ঘটনাবশত, নতুন দুনিয়া বা আজকের আমেরিকায় তাঁর জাহাজ নোঙ্গর করে। মজার ব্যাপার হল, তিনি পাল তুলেছিলেন স্পেনের ওই একই বন্দর ডেলবা থেকেই।
যার সাথে কিনা ভালভাবে পূর্ব থেকেই আমেরিকার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পূর্বসুরী মুসলিম নাবিকদের উদ্ভাবিত একই মানচিত্র এবং আপন নাবিক ভাইয়ের সাহয্যের ফলে কলম্বাসের যাত্রা পথটি সহজসাধ্যও হয়। পাল উড়ান ক্যানারী আইল্যান্ড এবং গোমেরা মুখী। ‘গোমেরা’ শব্দটি আরবী থেকে নেয়া যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র জলন্ত কাষ্ঠখন্ড’। সেখানে পৌঁছে কলম্বাস প্রেমে পড়েন আইল্যান্ডের প্রথম ক্যাপ্টেন জেনারেলের কন্যা বিয়াট্রিয বোবাদিল্লার (Beartriz Bobadilla) সাথে।
পারিবারিক নাম ‘বোবাদিল্লা’ আরবী ইসলামী নাম ‘আবু আব্দিল্লাহ’ থেকে উদ্ভূত, যার সূত্র আব্বাসীয় (১০৩১ - ১০৯১) শাসনকর্তার পরিবার পর্যন্ত। ফ্রান্সিস্কো বোবাদিল্লা পরে কলম্বাসকে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলেন এবং স্পেনের সান্তো ডোমিনগো (Santo Domingo) তে ফেরত পাঠান ১৫০১ সালের নভেম্বর মাসে।
১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর কলম্বাস বাহামার যে ছোট ভূ-খন্ডটিতে নেমেছিলেন তা আদিবাসীদের নিকট ‘গুয়ানহানি (Guanhani)’ নামে পরিচিত ছিল। এ শব্দটি মানডিন্কা (Mandinka) এবং আরবীর অপভ্রংশ। ‘গুয়ানা’ (মুল ইখ্ওয়ানা)- র অর্থ ‘ভাই’ এবং ‘হানি’ হল একটি আরবী নাম।
আইল্যান্ডটির মুলনাম ‘হানিভ্রাতা (Hanibrother)’ পরিবর্তন করে কলম্বাস এর পূণঃনামকরন করেন ‘সান সাল্ভাদর (San Salvador)’। কলম্বাস এই গোষ্ঠী বা নেটিভদের সম্মন্ধে লিখেছেন, তাদের কোন জাত ধর্ম নেই। শান্তি প্রিয় এ জাতিকে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে হলে অবশ্যই শক্তির বদলে ভালবাসার মাধ্যমে করতে হবে। ইতিহাসের সম্ভবত সবচে’ কপটতর কাজটি তিনি এভাবেই সুচতুরতার সাথে সমাধা করেন। অথচ ওই একই সময়ে ঐ অঞ্চলে আরো একটি উপদল ‘আলমামী (Almamy)’ নামে মুসলিম আদিবাসী বসত করে আসছিল।
‘আলমামী’ শব্দটিও মানডিন্কা এবং আরবী শব্দের সংমিশ্রন যার মুল ‘ইমাম’ বা ‘আল ইমামু’। উল্লেখ্য, মুসলমানদের অন্যতম প্রধাণ উপাসনা নামাজ পরিচালনাকারীকে অথবা গোত্রের প্রধানদেরকে ‘ইমাম’ বলা হয়।
প্রখ্যাত আমেরিকান ঐতিহাসিক হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের লিও উয়েনার (Leo Weiner) ১৯২০ সালের প্রকাশিত ‘আফ্রিকা এন্ড দি ডিসকোভারী অব আমেরিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, কলম্বাস ভালভাবেই অবহিত ছিলেন ‘নতুন দুনিয়া (New World)’-য় মানডিন্কাদের উপস্থিতি। তিনি এও জানতেন উক্ত ভূ-খন্ডে বহু পূর্ব থেকেই পশ্চিম আফ্রিকীয় মুসলিমরা ব্যবসা বাণিজ্য এবং ইরোকয় (Iroquois) ও আলগোনকোয়িন (Algonquin) আদি গোত্রদ্বয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে ক্যারিবীয়, কেন্দ্রীয়, দক্ষিণ এবং উত্তর আমেরিকায় কানাডাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়ে আছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আজও তাদের পাথরে খোদাই করা শিলালিপি বিদ্যমান যাতে ‘ইয়াসুস ইবনে মারিয়া (Yasus Ibn Maria)’ অর্থাৎ ‘Jesus (Son) of Mary’ লেখা রয়েছে যেটি পবিত্র কুরআন থেকে নেয়া ‘ইসা (আ মরিয়মের পুত্র’।
সত্যের অনুসন্ধানে ব্রতী ইতিহাস পিপাসুরা আজ ইতিহাসের অজানা বা মিথ্যার কালো প্রলেপে আচ্ছাদিত অধ্যায়কে মানুষের সামনে নতুন করে উন্মোচন করছেন। সাম্প্রতিক কালের সাড়া জাগানো চিন্তাবিদ আফ্রো-ক্যারিবীয় আদি বংশোদ্ভূত ড. আবদুল্লাহ্ হাকিম কুইকের ‘ডিপার রুটস ( Deeper Roots)’ গ্রন্থ এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
এসব সত্ত্বেও, গেভিন মেনযিস (Gavin Manzies) এর মত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদগণ ইতিহাসের সত্য প্রবাহের উৎস বন্ধ করার জন্য বলে থাকেন, হাঁ আমেরিকা ঠিকই কলম্বাসের পূর্বে আবিষ্কৃত হয়ে থাকতেও পারে, তবে তা নির্ঘাত হয়েছে কেবলমাত্র চীনা জাতির দ্বারা!
[লেখাটি মাসিক পত্রিকা 'অন্য দিগন্ত' এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।