আমি বলতে এসেছি, আমাকে বলতেই হবে..
বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকারসহ বিগত তিনটি নব্বই দিন মেয়াদী অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এ যাবত কালের বাংলাদেশের সকল অনির্বাচিত সরকারের মধ্যে কতগুলো অভিন্ন মৌলিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রবণতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অনির্বাচিত সরকারগুলোর প্রতিটিই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা দখল করেছে। ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দল বা দলসমূহের, বিশেষ করে বিদায়ী সরকার ও বিরোধী দলের নিকট অতীতের ব্যর্থতা-দ্বন্ধ-সংঘাত-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ফলাও করে সরকারি প্রচার যন্ত্রে প্রচার করেছে এবং সে প্রক্রিয়ায় নিজেদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে আরোপিত জনমত গঠনের চেষ্টা করেছে। একই সাথে এও প্রচার করেছে যে, তারা ক্ষমতা দখল করেছেন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। রাষ্ট্রে চলমান ক্রান্তিকালের প্রেক্ষিতে এবং স্বল্প সময়ের জন্য।
সুতরাং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তারা আবার ফিরে যাবেন।
দ্বিতীয়ত: অনির্বাচিত সরকারগুলোর প্রত্যেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জেহাদ' ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রত্যেকেই দৃশ্যমান নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের দৃশ্যমান কার্যক্রমে জনগণ সমর্থন দিয়েছেন, বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত আশাহত হয়েছেন। কারণ পরবর্তী পর্যায়ে তারাই কোন না কোনভাবে দূর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে, আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, এ ধরনের সরকারের প্রতি সব সময় বিদেশী বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আমেরিকান দূতাবাস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল।
চতুর্থত: অনির্বাচিত সব সরকারগুলো কোন না কোন ভাবেই ধর্ম আশ্রিত ছিল। তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। তাও সকল ধর্মের নয়, সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে তাদের প্রতি সমর্থন লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ধর্মকে খুব বেশি ব্যবহার করতে না পারলে অন্তত হজ্ব ব্রত পালন করে এসে বিভিন্ন মঞ্চে-ময়দানে হাজির পোষাক-পরিচ্ছদ-ভাব ব্যবহার করে নিজকে ধার্মীক প্রমাণের চেষ্টা করেছে এবং তার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছে।
পঞ্চমত: অনির্বাচিত সরকারগুলোর প্রত্যেকেরই কোন না কোন ভাবে, হয় প্রত্যক্ষ, না হয় পরোক্ষভাবে 'জলপাই রঙের পোষাক, গাড়ি এবং জলপাই রঙের ছাউনীতে বসবাসকারীদের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেছে, টিকে থেকেছে, টিকে থাকার জন্য বল প্রয়োগ করেছে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে টিতে থাকতে সফলও হয়েছে।
৬ষ্টত: অনির্বাচিত সরকারগুলোর প্রত্যেকেই নিজেদের ক্ষমতা দখল ও টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিকানাধীন সকল প্রচার কৌশল এক চেটিয়াভাবে ব্যবহার করেছে (এটি নির্বাচিত সরকারগুলোর ক্ষেত্রেও সত্য)। একই সাথে ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দানের জন্য ঠিকাদার-চাটুকার তৈরি করেছে। এ ঠিকাদারদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সম্পাদক, ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী কম বেশি সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছে। কখনও ভয় দেখিয়ে আবার কখনও লোভ দেখিয়ে। আবার কখনও বল প্রয়োগ করে।
যেখানে যে ব্যকারণটি খেটেছে সেটিই ব্যবহার করছে।
সকল অনির্বাচিত সরকারগুলোকে শুরুতেই কখনো তার দৃশ্যমান কিছু কার্যক্রমের কারণে (প্রচার-অপপ্রচার দুটোই), আবার কখনো পূর্ববর্তী সরকারী দল এবং বিরুধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে জনগণের মৌণ সমর্থন আদায়ে সফল হতে দেখা যায়। কিন্তু কালের বিবর্তনে খুব বেশি দিন লাগে না। আস্তে আস্তে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসা অনির্বাচিত সরকারও স্থায়ী হওয়ার প্রাণপন চেষ্টা শুরু করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। যেটুকু অব্যাহত থাকে তার সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টাতার উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সরকার হয়ে উঠে সময়ের শ্রেষ্ঠ মামলাবাজ। সরকার অথবা সরকারের মধ্যকার কেউ কেউ 'এক্সিজ রুট' খুজতে থাকে।
কখনও পদত্যাগের মাধ্যমে আবার কখনও কথিত স্বল্পকালীন ক্ষমতাটিকে দীর্ঘ করার মধ্য দিয়ে। আর দীর্ঘ করার প্রক্রিয়াটি হয় প্রাতিষ্ঠানিক কিছু নিয়ম-নীতি অপব্যবহারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকারসমূহের উপরোক্ত প্রবণতাগুলো থেকে প্রিয় পাঠক কি মনে হয়? আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আবারও কি সে একই প্রবণতাসমূহের পুনরাবৃত্তি হবে? অনির্বাচিত সরকারসমূহের মৌলিক প্রবণতা আশ্রিত পথেই কি আমাদের শংকিত যাত্রা ক্রমশ এগিয়ে যাবে? এমন আশংকা যেন কোন দিনই সত্যি না হয়!!!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।