চোখ মেলে দেখি জানালায় ভোরের পাখি
ভেবেছিলাম কিছুদিন আর নস্টালজিক লেখা লিখবনা। এক ধরনের লেখা লিখতে লিখতে আমি নিজেই খানিকটা বিরক্ত। নতুন কিছু লেখার চাই। চাই বটে কিন্তু পারিনা। বাবার চাকুরীসুত্রে বগুড়ায় থাকা এক অচেনা ব্লগার আবারও ছুটির দিনে আমাকে নস্টালজিক করে দিয়েছে।
আজ খুব মনোযোগ নেই। শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া কিংবা উপমা আর ব্যঞ্জনার সমাহার ঘটানোর চেস্টা চালানোতে কোন তাড়না নেই। কেবল প্লাস্টিকের শক্ত চেয়ারে যতটা পারা যায় আরাম করে পিঠ ঠেকিয়ে দু কথা মনে করার চেস্টা। মহাস্থানগড়ের পাদদেশে ধুলায় লুটোপুটি খাওয়া বিচ্ছিন্ন ক্ষনগুলিকে একযায়গায় জড় করে রাখার আকুতি ছাড়া আহামরি আর কিছুই করতে চাইনা।
কোন এক দিনে, সম্ভবত তখন বর্ষাকাল চলছিলো, হানিফ পরিবহনের বাসটি যখনসাতমাথায় এসে দাড়িয়েছিল তখন আমি ঘোলা জানালায় উকি ঝুকি দিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃস্টিতে ভিজতে থাকা বগুড়া নামক একটি সুন্দর শহরকে দেখবার চেস্টা করেছিলাম।
আমার সেই কৌতুহল আনন্দে পর্যবসিত হলো যখন দেখলাম আব্বা ছাতা মাথায় দিয়ে এসে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছেন আমাদের সামনে। । তারপর... আনন্দে উদ্বেলিত আমি স্নেহময়ী বাবার হাত ধরে ভেজা মাটিতে পা রাখলাম।
আজ ১৫ বছর পরে দিনাজপুরগামী (কাকতলীয়ভাবে সেই হানিফ পরিবহনের) সুপার স্যালুন চেয়ার কোচ যখন বনানীর বাকে এসে আস্তে করে বায়ে ঘুরে গেল তখন আমার পুরনো স্মুতিগুলো আরেকবার নড়ে চড়ে বসল।
বড় ভালবেসে ফেলেছিলাম বগুড়াকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটু সামনে রাস্তার বিপরীতে ঢুকে যাওয়া গলিটাকে সিএন্ডবি রোড বলা হতো কিনা আমার ভাল খেয়াল নেই। তবে একপাশে সড়ক ও জনপথ আরেকপাশে পূর্তভবন রেখে মাঝখানদিয়ে ঢুকে যাওয়া ছোট রাস্তা দিয়ে খানিক আগালেই রহমান নগর। চায়না লজ নামক এক আলীশান বাড়ির পাশেই আমার ছেলেবেলার ছোট্ট উঠানটা এইতো যেন চেয়ে চেয়ে দেখছি।
মাত্র একবছর ছিলাম। তাই মজা করে থাকার সখ মেটেনি।
তবুও অনেক কারনেই বগুড়াকে মনে পড়ে। জীবনে প্রথম গুলতিবাস দিয়ে কাকের পাছায় মার্বেল লাগাতে পেরেছিলাম বগুড়াতে থাকতেই। সজনে আর পিয়াজর কালি নামক তরকারী চিনেছিলাম বগুড়া গিয়ে। দক্ষিনবঙ্গে তখনো এরকম তরকারী চোখে দেখিনি। কাঁচা কাঠাল গরুর গোশ দিয়ে রান্না করে খাওয়ার কথা শুনে আমাদের বাসাসুদ্ধ সবার চোখ কপালে উঠেছিল।
দোতলার আন্টি আমাদের বিশ্বাস করানোর জন্য শেষে নিজেই রেধে পাঠিয়ে দিলেন। কাঠাল নামক একটা ভালো জিনিষ ( যেটা আমাদের জাতীয় ফলও বটে) এভাবে শ্রাদ্ধ করার জন্য আমরা নিজেরা নিজেরা বগুড়াবাসীকে যথেস্ট গালমন্দ করেছিলাম যদিও তরকারী খাবার পরে আমাদের রাগ কিঞ্চিত কমেছিল।
বগুড়া গিয়ে প্রথম দারুচিনি গাছ দেখেছিলাম। বইতে পড়েছি দারুচিনি দ্বীপের দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাস্তবে দেখি আমাদের ছোট রাস্তাটা যেখানে বাক নিয়েছিল সেখানে দোকানটার পিছনের বাড়ির উঠোনে আছে একটা দারুচিনি গাছ। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
মালতি নগর হয়ে জলেশ্বরীতলার মোড় পেরিয়ে কারূপল্লীর সামনে দিয়ে সাতমাথায় চলে যেতাম। জিলাস্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই ছিল একটি ফুলের গাছ। নাম জানিনা তবে হলুদ ফুল ছড়িয়ে থাকতে নিচে, দারুন লাগত। গাছটা কি এখনু আছে ? থাকার কথা নয়।
বগুড়া থাকাকালীন প্রথম জানলাম ক্রিকেট নামে একটা খেলা আছে খুব জনপ্রিয়।
বিশ্ব কাপ ক্রিকেট হচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকায় দেখে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল গ্রাহাম গুচ, কেপলার ওয়েলস, আজহার উদ্দিন, ইমরান খান, এ্যালান বোর্ডার, রিচার্ডসন, ইত্যাদি নামগুলো। ওয়াসিম আকরামের বলে ভেঙ্গে যাওয়া স্ট্যাম্পের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে গ্রাহামগুচ ফাইনালের পরের দিন পত্রিকায় দেখা এই ছবিটা এখনও আমার চোখে জীবন্ত। বাংলাদেশে ক্রিকেট উম্মাদনা মনে হয় ওর পর থেকে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
মিহি একটা সেমাই প্রথম খেয়েছিলাম বগুড়াতেই।
দুখ পেয়েছিলাম করতোয়া নদী দেখে। নদীর দেশের মানুষ করতোয়ার নাম শুনেছিলাম খুব কিন্তু দেখে হতাশ। এটা কোন নদী হলো নাকি!! রেলওয়ে ব্রীজের নিচে কতগুলো শুকর সারাগায়ে মলমুত্র মেঘে ঘোরাঘুরি করত। দূর্গাপুজা উপলক্ষে যে মেলা হয় সেখান থেকে মাটির ত্যেরী খেলনা কিনেছিলাম। ইস কিযে আনন্দ পেয়েছিলাম।
বগুড়ায় কোরবানী করেছিলাম একটা খাসী। সেটার কাহিনী বলতে গেলে যে কয়জন পাঠক এখনও ধৈর্য ধরে আছেন তারাও ছুট দেবেন।
ওহ, ভুলে গেছি মাটির দোতলা ঘর ছিলো বগুড়ায় গিয়ে আমাদের চরম একটা বিস্ময়। লাল রঙ্গের ছোট ছোট আলু এখন সব যায়গায় দেখি তবে এর মজা পেয়েছিলাম বগুড়ায় গিয়ে।
আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাইনা।
মহাস্থানগড়, বেহুলার ঢিবি, কারূপল্লী স্টুডিও, আজব গুহা, মহররম আলীর দই, ভি এম স্কুল, মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল, সেওজগাড়ী, সাতমাথা পার্ক, আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠ, ইত্যাদির কথা এক বাক্যে বলে রাখলাম।
নস্টালজিয়া বড় খারাপ জিনিষ। একবার ধরলে ছাড়তে চায়না। আমার এখন ইচ্ছে করছে কথা বলতেই থাকি, বলতেই থাকি। উঠতে মন চাচ্ছে না।
কথা বলতে বলতে বগুড়ায় যাবার প্রচন্ড একটা ইচ্ছা জেগে ওঠে। কোথায় যাবো। পনের বছর পরে পরিচিত কেই নেই (একমাত্র সেই বাড়িওয়ালার পরিবার ছাড়া। তাদের কি মনে আছে আমাদের কথা!) নাহ, যাবো একবার। মাস তিনেক পরে একবার যাবো ভাবছি।
কাউকে চেনার দাকার নেই। প্রয়োজনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। এখনকার বগুড়াকে মিলিয়ে দেখবো পনের বছরের আগের বগুড়ার সাথে, বগুড়ার পথে পথে ধুলোয় জমে থাকা নরম পায়ের চিন্হ খুজে বেড়াব ।
কস্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।